অফিস ছেড়ে চলে আসার পর রাত এগারোটায় টেলিফোনে বার্তা সম্পাদকের অ্যাসাইনমেন্ট পাই। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার রান্ধুনীবাড়ি পুলিশ ক্যাম্পে চরমপন্থিদের সশস্ত্র হামলা ও তার পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাকে সরেজমিন রিপোর্টের জন্য সকালেই সিরাজগঞ্জ রওয়ানা হতে হবে। আপত্তির প্রশ্নই ওঠে না। তবে বিষয়টিতে সামান্য ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ ছিল। বললাম, ঘটনাটি যখন কয়েকদিনের পুরনো তখন সিদ্ধান্তটি আরও আগে জানাতে পারতেন। অন্ততপক্ষে সন্ধ্যার দিকে নির্দেশটি পেলে কিছুটা ফাইল ওয়ার্ক সেরে নেওয়া যেত। তাছাড়া বাসা ছেড়ে দূরে কোথাও কয়েকদিনের জন্য যাবার ক্ষেত্রে আনুসাঙ্গিক কিছুটা প্রস্তুতিরও তো প্রয়োজন রয়েছে! আমার এ ক্ষোভের জবাবে বার্তা সম্পাদক জানালেন, সিদ্ধান্তটি প্রধান সম্পাদকের। নিউইয়র্ক থেকে কয়েক মিনিট আগে তিনি টেলিফোন করেছিলেন। সেক্ষেত্রে আমার সুবিধা-অসুবিধার দিকটা তার ভাববার অবকাশ নেই। অতএব, ক্ষোভের বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সহকর্মী ফটো সাংবাদিক গোলাম মোস্তফাকে ফোনে জানাই ভোর সাড়ে ৫টার সময় বেরিয়ে পড়ার জন্য। পেশাগত স্বাভাবিক উদ্বেগে রাত কাটে প্রায় ঘুমহীন।
ঘটনা ২০০২ সালের। ১৬ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার রান্ধুনীবাড়ি পুলিশ ক্যাম্প সশস্ত্র হামলার শিকার হয়। চরমপন্থীরা ক্যাম্পের ৪ জন পুলিশকে হত্যা করে লুটে নিয়ে যায় ৭টি এসএলআর ও ২টি রাইফেলসহ ১৭৪ রাউন্ড গুলি। চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনায় পুলিশ পরবর্তী কয়েকদিনে এলাকায় গণআটকের মাধ্যমে ত্রাসের মাত্রা বাড়ানো ছাড়া কাজের কাজ তেমন কিছুই করতে পারেনি। প্রতিদিনই সংবাদপত্রে এসব তথ্য প্রকাশ হচ্ছে। এর বাইরে নতুন কী লেখার আছে, তথ্য সংগ্রহের সময় স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকাবাসীর কতটুকু সহযোগিতা পাওয়া যাবে - তা নিয়েই পেশাগত স্বাভাবিক উদ্বেগ।
ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর সকালে সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে বাসে উঠবার পরপরই অসীম মণ্ডলকে ফোন করি। অসীম তখন মানবজমিনের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি। মোস্তফা ও আমিও তখন মানবজমিনে। আর এখন আমি আর অসীম কালের কণ্ঠে। মোস্তফার কর্তমান কর্মস্থল আমার জানা নেই।
তো, সেদিন অসীমের সাথে ফোনে কথা হয় তিনি আমাদের জন্য সিরাজগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষায় থাকবেন। তার সাথে আলাপের পর আমরা আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করবো। কিন্তু অসীমের সাথে দেখা হওয়ার আগেই কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া অকল্পনীয়, বিস্ময়কর এবং একই সাথে মর্মান্তিক এক দৃশ্য খোদ ঘটনাস্থলেই অভ্যর্থনা জানালো আমাদেরকে। কেবল আমাদেরকেই। কারণ, বিষয়টি এলাকায় আগে থেকে উপস্থিত অন্য সংবাদিকদের মনোযোগ কাড়তে পারেনি। চাঞ্চল্যকর একটি রিপোর্টের প্রয়োজনে যেন আমাদের জন্যই লুণ্ঠিত পুলিশ ক্যাম্পের কিছুটা দূরে দৃশ্যটির অবতারণা।
