সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেননি ভ্লাদিমির পুতিন। পরিবেশ-পরিস্থিতিই তাঁকে দৃঢ়চেতা করেছে। সাফল্যকে মুঠোবন্দী করার কৌশল জীবন থেকে শিখেছেন তিনি।
রাশিয়ায় রোববারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে অনেকটা আনুষ্ঠানিকতা বলা চলে। সবাই জানে, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পুতিন তাঁর শাসনকাল ২০২৪ সাল পর্যন্ত পোক্ত করতে যাচ্ছেন।
দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় আছেন পুতিন। এই সময়ে দেশটির সর্বস্তরে পুতিন তাঁর কর্তৃত্ব বলবৎ করেছেন। এখন এই কর্তৃত্বকে আরও জোরের সঙ্গে জারি রাখার সব আয়োজন সম্পন্ন।
ক্ষমতার রাস্তা কণ্টকমুক্ত রাখতে পুতিন দেশের ভেতরে-বাইরে তাঁর বিরোধীদের কঠোর হাতে দমন করে চলছেন। দেশটির সুশীল সমাজের মাজা ভেঙে দিয়েছেন। বাক্স্বাধীনতা রোধ করেছেন।
৬৫ বছর বয়সী সাবেক কেজিবি কর্মকর্তা পুতিন দেড় যুগ আগে ক্ষমতায় এসে রুশ সমাজের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ক্রেমলিনের প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট হন। রাশিয়ায় এখন নেতা মানেই পুতিন। আর বিশ্বমঞ্চেও পুতিনের জয়জয়কার। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এখন ওয়াশিংটনের চেয়ে বরং মস্কোর নামই বেশি উচ্চারিত হয়। পুতিন একাধিক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দেখেছেন। তাঁদের চাল দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। পুতিন নিজেকে ও তাঁর দেশকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন যে বিশেষ করে প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের ঘুম হারাম। যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছে, তাদের প্রধান হুমকি রাশিয়া। যুক্তরাজ্যও রাশিয়াকে সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করে।
পুতিন নিজেকে আলাদাভাবে গড়ে তুলেছেন। ব্যক্তিত্ব, কাজকর্ম, চিন্তাভাবনায় তিনি বিশ্বের আর দশজন নেতার মতো নন। এই যেমন জুডোতে তাঁর ব্ল্যাক বেল্ট আছে। তিনি উদাম গায়ে ঘোড়ায় চড়েন। জিম করেন। সাঁতার কাটেন। বিশ্বের গভীরতম হ্রদের তলদেশে যান। শিকার করেন। তাঁর একটা ‘মাচো-ম্যান’ ভাবমূর্তি আছে। মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির তালিকায় চার বছর ধরে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছেন পুতিন।
সমর্থকেরা পুতিনকে ‘ত্রাতা’ হিসেবে দেখেন। তাঁদের দৃষ্টিতে, রাশিয়ার গৌরব ও ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার করেছেন পুতিন। তবে শত্রুর চোখে পুতিন এক ‘বিপজ্জনক’ লোক, যিনি রাশিয়ার যত নষ্টের মূল। সমালোচকেরা বলেন, প্রকৃত গণতন্ত্র থেকে রাশিয়াকে বহু দূরে নিয়ে গেছেন পুতিন। তার স্থলে চালু করেছেন ‘নিজস্ব গণতন্ত্র’। তিনি সুশাসন থেকে রুশদের বঞ্চিত করে চলছেন। নিজের ক্ষমতাকে সংহত করার লক্ষ্যে সবকিছুই করতে পারেন তিনি। আর নিজের কাজ জায়েজ করতে তিনি কথিত জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার করছেন।
রাশিয়ায় এই মুহূর্তে পুতিনের প্রভাব-প্রতিপত্তি কতটা, তা স্পষ্ট হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে প্রকাশিত জরিপে। বলা হচ্ছে, তিনি ৭০ শতাংশ ভোট পেতে যাচ্ছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ভোট পাওয়ার জন্য তাঁকে হরদম প্রচারে নামতে হয়নি। এমনকি টেলিভিশন বিতর্কও করতে হয়নি।
রাজনীতিটা বেশ ভালোই রপ্ত করেছেন পুতিন। এখন সবাইকে খেল দেখাচ্ছেন। তাঁর উত্থান বেশ নাটকীয়। তৎকালীন লেনিনগ্রাদের (বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গ) এক শ্রমিক পরিবারে ১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর পুতিনের জন্ম। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবিতে যোগ দিয়ে পুতিন তাঁর ছোটবেলার একটি স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন। কাজের সুবাদে ১৯৮৫-১৯৯০ সাল পর্যন্ত পূর্ব জার্মানিতে ছিলেন তিনি। সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে এলে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান ঘটে। তিনি মেয়রের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে মস্কোতে তাঁর ডাক পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর রাশিয়ার প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের অধীনে ক্রেমলিনে কাজ করার সুযোগ হয় পুতিনের।
স্বল্প পরিচিত পুতিনকে কেজিবির উত্তরসূরি গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির প্রধান করেন ইয়েলৎসিন। তিনি ১৯৯৯ সালের আগস্টে পুতনিকে প্রধানমন্ত্রী করেন। চেচনিয়ায় যুদ্ধ পরিচালনা করায় পুতিনের জনপ্রিয়তা বাড়ে। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে ইয়েলৎসিন পদত্যাগ করলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন পুতিন।
২০০৮ সালে পুতিন তাঁর প্রেসিডেন্টের মেয়াদের দ্বিতীয় দফা পূর্ণ করেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ঘনিষ্ঠ সহচর দিমিত্রি মেদভেদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নিজে হন প্রধানমন্ত্রী। তবে ক্ষমতার নাটাই তাঁর হাতেই থাকে। ২০১২ সালে তিনি ফের প্রেসিডেন্ট হন। এই দফার মেয়াদ শেষে এবার পুতিনের লক্ষ্য ২০২৪ সাল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ‘ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়’ হিসেবে দেখেন পুতিন। এই অনুভূতি থেকে তিনি রাশিয়াকে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রে আনতে মরিয়া হন। তাঁর প্রচেষ্টায় শৌর্যবীর্যে ফিরেছে রাশিয়া। মস্কোর প্রভাববলয় ক্রমেই বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘হেজিমনি’ চ্যালেঞ্জের মুখে।
পুতিন অনেকটা বুক ফুলিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন। তাদের চোখের সামনে ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়াকে রীতিমতো ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়েছেন তিনি। সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সেখানকার যুদ্ধের সব হিসাব বদলে দিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে পুতিনের হাত রয়েছে বলে জোর অভিযোগ আছে। তিনি কার্যত মার্কিন গণতন্ত্রকে ‘কুঁজো’ করে দিয়েছেন বলে কথিত রয়েছে। এমন সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পুতিনের জবাব, ‘যারা পরাজিত হয়, তারা সব সময় অন্যকে দোষারোপ করে।’
ঘরে কিংবা বাইরে, দারুণ খেলেন পুতিন। তো, তাঁর খেলার মূলমন্ত্র কী? ২০১৫ সালে পুতিনের এক মন্তব্যে উত্তর আছে। তিনি বলেছিলেন, লেনিনগ্রাদের (জন্মস্থান) পথঘাট তাঁকে একটি বিষয় শিখিয়েছে: ‘লড়াই অনিবার্য হলে প্রথমেই আঘাত হানতে হবে।’