‘কি রে কি হয়েছে? থম মেরে বসে আছিস কেন?’
অনুকে ছোট্ট করে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল রিমি। থতমত খেয়ে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এসে মৃদু হাসলো অনু।
‘না রে এমনি। বাসার কথা চিন্তা করছিলাম। আজ বড্ড দেরী হয়ে গেল রে।’
‘তুই বাসা নিয়ে চিন্তা করছিস তবু তোর মুখে হাসি।সত্যি এজন্যই তোকে এত ভালো লাগে জানিস।’
‘হাসিটা আছে বলেই তো বেঁচে আছি। মন খারাপ করে কথা বললে আমার সাথে তোর মনটাও খারাপ হয়ে যাবে। তুই আমাকে বাসায় পৌছানোর জন্য তাড়াহুড়ো করবি। ড্রাইভারকে তাড়া দিবি।কিন্তু রাস্তায় জ্যাম, সিগন্যাল হলে ওই বেচারা কি করবে বল! তারচেয়ে আমার মন খারাপের কথাও শুনলি আবার মুখে হাসি দেখে তুই চিন্তিত হলি না। এটা ভালো না বল?’
‘বাব্বাহ্!তুই পারিসও বটে। আচ্ছা একটা কথা বল তো, তোর যে এত কষ্ট, এত দুঃখ তার মাঝেও এত ভালো থাকিস কেমন করে করে? তোকে দেখলে কেউ বলবে না তোর জীবনে এত সংগ্রাম।
অনু কিছুক্ষন চুপ করে থেকে হাত বাড়িয়ে রিমির হাতটা দু’হাতে ধরলো। তারপর মৃদু স্বরে বলল, ‘তোরা আছিস বলে।আমার আকাশে কালো মেঘ জমলে তোরা এসে তা সরিয়ে দিস্। আমার চোখের কোনে এক ফোঁটা দুঃখের অশ্রুকে তোরা খুশির অশ্রু বানিয়ে দিস।তবে এখানে আমার কৃতিত্ব কোথায় বল তো! সবই তো তোদের কৃতিত্ব।’
এক বুক ভালোবাসা আর চোখ ভরা মায়া নিয়ে রিমি ওর বান্ধবীটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। আর কিছু বলতে পারলো না।
গাড়ির ব্রেক করার শব্দে দুই বান্ধবী ঠিক হয়ে বসলো। অনু নিজের মোবাইলটা হাত ব্যাগে ভরে রিমির হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, ‘ভালো থাকিস।আবার দেখা হবে।আর বাসায় পৌছে দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।’
রিমি কপট রাগ দেখিয়ে হাত তুললো মারার জন্য। ততক্ষণে অনু গাড়ি থেকে নেমে গেছে। দুই বান্ধবীর রিনিঝিনি হাসির শব্দে ওই মুহূর্তে মিরপুর কাজীপাড়ার রাতের ছোট্ট আকাশটা যেন হেসে উঠলো। রিমিকে বিদায় দিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে ওর মুখটা শক্ত হয়ে উঠলো। যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও পা টা টেনে টেনে হাঁটতে লাগলো। অনেক স্মৃতি বিজরিত পুরনো বিল্ডিংটার সিঁড়ি কোঠায় পা দিয়ে নোংরা একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিল। সিঁড়ি ভাঙছে আর ভাবছে, ‘আর কত! আর কতকাল এমনভাবে চলবে? ভালোবাসার মানুষটার চূড়ান্ত অঃধপতন না দেখা পর্যন্ত কি এর শেষ নেই! এখন যা হচ্ছে তা কি?আর কি বাকি আছে?’
ভাবতে ভাবতে দরজার সামনে উপস্থিত হলো। কলিংবেল দিতে যাবে এমন সময় দেখে দরজাটা খোলা। মনে মনে ভাবলো, ‘ভালোই হলো।চোখের দেখা তো হবে না।’
কিন্তু অনুর ভাবনা বরাবরের মতই সঠিক হলো না। দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখলো ঠিক দরজা বরাবর ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছে শরীফ। অনু দরজাটা লাগিয়ে ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে। এমন সময় শরীফ উঠে এসে অনুর হাত ধরলো, ‘ওই বেশ্যা মাগী কোথা থেকে আসলি? কোনো লাং রাখলো না তোরে? আবার তো এখানেই ফিরলী।’
‘শরীফ, ছাড়ো। লাগছে।’
‘আমি ধরলে লাগে আর তোর লাঙেরা ধরলে লাগে না?’