বৃদ্ধ শ্বশুরের লাশ বাঁশের ভারায় ঝুলিয়ে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ৪ গৃহবধূ। ঘাম ও কান্নায় একাকার তারা। প্রথমে বোঝা যায়নি তারা লাশ বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ‘কাঁথায় জড়ানো ওটা কি’ - এ প্রশ্ন করতেই থামলেন। কাঁধ খালি করলেন। তারপর হাহাকার করা কান্নার মাঝে জানালেন বিস্তারিত। বললেন, ‘পুলিশের ভয়ে পুরুষ মানুষ সব ঘর ছাড়া। সেজন্য আমরাই লাশ গ্রামের বাড়ি পঞ্চসারটিয়াতে নিয়ে যাচ্ছি দাফনের জন্য।’ শোকার্ত বধূরা আরও জানালেন- প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরের চর বাগভামরা থেকে তারা লাশ বয়ে আনছেন। সেখানে মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে তাদের শ্বশুরের মৃত্যু হয়। ওই চরটিও পুরুষশূন্য। সে কারণে তারা নিজেরাই দাফনের দায়িত্ব নিয়েছেন। নিজে গ্রামে দাফনের জন্য তাদেরকে লাশ বহন করতে হবে আরও ২ কিলোমিটারের পথ।
বিস্ময়ের ঘোরে আচ্ছন্ন থাকি দীর্ঘক্ষণ। সংবাদপত্রে রিপোর্টিং-এর ক্ষেত্রে ‘পুরুষশূন্য’ কথাটির ব্যবহার বেশ পুরানো এবং প্রচলিত। কিন্তু পুলিশি তাণ্ডবে একটি এলাকা কতটা পুরুষশূন্য হতে পারে তা ওই গৃহবধূদের লাশ বহনের অকল্পনীয় দৃশটি প্রত্যক্ষ না করলে আমাদের জানা হতো না। কখনও শুনিনি- বিশ্বের কোথাও মেয়েরা তাদের স্বজনের মৃতদেহ সৎরের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে তো নয়ই। দৃশ্যটি আমার মস্তিষ্কে স্থায়ী হয়ে যায়। এমনকি ঘটনার ১৫ বছর পর এই মুহূর্তে যখন বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসেছি তখনও তা আমার স্মরণে একই উজ্জ্বলতায় স্পষ্ট।
আগেই বলেছি, ঘটনাস্থল নয়, আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল প্রথমে সিরাজগঞ্জ শহরে পৌঁছে অসীম মণ্ডলের সাথে দেখা করবো। যমুনা সেতু পেরুবার বেশ কিছুক্ষণ পর পর্যন্ত আমাদের সে সিদ্ধান্ত বহাল থাকে। কিন্তু পথের মাঝেই স্থানীয় সহযাত্রীদের আলাপচারিতায় সতর্ক হয়ে উঠি। তারা রান্ধুনীবাড়ি পুলিশ ক্যাম্প লুঠের ঘটনা নিয়েই আলাপ করছিলেন। একজন হাইওয়ে থেকে দক্ষিণে চলে যাওয়া একটি পথের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘ওই পথেই রান্ধুনীবাড়ি যাওয়া যায়’। আমি মনস্থির করে ফেলি। বাস চালককে বলি, ‘প্লিজ, আমাদের এখানেই নামিয়ে দিন।’ সহকর্মী গোলাম মোস্তফার কাছে সিদ্ধান্ত বদলের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করি, ‘সিরাজগঞ্জ পৌঁছে আবার এখানে আসতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। তার চেয়ে আগে ঘটনাস্থল তারপর সিরাজগঞ্জ যাওয়াটাই বেটার হবে।’ মোস্তফা আপত্তি করেন না। বরং আমার সিদ্ধান্তই তার সিদ্ধান্ত বলে জানিয়ে দেন তিনি। আমরা বাস থেকে নেমে পড়ি। জায়গাটির নাম কাড্ডা মোড়। আমাদের উদ্দেশ্যর কথা জেনে স্থনীয় লোকজন সাবধান করে দিলেন। বললেন, ওই এলাকায় যাবার চেষ্টা করবেন না। পুলিশ কাউকে রেহাই দিচ্ছে না। ‘ঢাকার সাংবাদিক’ পরিচয় পেয়ে বললেন, তাহলে পায়ে হেঁটে যেতে হবে। কোনও রিকশাাচালককে রাজি করাতে পারবেন না। কিন্তু রিকশাচালকদের প্রস্তাব দিতে রাজি হয়ে গেলেন একজন। বললেন, ‘আপনারা নির্ভয় দিলে আমার আপত্তি নেই।’
বেলা এগারোটার সময় রিকশাতে সমশেরপুর বাজার পেরুনোর সময় পরিস্থিতি ছিল খানিকটা স্বাভাবিক। কিন্তু বয়রাপাড়া বাজারের পরেই থমথমে অবস্থা। এরপর ভাতুরিয়া গ্রামের প্রান্তে চৌরাস্তায় পৌঁছতেই দেখা হয় শ্বশুরের লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়া ওই গৃহবধূদের সাথে। আমরা যাচ্ছিলাম পশ্চিম থেকে পূর্বে আর ওরা দক্ষিণ থেকে উত্তরে। দু’মিনিট আগে পরে চৌরাস্তায় পৌঁছলে ওদের সাথে আমাদের আর দেখা হতো না। একই সাথে একটি চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট প্রকাশ, প্রকাশিত রিপোর্টের ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার ফলে এলাকাবাসীর দ্রুত দুর্দশা লঘব, সেরা ছবির জন্য মোস্তফার পুরস্কার প্রাপ্তি-এসব কিছুই ঘটতো না।
একেবারে সঠিক সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছনো- সর্বপরি সচিত্র প্রতিবেদনটির জন্য কৃতিত্ব আসলে কার? সেই সহযাত্রীর? যে বলেছিল, ওই পথেই রান্ধুনীবাড়ি যাওয়া যায়, যার কথায় আমরা সিদ্ধান্ত পাল্টে বাস থেকে নেমে পড়েছিলাম? রিকশা চালকও তো দাবি করতে পারেন যে, তিনি রাজি না হলে, অথবা পথ পেরুতে দেরি করলে দৃশ্যটি আমাদের নজরে পড়তো না। মোস্তফার দাবি তো আরও বেশি। কারণ, তিনি তার ক্যামেরাতে দৃশ্যটি ধারণ না করলে কেবল লেখনীর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আবেদন সৃষ্টির বিষয়টি ছিল প্রায় অসম্ভব। নিশ্চয় ওরকম একটি আলোকচিত্রের জন্যই সম্পাদক রিপোর্টটিকে লিড রিপোর্ট হিসাবে ছাপতে রাজি হয়েছিলেন। আবার এ বিষয়টিও তো অস্বীকার করা যাবে না যে, সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদক অ্যাসাইনমেন্টটা দিয়েছিলেন এবং সম্ভাব্য সকল ঝুঁকি নিয়ে রিপোর্টটির সেরা ট্রিটমেন্ট নিশ্চিত করেছিলেন। সুতারং তাঁরাও কৃতিত্বের দাবিদার।
