logo
আপডেট : 9 April, 2018 02:18
সনদ না নিলে মুছে ফেলা হবে রেকর্ড
ঢাকা অফিস

সনদ না নিলে মুছে ফেলা হবে রেকর্ড

কোনোটির ব্রেক নেই, কোনোটির ইঞ্জিন চলতে চলতে থেমে যায়, যাত্রীর আসন ছেঁড়া-ফাটা, কোনোটির রং এমন হয়েছে, তাকানো যায় না। ১০ বছর বা তার বেশি সময় ধরে যেকোনো রাস্তায় চলাচলের অনুপযোগী যাত্রী ও পণ্যবাহী এমন বেহাল ৫২ হাজার ৬৭০টি গাড়ি চলতি মাসের মধ্যে ফিটনেস পরীক্ষা না করালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সেগুলোর অস্তিত্ব তালিকা থেকে মুছে ফেলবে। এ ছাড়া ফিটনেস সনদহীন এসব গাড়ি রাস্তায় যাতে চলাচল করতে না পারে সে জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হবে। বিআরটিএ সদর কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংস্থাটির কাছ থেকে পাওয়া ফিটনেস খেলাপি এসব গাড়ির তালিকায় সরকারি গাড়ি রয়েছে তিন হাজার ৭৪০টি। পুলিশ, আনসার, বিভিন্ন জেলা প্রশাসক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা সিটি করপোরেশন, পুলিশ সদর দপ্তর, বিভিন্ন পুলিশ কমিশনার, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিএমএসডি, মত্স্য অধিদপ্তর, এলজিআরডির প্রধান প্রকৌশলী, বাংলাদেশ বেতার, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালকসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের জন্য ক্রয় করা হয়েছিল এসব গাড়ি। এর মধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর ছাড়াও পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের জন্য ক্রয় করা গাড়িই রয়েছে দুই শতাধিক। ১০ বছর বা তারো বেশি সময় ধরে বেসরকারি ফিটনেসহীন গাড়ির মধ্যে রয়েছে যাত্রীবাহী বাস, মিনিবাস,পণ্যবাহী গাড়ি। এ তালিকায় ঠাকুরগাঁও থেকে নিবন্ধিত গাড়ি রয়েছে ২১১টি, টাঙ্গাইল থেকে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৪৩১টি। এভাবে বিভিন্ন জেলায় বিআরটিএ থেকে নিবন্ধিত গাড়ি নিবন্ধন নম্বরসহ তালিকাটি করা হয়েছে।

বিআরটিএ-এর পরিচালক (প্রকৌশল) মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ১০ বছর বা তার অধিক সময় ধরে যেসব মোটরযানের মালিক ফিটনেস না নিয়ে এসব গাড়ি চালাচ্ছেন তাঁদের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে ফিটনেস নবায়ন করতে অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যথায় তাঁদের মোটরযান রাইড অফ ঘোষণা করা হবে।

বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক মাসুদ আলম বলেন, ‘এসব গাড়ির ফিটনেস নবায়ন করা না হলে এগুলো আমাদের রেকর্ড থেকে মুছে ফেলা হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এসব গাড়ি আটক করতে বলা হবে।