অনু চোখ বন্ধ করে আছে। শরীফের প্রতিটা শব্দ যেন কানে বাজছে। তেমনি কথার সাথে সাথে মুখ থেকে বিশ্রী দূর্গন্ধ আসছে। অনুর নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। ও ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত হেঁটে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিল। শরীফের মাতাল শরীর অনুর সাথে তাল মেলাতে পারলো না। কিন্তু দরজার বাইরে সমানে লাথি দিতে লাগলো। অনু চুপ করে থাকলো কিছুক্ষন। তারপর শুধু আস্তে করে বলল, ‘শরীফ তুমিও ভালো করেই জানো আমি তোমার মত নই।রিমির বাসায় দাওয়াত ছিল।সব বান্ধবীরা আসছিল বলে দেরী হয়ে গেল।রিমি নামিয়ে দিয়ে গেছে।’
‘তুই বাহির হ মাগী। তোর সাথে কথা আছে আমার। বাহির হ বলছি।’
অনু আর কোনো কথা বলল না। কি বলবে! অনেক বলেছে। অনেক নির্যাতিত হয়েছে। শারীরিক ভাবে। মানসিক ভাবে। কিন্তু না পারলো ঠিক পথে আনতে। না পারলো আর কাউকে মনে জায়গা দিতে। কত মানুষ বলেছে, ‘শিক্ষিত মেয়ে হয়ে কেন এখানে পরে আছো? চলে যাও। তা না হলে নিজেও মরবা। বাচ্চাগুলাকেও মারবা।’
চলে যে যেতে চায়নি তা ভুল। অনেকবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেন জানি পারেনি। লোকটাকে তো একসময় ভালোবাসতো। দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে মানুষ হিংসা করতো। কেন কিভাবে শরীফের এমন অবস্থা হয়েছে আজ আর সেসব হিসেব মেলাতে ইচ্ছা করে না অনুর। তবে শরীফ অনেক টাকার মালিক। হয়তো বেশি টাকাই ওকে নষ্ট করেছে। তবে শরীফের একটা গুণ আছে- অনু কথা বললে বা তর্ক করলে শরীফ সহ্য করতে পারে না। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে মারতে আসে। কিন্তু অনু যদি চুপ করে থাকে তাহলে একসময় শরীফ চুপ হয়ে যায়। তাই অনু আজকাল চুপ করেই থাকে। আজ থেকে আরো দশ বছর আগে হঠাৎ করেই অনুর এই উপলব্ধিটা হয়েছে। তখন বড় ছেলেটার বয়স তের বছর। আর মেয়ের বয়স এগার। হঠাৎ করেই চুপ হয়ে গিয়ে চাকরীর চেষ্টা করতে শুরু করলো। আর সন্তানদের নিয়ে চরম ব্যস্ত হয়ে পরলো। তখন একটাই লক্ষ্য ছিল, যে করেই হোক সন্তানদের এই নরক থেকে বের করতে হবে।কারণ ততদিনে বোঝা হয়ে গিয়েছিল, এই লোক ছাড়বেও না- ধরবেও না, শুধু যন্ত্রণা দেবে।মাঝখান থেকে ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুগুলোর ভবিষ্যত নষ্ট।
অনুরেখার একক চেষ্টায় আজ তার দুই সন্তানই অষ্ট্রেলিয়ায় লেখাপড়া করছে তাদের ছোট খালার কাছে থেকে। অনুরেখারও সুযোগ ছিল যাবার, কোন এক অজানা কারণে মন সায় দিলো না। তবে আরো একটা কারণ যা অনুরেখা ভীষনভাবে উপলব্ধী করে। শরীফের এই দুনিয়ায় কেউ নেই। ওরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে পড়তো তখন থেকেই শরীফ এতিম। আর এ কারণেই অনুরেখার অনেক মায়া জন্মেছিল শরীফের প্রতি। মায়া থেকে ভালোবাসা। তার এখন ভালোবাসাটাই শুধু নেই। বাকি সব আছে। হায়রে মন!
