বিশ্বজুড়ে তীব্র সমালোচনার মুখে অবশেষে ভুল স্বীকার করলেন ফেইসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণার পাঁচ কোটি ফেইসবুক গ্রাহকের তথ্য কৌশল নির্ধারণের কাজে লাগানোর ঘটনা নিয়ে আমেরিকা ও বৃটেনসহ সারা বিশ্বে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। আর এ নিয়ে ঘোর বিপাকে পড়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক।
ফেইসবুক গ্রাহকদের তথ্য রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের হাতে কীভাবে গেল সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতেেইতিমধ্যে জাকারবার্গকে তলব করেছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তদন্ত কমিটি। আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে ফেইসবুক প্রধানকে এ বিষয়ে জবাব দিতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসির। হোয়াইট হাউস বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করবে বলেও জানিয়েছে।
ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত করার অভিযোগে ফেইসবুকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর খবরেই নড়বড়ে হয়ে গেছে ওয়াল স্ট্রিট। দু’দিনে পাঁচ হাজার কোটি ডলার লোকসান হয়েছে ফেসবুকের। শুধু শেয়ারে ধসই নয়, এর ঘটনায় সামগ্রিক ভাবে ফেসবুকের উপর ব্যবহারকারীদের আস্থা কমবে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণায় পরামর্শক হিসেবে কাজ করে লন্ডনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। ট্রাম্পের প্রচারণার রসদ যোগাতে তারা পাঁচ কোটি ফেইসবুক গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য কাজে লাগায় বলে বেরিয়ে এসেছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেল ফোরের এক প্রতিবেদনে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে এ বিষয়সহ রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে অপপ্রচারের কৌশল অবলম্বনের অভিযোগ তোলা হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয় যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন সরকারি সংস্থা। ইতোমধ্যে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কার্যালয়ে তল্লাশি পরোয়ানা জারির আবেদনও হয়েছে আদালতে।
হাউজ অব কমন্সের তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ডেমিয়ান কলিন্স সোমবার জাকারবার্গকে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন, ‘ভয়াবহ বিধি লংঘনের’ বিষয়টি নিয়ে যথাযথ কর্তৃত্বসম্পন্ন একজন ঊর্ধ্বতন ফেইসবুক নির্বাহীর বক্তব্য শোনার সময় হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনার মধ্যে বুধবার এক ফেইসবুক পোস্টে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ বলেন, “আমরাও ভুল করেছি। এ বিষয়ে আমাদেরও করার কিছু ছিল।” অভিযোগ ওঠায় কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা জানিয়েছে ফেসবুক। তবে যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছে অ্যানালিটিকা।
ব্রিটিশ টিভি চ্যানেলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়-২০১৩ সালে তৈরি হওয়া এই ব্রিটিশ সংস্থাটিকে প্রায় দেড় কোটি ডলার অর্থ সাহায্য করেন রিপাবলিকান সমর্থক রবার্ট মের্কের। ফেসবুক তো বটেই, বিষয়টি সামনে আসায় নড়েচড়ে বসেছে ট্রাম্প প্রশাসনও। ইতিমধ্যেই ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউস।
অন্যদিকে সেই অ্যাপ নির্মাতা জানিয়েছেন, ফেইসবুক গ্রাহকদের তথ্য নিয়ে তাকে বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে। পাঁচ কোটি ফেইসবুক গ্রাহকের তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার শুরু হয়েছিল যে অ্যাপের মাধ্যমে তার নির্মাতা বলছেন, এ বিষয়ে ব্রিটিশ রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ও ফেইসবুক তাকে বলির পাঁঠা বানিয়েছে। আলেকজান্ডর কোগান বলছেন, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার জন্য ২০১৪ সালে ওই অ্যাপ বানানোর সময় তিনি জানতেনই না এর মাধ্যমে ফেইসবুক নীতিমালার লংঘন হচ্ছে। সে সময় তাকে বলা হয়েছিল সব কিছুই আইনের মধ্য থেকেই করা হবে। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে কাজ করে লন্ডনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কোগানকে দিয়ে ২০১৪ সালে একটি অ্যাপ বানিয়ে নেয় তারা।
ওই অ্যাপের মাধ্যমে ২০১৪ সালে ‘দিস ইজ ইউর ডিজিটাল লাইফ’ শিরোনামে একটি কুইজ পরিচালনা করা হয়। গ্রাহকের ব্যক্তিত্ব কেমন সে সম্পর্কে তার ধারণা লাভের প্রলোভন দেখিয়ে ওই কুইজে অংশ নিতে গ্রাহকদের আমন্ত্রণ জানায় ফেইসবুক।
প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার গ্রাহক ওই কুইজে অংশ নিয়ে তাদের তথ্য দেয়। এদিকে অ্যাপটি ওই সব গ্রাহকদের বন্ধু তালিকার সদস্যদের তথ্যও তাদের অগোচরে নিয়ে নেয়।
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সাবেক কর্মী ক্রিস্টোফার উইলি বলেছেন, গ্রাহকদের সম্মতি নেওয়া সংক্রান্ত একটি নীতিমালা ফেইসবুক করার আগেই পাঁচ কোটি গ্রাহকের তথ্য হাতিয়ে নেয়া হয়েছিল ওই অ্যাপের মাধ্যমে।
সে সব তথ্য কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাছে বিক্রি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন উইলি। তিনি বলেন, পরে ওই সব তথ্য বিশ্লেষণ করেই ট্রাম্পের প্রচারণার কৌশল নির্ধারণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
এজন কোগানকে দায়ী করে ফেইসবুকের এক মুখপাত্র বলেন, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা একটি তৃতীয় পক্ষ, যারা ওই তথ্যগুলো বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করেছিল। তাদের কাছে তথ্য সরবরাহের অনুমতি ছিল না কোগানের।
বিষয়টি নিয়ে বুধবার বিবিসির রেডি ফোরের টুডে প্রোগ্রামে কোগান বলেন, এই বিষয় নিয়ে গত সপ্তাহে যে সব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো তার জন্য একটি কঠিন ‘ধাক্কা’। “আমার উপলব্ধি হচ্ছে যে, ফেইসবুক ও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা আমাকে মূলত ব্যবহার করেছে বলির পাঁঠা হিসেবে।”
ওই সময়ের প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনি বলেন, “কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা আমাদের নিশ্চিত করেছিল যে, সব কিছুই পুরোপুরিভাবে আইনি এবং ফেইসবুকের বিধির মধ্যেই রয়েছে।”
সে সময় বিষয়টি নিয়ে আরও প্রশ্ন না করে তাদের কথা মতো কাজ করা ‘বড় ভুল হয়েছিল’ বলে মন্তব্য করেন আলেকজান্ডর কোগান। তিনি বলেন, যে সব তথ্য এসেছিল তাতে ট্রাম্পের লাভের চেয়ে ক্ষতিই হওয়ার কথা ছিল। তবে সেগুলো ভিন্নভাবে কাজে লাগিয়েছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা।