শামীমুল হক :
কাজ শেষে প্রায়ই রাত দুইটা কিংবা আড়াইটায় বাসায় ফিরি। শরীরে তখন ভর করে রাজ্যের অলসতা। কাপড় পরিবর্তন করে সোফায় একটু হেলান দেই। টিভি অন করে দেখি কোথায় কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা? এ সময় পাশের রুমে শব্দ শুনতে পাই একজন হাঁটছেন। একদিন, দুদিন নয়, যতদিন রাতে বাসায় ফিরেছি ততদিনই এমন অবস্থা। কে তিনি ? আর কেউ নন, আমার মা। একদিন মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা এখনও ঘুমাননি। উত্তর দেন-না বাবা ঘুম আসেনা। বুঝতে পারি ছেলেকে বাইরে রেখে মা কিভাবে ঘুমান? ছেলে ঘরে ফিরলে নিশ্চিন্তে বিছানায় যান। মা আমার জনম দুখিনি। আমার আগে তার ঘর আলো করে আসে এক পুত্র সন্তান। কিন্তু কদিন পরই এ সন্তান মারা যায়। এভাবে একে একে আরও তিন পুত্র সন্তান তিনি হারান জন্মের কদিনের মধ্যেই। এরপর পাগলপ্রায় হয়ে পড়েন। এরপর জন্ম নেই আমি। আমার জন্মের পর আমি মারা যাই কিনা সে চিন্তায় মা আমাকে সবসময় বুকে আগলে রেখেছেন। কত রাত যে ঘুমাননি তার হিসাব নেই। আদর করে নাম রেখেছেন সোহাগ। সারা শরীরে তাবিজ বেঁধে রাখেন। কোন বালা মছিবত যেন না আসে। ভূত পেতিœর আছড় যেন না পড়ে। বড় হয়ে দেখেছি বাইরে থেকে মার সামনে গেলেই তিনি আমার গলা আর হাতের দিকে তাকিয়েছেন। তাবিজ আছে কিনা সেটা দেখে নিয়েছেন। কোনদিন তাবিজ না দেখলেই দৌঁড়ে যেতেন হুজুরের বাড়ি। সেখান থেকে তাবিজ নিয়ে এসে হাতে বা গলায় নিজেই পড়িয়ে দিতেন। আজ মা নেই। মার মাতো কেউ এমন অপেক্ষা করেনা। কেউ আর গলায় কিংবা হাতের দিকে তাকায় না। কতদিন মায়ের হাতের রান্না খাইনা। কত মজা করে মা রান্না করতেন। নতুন ধান উঠলে মা পিঠা-পুলির আয়োজন করতেন। শিমের বিচি দিয়ে রান্না করতেন উমান্না। সেই উমান্না খাইনা অনেকদিন। শীতের প্রতিটি সকালে একেক ধরনের পিঠা মুখে তুলে দিতেন মা। মার হাতের দুধ চিতইয়ের কথা আজও ভূলতে পারিনা। লেখাপড়া ঠিকমতো না করলে শাষণ করতেও ছাড়তেন না। মার ভয়ে আমরা ভাই বোনরা লেখাপড়া করেছি নিয়মিত। ভাল রেজাল্ট করেছি। পাড়া প্রতিবেশি সমবয়সীদের সঙ্গে কখনো ঝগড়া লেগে পিটুনি খেয়ে এলে মা ফের পিটুনি দিতেন। কেন গিয়েছি সেখানে এ জন্য শাষণ করতেন। গোটা সংসার মা একলা হাতে সামলেছেন। যখন যা প্রয়োজন তা বলার আগেই হাজির করেছেন। আমার মা ছিলেন বুদ্ধিমতি। আমার বিয়ের দিন ঘটালেন এক কাণ্ড। নতুন বউকে রান্না ঘরে নিয়ে হাতে চামচ দিয়ে বললেন, আজ থেকে রান্না ঘরের দায়িত্ব তোমার। আমি মুক্ত হলাম। এরপর ১৮ বছর মা বেঁচেছিলেন। কোনদিন রান্না ঘরে জাননি। তিন