বাইরে কখন শব্দ থেমে গেছে! এতক্ষনে অনুরেখার খেয়াল হলো। ও আস্তে করে দরজাটা খুলে বাইরে উঁকি দিলো। জানে কেউ অপেক্ষা করে নেই। তবু সাবধানতা। ভাঙ্চুর কিছু কম হয়নি।প্রথমে ঝাড়ুটা নিয়ে ভাঙ্গা গ্লাস, প্লেট একটা কোনায় রেখে অনুরেখা শরীফের রুমে গেল। যথারিতি দেখা গেল শরীফ এলোমেলো ভাবে খাটে ঘুমোচ্ছে। এক্ষেত্রে অনুরেখা কখনোই ঠিক করে দেয় না। একদমই ভালো লাগে না। আলমারি থেকে শুধু কাথাটা নামিয়ে পায়ের কাছে রেখে লাইট বন্ধ করে দিয়ে চলে এলো।
আসার আগে শুধু পরের দিনের কাপড়টা বের করে আলনায় রেখে এলো। এই কাজটা কখনোই অনুরেখার ভুল হয়নি। কিছু কাজ আছে যা দুনিয়া উল্টে গেলেও অনুরেখা করবেই।তার মধ্যে এই কাজটাও পড়ে। আর আছে নিজ হাতে রান্না করা আর সকালের নাস্তাটা টেবিলে দিয়ে তালার ডুপ্লিকেট চাবিটা নিয়ে বের হয়ে যাওয়া।
এই ছোট ছোট কাজগুলো অনুরেখা করুনা করেই করে। আর নিজের মনটা শান্তনা দেয়, ‘সন্তানের বাবার জন্য করছি।’
নিজের রুমে এসে দরজা আটকে দিয়ে আগে গোসলটা সেরে নিল।তারপর সময় নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রাতের প্রসাধন মাখলো।কি মনে করে খুলবে না করেও রুমের দরজাটা খুলে দিল।তবে পুরোটা না। ভেজিয়ে রাখলো। এমনভাবে যেন দেখলে মনে হয় আটকানো।তারপর নিজের পড়ার টেবিলটার দিকে এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এলো। একটু কি খারাপ লাগছে?বুকটা কেমন চিন চিন করে ব্যাথা করছে।অনুরেখা কি মনে করে একবার ফোনটা হাতে নিলো।বাচ্চাদের সাথে একটু কথা বলবে- ‘না থাক, কালই তো কথা হল। আজ থাক।’
খাটের পাশে রাখা বেডসাইড টেবিল থেকে পানির বোতল নিয়ে পানি খেল।তারপর মনে হলো নিয়মিত কাজটা তো করাই হলো না।পড়ার টেবিলে রাখা একটা মোটা ফাইল থেকে লাল টকটকে একটা ডায়েরি বের করলো।মনে পড়লো আর একটা ডায়েরি কেনার কথা ছিল। কেন ভুলে গেল!এত ভুলো মন হয়েছে আজকাল। ডায়েরি শেষের তিনটা পৃষ্ঠা কেবল বাকী। কাল কেনাই লাগবে। মনে মনে ভাবলো অনুরেখা।
একটা কলম নিয়ে ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলো উল্টাতে লাগলো। অনুরেখার হাতের তাড়াহুড়ো দেখে মনে হচ্ছে কেন শেষের খালি সাদা পৃষ্ঠাগুলো আসছে না। যে লেখা গুলো লেখা হয়ে গেছে, সেগুলো সে আর কোনোভাবেই পড়তে চায় না। অবশেষে সাদা পৃষ্ঠাগুলো চোখের সামনে এলো। অনুরেখা লিখতে লাগলো, ‘শরীফ আজ মন খারাপ হচ্ছিলো ভীষন। কেন যে দেরী করে আসলাম! তুমি তো ছিলে না। আমি দুপুরে একবার বাসায় এসেছিলাম। অফিসের ওই নোংরা কাপড় পড়ে কি কোনো দাওয়াতে যাওয়া যায়, বলো? জামাটা পাল্টাতে এসেছিলাম। আরেকটা কাজ অবশ্য ছিল। মনে হয়েছিল দেরী হতে পারে। তাই তোমার খাবারটা রেডি করে রেখেছিলাম। খেয়েছো তো? আমি ঘরে ঢোকার সাথে সাথে এমন শুরু করলে যে, কিছুই দেখা হলো না। তুমি আজও ঠিক হলে না শরীফ।’
এই লাইনটা প্রতিদিন প্রতিটি দিনপঞ্জির নিচে অনুরেখা লিখবেই। হয়তো ভাবে এই লাইনটা লিখতে লিখতেই একদিন শরীফের আচমকা ভালো হয়ে যাওয়ার কথা লিখতে হবে। কিন্তু আজ এই শেষ বাক্যটা লেখার সাথে সাথে অনুরেখার বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এলো। বুক খালি করে এমন দীর্ঘশ্বাস কতদিন পর উঠে এলো অনুরেখা তা মনে করার চেষ্টা করলো। কিন্তু বিধাতার তখন অন্য পরিকল্পনা। অনুরেখা কিছু মনে করার সময়ই পেল না। মমতাময়ী, ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক অনুরেখা দীর্ঘশ্বাসটা নিতেই পারলো ছাড়তে আর পারলো না। লাল টকটকে ডায়েরির উপর অভিমানী অনুরেখার উপরের অংশটা মুখ থুবরে পড়লো। পেছন থেকে দেখলে মনে হবে লিখতে লিখতে টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছে একটা নারী দেহ। অনুরেখা যেতে যেতে তার দিনপঞ্জির শেষ লাইনটিতে রেখা টেনে দিয়ে গেল। লাল ডায়েরির আর একটা পৃষ্ঠাও সাদা রইল না।
১০ জানুয়ারী ২০১৮