তালিকায় দেখা গেছে, ২০০১ সালে গাড়ির ফিটনেস নেওয়ার পর অনেক মালিক ফিটনেস সনদ নেননি। অথচ বিআরটিএতে মোটরসাইকেল ছাড়া অন্যান্য গাড়ির নিয়মিত ফিটনেস পরীক্ষা করিয়ে সনদ নিতে হয়। তা না থাকলে গাড়ি রাস্তায় চালানো আইনসম্মত নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন জেলায় এসব গাড়ি অনুপযোগী হয়ে রাস্তায় চলছে। বিআরটিএ এত বছর এ নিয়ে নীরব ছিল। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণগুলোর একটি চলাচলের অনুপযোগী গাড়ি। সড়কে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক চাপে পড়ে বিআরটিএ এবার এসব অনুপযোগী গাড়ি চলতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে ফিটনেসহীন গাড়ি আছে অর্ধলক্ষের বেশি। পরিবহন মালিকদের চাপে পড়ে এসব গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে পারে না বিআরটিএ। রাজধানীতে সাত হাজার বাস ও মিনিবাস চলাচল করে, যার ৮৮ শতাংশ ফিটনেসহীন। যেমন, গত বুধবার দুপুরে মিরপুর ১০ নম্বর চত্বরে ভাসানটেক-গাবতলী রুটে চলাচলকারী ফাস্ট টেন পরিবহনের যাত্রীবাহী গাড়িতে উঠে দেখা গেছে, এটির ডান দিকের চালকের লুকিং গ্লাস নেই। আসনগুলো বসার অনুপযুক্ত। চালকের আসনে বসা আল আমীনের কাছে ফিটনেস সনদ আছে কি না জানতে চাইলে সে জানায়, নেই। ৮৮ শতাংশ বাসের আয়ুষ্কাল ২০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে বহু বছর আগে। শিকড়, ইটিসি, কনক, তুরাগ, স্বকল্পসহ বিভিন্ন পরিবহনের বাসে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে। ফিটনেসহীন এসব বাস রেষারেষি করে চালান চালকরা। মালিকরাও আয়ু ফুরানো গাড়ির আর খেয়াল নেন না। তাঁরা ভরসা রাখেন চালকদের ওপর। এসব বাসের সিংহভাগ চালকের সঙ্গে চুক্তিতে চালাচ্ছেন মালিকরা।

২০ বছরের পুরনো গাড়ি উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয় বড় কোনো অনুষ্ঠান হলে কিংবা বড় ধরনের দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটলে। ২০১১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার জন্য রাজধানী থেকে ফিটনেসহীন গাড়ি উচ্ছেদে স্বোচ্চার হয়েছিল বিআরটিএ। বিশ্বকাপ শেষে অভিযানে ধরা পড়া গাড়ি আবার চলতে দেওয়া হয়। পরে এশিয়া কাপ ক্রিকেট ও বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টি খেলার জন্য আবারও একই ধরনের তৎপরতা দেখায় বিআরটিএ। তখন বাসে রং করার হিড়িক পড়েছিল। তবে অনুপযুক্ত এসব গাড়ি প্রতিযোগিতা করে চলতে গিয়ে মানুষের প্রাণ নেয়, অঙ্গহানি ঘটায়।

বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শকরা জানান, গাড়ির চেসিস নম্বর ঠিক আছে কি না, গাড়ির রং, লাইট, আসনের অবস্থা পরীক্ষা করে গাড়ি চলাচলের উপযুক্ততার সনদ দেওয়া হয়।

মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর গাড়ি পরিদর্শনকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ফিটনেসের ক্ষেত্রে দেখতে হয় গাড়ির কমপক্ষে ৩২টি বিষয়। যন্ত্রের সাহায্যে সহজে গতি, ইঞ্জিন, চেসিসসহ গাড়ির বিভিন্ন অংশের অবস্থা পরীক্ষা করা সম্ভব। চালুর পর থেকে গত বুধবার পর্যন্ত মিরপুর কেন্দ্রে ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়েছে ৯ হাজার ২৩২টি গাড়ির। এ ছাড়া দেশের আর কোথাও যন্ত্রে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করা হয় না। খালি চোখে মোটরযান পরিদর্শকরা ফিটনেস দেখেন।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট তাদের গবেষণায় দেখতে পায়, ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সংঘটিত দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৬০ হাজার ৬৬১টি গাড়ি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। দুর্ঘটনায় নষ্ট হয় কমপক্ষে ৬৬ হাজার ৮১৮টি গাড়ি। তবে এই পরিসংখ্যান থানায় মামলার হিসাবের ভিত্তিতে করা। এই রেকর্ডের বাইরে ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি ও ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি রয়েছে আরো বেশি।