পুত্রবধূকে নিয়ে যৌথ পরিবারে মা থেকেছেন। কোনদিন ঘরে উচ্চশব্দে ‘রা’ পর্যন্ত হয়নি। মা মারা গেছেন প্রায় ৮ বছর। আজও আমাদের যৌথ পরিবার। তিন বউয়ের মধ্যে কোনদিন টু শব্দ হয়না। বড় বউয়ের নির্দেশনায় অন্য দুই বউ চলেন। আশ পাশের মানুষ এসব দেখে ‘থ’ হয়ে যান। এটা কি করে সম্ভব ? আমার স্ত্রী তাদের বলেন, এটা সম্ভব হয়েছে আমার শাশুড়ির কারণে। তিনি শক্ত হাতে সংসারকে ধরে রেখেছেন। তার দেখানো পথে আমরা চলছি। আমার মা ছিলেন বড় আবেগি। গ্রামে থাকতে দেখেছি রমজানে প্রতিদিন মহল্লার মুরুব্বীদের ইফতার পাঠাতেন আমাদের দিয়ে। মুরুব্বীরাও যেন আমার মায়ের ইফতারের জন্য অপেক্ষায় থাকতেন। ঢাকায় আনার পর প্রতি রমজান মাসের ১০দিন পেরুলেই মা যেন কিছু বলতে চাইতেন। কিন্তু বলতেন না। আমি বুঝেও চুপ থাকতাম। এভাবে দুয়েকদিন যাওয়ার পর মাকে জিজ্ঞেস করতাম- মা কিছু বলবেন? মা বলতেন, আমাকে ২০/২৫টি কাপড় কিনে দিও। অনেক মানুষ আমার দেয়া কাপড়ের জন্য অপেক্ষা করবে। আমি রমজানের শেষ দিকে কাপড় কিনে দিলে মা নিজে গ্রামে গিয়ে তা গোপনে বিলি করে আসতেন। কোন মানুষ ঘরে এলে না খাইয়ে বিদায় করতেন না। আমার ঘরে এখনও এ নিয়ম বলবৎ আছে। মার দেখানো অনেক কাজই আমরা তার অবর্তমানে পালন করি। কিন্তু মার জন্য হৃদয়ের হাহাকার থামেনা। মনে হয়, মাকে ‘মা’ ডেকে তৃপ্তি পাইনি। মা ডাকায় অতৃপ্ত রেখে মা পাড়ি দিয়েছেন পরপারে। সেদিন দুপুরে মা ডাকছেন আমার স্ত্রীকে। বললেন, আমি ওয়াসরুমে যাব। দুই মাস ধরে মা অসুস্থ। আমার স্ত্রী ওয়াসরুমে নিয়ে গেলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে মাকে বিছানায় শুয়ানো হলো। আস্তে আস্তে মা কোমায় চলে যাচ্ছেন। চোখের সামনে আমরা দেখছি। আছরের আযানের আগে মা বিদায় নিলেন আমার বাবার কাছ থেকে। পাশে বসা নানী কাঁদছেন। নানীকে বললেন, মা- ক্ষমা করে দিও। আমরা ভাইয়েরা চেয়ে আছি। আযান পড়ছে মসজিদে। মা চোখ বন্ধ করে নিলেন। চিরদিনের জন্য চোখ বন্ধ হয়ে গেলো মায়ের। এখন ছোট ভাইয়ের তিন বছরের মেয়ে দিয়ামণিকে মা ডেকে তৃপ্তি মেটাই। সেও সবাইকে বলে আমি বড় আব্বার ‘মা’। কিন্তু মায়ের হাজারো স্মৃতি মনে পড়ে সবসময়। আমার অসুখ বিসুখ হলে মার চোখের ঘুম হারাম হয়ে যেতো। আমি উহ শব্দ করলে পাশের রুম থেকে মা ছুটে আসতেন সবার আগে। কি হয়েছে বাবা? বলতাম না মা কিছু হয়নি। শরীরে হাত দিয়ে দেখতেন গরম কিনা। আজ সব স্মৃতি হৃদয়ে জমা। একা একা শুয়ে এসব চোখের সামনে ভেসে উঠে। তখন মনের অজান্তে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে পানি।