মনে পড়ছে, ভাতুরিয়া গ্রামটির প্রান্তে চৌরাস্তায় পৌঁছে রিকশাতে বসা অবস্থাতেই আমারে নজরে পড়ে চারজন নারী বাঁশের ভারায় ঝুলিয়ে কি যেন বয়ে আনছেন। গ্রামটির অন্য প্রান্তে দক্ষিণ মাইঝাইল। এ দুই গ্রামের মাঝেই আলোচিত পুলিশ ক্যাম্পটির অবস্থান। অথচ আরও দূরের একটি গ্রাম রান্ধুনীবাড়ির নামেই ক্যাম্পটি পরিচিতি পেয়েছে। যা হোক, ওই চার নারীর কষ্টকর ভাবে কী যেন বয়ে আনার দৃশ্যটি ওই মুহূর্তেই আমার কাছে ব্যতিক্রমী মনে হয়। বিস্তারিত কিছু না জেনেই মোস্তফাকে তার ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করতে বলি। রিকশা থেকে নেমে ওই নারীদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কাঁথায় জড়ানো ওটা কি নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা?’ ওরা লাশের কথা জানালে সন্দিহান হয়ে উঠি । হামলার সময় গোলাগুলিতে নিহত কারও লাশ নয় তো! দ্রুত ছবি তুলতে তাগিদ দিই মোস্তফাকে। মোস্তফার ক্যামেরা সচল হয়ে ওঠে। ওদের না থামিয়ে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তোলা হয়। এরপর গাছের ছায়ায় ডেকে নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাই তাঁদের কাছে। কাঁথার মোড়ক খুলে লাশটাও দেখে নিই ভালো করে।
পরদিন ২১ সেপ্টেম্বর রিপোর্টটি প্রকাশের পর সিরাজগঞ্জের তৎকালীন পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন জানিয়েছিলেন, তারাও রিপোর্ট-এর সত্যতা ও লাশটির পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। পুলিশের একটি দলকে এ বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। মজার বিষয় হচ্ছে, রিপোর্টটি পুলিশের বিরুদ্ধে গেলেও এসপি সাহেব প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ছবিটি খুবই দুর্লভ। ভাগ্যক্রমে ওটা আপনারা পেয়ে গেছেন।’ তবে রিপোর্টটি প্রকাশের আগে ২০ সেপ্টেম্বর রাতে তখনকার বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে বিষয়টির গুরুত্ব বোঝানো যায়নি। ওই রাতে তিনি সিরাজগঞ্জেই অবস্থান করছিলেন এবং পুলিশ ক্যাম্প লুটের পরবর্তী পরিস্থিতির উপর নজর রাখছিলেন। গৃহবধূদের লাশ বহনের বিষয়টি তিনি আমলেই নিলেন না। পুলিশী তাণ্ডবের বিষয়ে বললেন, চারজন পুলিশ নিহত হয়েছে। তার অ্যাকশন তো কিছুটা হবেই।’ কিন্তু ২১ সেপ্টেম্বর সকালে তিনি যখন জেলা প্রশাসনের সাথে বৈঠকে ব্যস্ত তখনই ঢাকার টেলিফোনে তৎপর হয়ে ওঠেন। তৎপর হয়ে ওঠে জেলা প্রশাসনও। গ্রামে গ্রামে মসজিদে মসজিদে শুরু হয় মাইকিং। ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া লোকজনকে ঘরে ফেরার আহ্বান জানানো হয়। বিকেলে পুলিশ ক্যাম্পটির কাছে আলিমদ্দিন ওসমান গণি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আয়োজন করা হয় জনসভার। মন্ত্রী ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা সেখানে অহেতুক কাউকে হয়রানির শিকার করা হবে না মর্মে প্রতিশ্রুতি দেন। এরপরই এলাকাবাসী ঘরে ফিরতে শুরু করে।
মনে পড়ছে, জনসভার পরদিন পার্শ্ববর্তী গ্রাম চকমুকিমপুরের বাসিন্দা বৃদ্ধ ছেপাত আলী আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘পত্রিকায় দুর্দশার সংবাদ ছেপে আপনারা আমাদের রক্ষা করেছেন। ঘরে ফিরতে পেরেছি আমরা।’ যদিও ততদিনে বিপুল ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়েছেন তারা। এলাকার তাঁতকলগুলো প্রায় এক সপ্তাহ বন্ধ থাকার কারণে পচে নষ্ট হয়ে গেছে তাদের কয়েক হাজার টন সুতা। তবুও ঘরে ফেরার আনন্দে ওই ক্ষয়-ক্ষতির বিষয়টি তাদের কাছে গৌণ হয়ে ওঠে। কিন্তু এতো কিছুর পরও আমার অনুভূতি অন্যরকম। এখনও ওই রিপোর্টটির বিষয়ে নিজেকে সফল ভেবে খুশি হয়ে ওঠার চেয়ে অনেকগুলো ‘যদি’ সদ্য বিপদ উতরানো মানুষের মতো আমার হূদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। মন্ত্রীর মতোই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনে আমি যদি ব্যর্থ হতাম? লাশ বহনের ওই ঘটনা ছাড়াও প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে পুলিশ ক্যাম্প ও গ্রামটি থেকে নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করি আমরা। কোনটাই কম গুরুত্বের নয়।
গ্রামের পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর একটিতে দেখি, পাঁচ/ছয় জন কিশোরীর ভয়ার্ত অবস্থান। নিরাপত্তার কারণে বিভিন্ন বাড়ি থেকে এসে একত্রিত হয়েছে তারা। খাবার জোটেনি তিন দিন। চরমপন্থীরা যমুনা নদী পথে এসে যাদের বাড়ির নিচে নৌকা ভিড়িয়ে গ্রামে পা রেখেছিল- সেসব বাড়ির মহিলাদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মেলে। ক্যাম্পের পুলিশ সদস্যরাও জানান না জানা অনেক তথ্য। এতোসব তথ্যের ভিড়ে যদি লাশ বহনের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিয়ে রিপোর্টের ইন্ট্রোতে না আনতাম?
মনে পড়ছে, ঘটনাস্থল থেকে ফিরে সিরাজগঞ্জের একটি হোটেলে বসে রিপোর্টটি লেখার আগে বার্তা সম্পাদককে টেলিফোন করি। কী পেলেন- বার্তা সম্পাদকের এ প্রশ্নের জবাবে বলি, ‘চার পুত্রবধূর কাঁধে শ্বশুরের লাশ। দাফনের জন্য গ্রামে কোনো পুরুষ নেই...।’ সব শুনে তিনি সন্তুষ্ট। বললেন, ‘দারুণ ব্যাপার! ছবি পাওয়া যাবে তো? ’বললাম, ‘মোস্তফাকে ঢাকার গাড়িতে তুলে দিয়েছি। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যাবার কথা।’ বার্তা সম্পাদককে এভাবে তথ্যটি আগে থেকে জানানোর বিষয়টিও কম গুরুত্বের নয়। যদি না জানানো হতো তাহলে তথ্যটি নিউইয়র্কে অবস্থানরত সম্পাদকের কাছে যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয়ে তার সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার পথটিকে সুগম করতো না। অতএব কৃতিত্বের দাবিদার আমরা একক ভাবে কেউই নয়। অথবা বলা যায়, কোন কৃতিত্ব নয়, আমরা যে যার দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করেছি মাত্র। কেবল মোস্তফা এক্ষেত্রে কিছুটা সৌভাগ্যবান। ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন পুরস্কার পাওয়ার আগেই আলেচিত আলোকচিত্র থেকে তার বেশ কিছু অর্থ প্রাপ্তি ঘটে। বার্তা সংস্থা এপি নগদ মূল্যে কিনে নেয় এর একটি কপি।
লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, কালের কণ্ঠ
সূত্র : কালের কণ্ঠ