আপডেট : 23 April, 2018 22:11
দুই বছরে আড়াইশ’ দস্যুর আত্মসমর্পণ:
জলদস্যুমুক্ত সুন্দরবন: শান্তি ফেরালেন এক অনুসন্ধানী সাংবাদিক
তুহিন সানজিদ, নিউইয়র্ক : বদলে গেছে সুন্দরবনের চিত্র। স্বস্তি ফিরে এসেছে উপকূলে। নেই অস্ত্রের ঝনঝনানি। জিম্মি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, হত্যা, চাঁদাবাজি আর ডাকাতি ছিল যেখানকার প্রতিদিনের নির্মম চিত্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেখানে ছিল অসহায়, বহু বছর পর এখন সেখানে বইছে শান্তির সুবাতাস। দীর্ঘদিনের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে লাখ লাখ মানুষ।
প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়, এ অসাধ্য সাধন করেছেন একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক। তার প্রচেষ্টায় দু’বছরে প্রায় আড়াইশ’ জলদস্যু আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। জমা দিয়েছেন ৩৫৩টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২০ হাজার রাউন্ড গুলি। একজন সাংবাদিকের মধ্যস্থতায় এত বেশি সশস্ত্র সন্ত্রাসীর আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ঘটনা এটাই প্রথম, এ ধরনের ঘটনা বিশ্বেও বিরল।
তিনি বাংলাদেশের সংবাদভিত্তিক বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। সুন্দরবন উপকূলের লাখো মানুষের মুখে হাসি ফিরিয়ে দেয়ায় দেশের সীমানা পেরিয়ে সারা বিশ্বে এখন আলোচিত হচ্ছে সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিমের নাম।
১০ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হিসেবে খ্যাত সুন্দরবন উপকূলে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের বসবাস। লক্ষাধিক মানুষ জীবন জীবিকা নির্ভর করে এই বনের ওপর। বছরের বেশিরভাগ সময় এই বনের মধ্যেই থাকতে হয় জেলে, বাওয়ালী আর কাঠুরিয়াদের। তাদের মোকাবেলা করতে হয় বাঘ, সাপসহ আরও অনেক হিং¯্র প্রাণীর। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিলো জলদস্যু। জীবিকার তাগিদে যারা সুন্দরবনে যায় কাঠ কাঁটতে, মাছ ধরতে বা মধু সংগ্রহ করতে, নিতান্তই দিনে আনা-দিনে খাওয়া এসব মানুষকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতো জলদস্যুরা। প্রাণ রক্ষার্থে অনেকে ভিটেবাড়ি বিক্রি করে স্বজনদের ছাড়িয়ে আনতো জলদস্যুদের কাছ থেকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জানালে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো।
যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মোহসীন-উল হাকিম
এছাড়া দুবলার থেকে শুরু করে সমুদ্রের মাছ ব্যবসায়ি ও জেলেদের কাছ থেকে প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা আগাম চাঁদা আদায় করতো জলদস্যুরা। পাথরঘাটার ব্যবসায়িরা দিত বছরে ছয় কোটি টাকা। শরণখোলা ও মহিপুরের ট্রলার মালিকদেরও বছরে কয়েক কোটি টাকা চাঁদা দিতে হতো। শুধু তাই নয়, পুরো উপকূলীয় জেলাগুলোর সাগরে মাছ শিকারে যাওয়া ট্রলার মালিকদেরও চাঁদা দিতে হতো। আর চাঁদা না দিলে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতো এই দস্যুরা। কখনও দিনে শতাধিক অপহরণের ঘটনাও ঘটতো। উপকূলের একধরনের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিরা দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতায় বিশেষ ভূমিকা পালন করতো।
বছরের পর বছর ধরে এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছিল না ব্যবসায়ি, জেলে, মৌয়াল, কাঠুরিয়া আর উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। সুন্দরবনে জলদস্যুদের এই রাজত্ব প্রায় তিন যুগ ধরে চলে আসছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাড়াশি অভিযান চালিয়েও তাদের ধরতে পারে না। কারণ নদীপথে পুলিশ বা কোস্টগার্ড অভিযানে গেলেই তা জানতে পারে জলদস্যুরা। মোবাইলের মাধ্যমে খবর পেয়ে তারা নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে পারে।
বহু চেষ্টার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেখানে ব্যর্থ সেখানে শান্তির দূত হয়ে আসে একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক। ঘটনা কিংবা ঘটনার আড়ালের ঘটনা খুঁজে বেড়ানোই যার নেশা, তাকে পেয়ে বসে আরেক নেশায়। সে নেশা শান্তির নেশা, বিপথগামী কিছু মানুষকে স্বাভাবিক জীবনের পথে ফিরিয়ে আনার নেশা। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস গভীর সুন্দরবনে জলদস্যুদের ঢেরায় কাটিয়েছেন এই সাংবাদিক। ওইসব সন্ত্রাসীদের তিনি অন্ধকার পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য বুঝিয়েছেন। একে একে ২০টি জলদস্যু বাহিনী আত্মসমর্পন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। রচিত হয়েছে অন্যরকম ইতিহাস।
দস্যু জয়ের অবিশ্বাস্য কাহিনী
এবং একজন মোহসীন-উল হাকিম
দস্যুমুক্ত হয়েছে সুন্দরবন। তবে দস্যুজয়ের অবিশ্বাস্য এই কাহিনীর শেষটা যেমন আনন্দের, শুরুটা তেমন ছিলনা। গহীন বনের মধ্যে গিয়ে একজন সাংবাদিকের পক্ষে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নিয়ে সরেজমিন রিপোর্ট করা ছিল যেমন ঝুঁকিপুর্ণ তেমনি তাদেরকে বুঝিয়ে অস্ত্র ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের মন জয় করার বিষয়টি ছিল আরো কঠিন ও বিপদজ্জনক। প্রতিটি পদে পদে ছিল বিপদ, অবিশ্বাস এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি। কিন্তু সবকিছু জয় করে অবিশ্বাস্য এক দস্যু জয়ের ইতিহাস গড়েছেন মোহসীন-উল হাকিম।
তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সমস্যা ও সম্ভাবনা এবং প্রান্তিক মানুষের নানা ইস্যু নিয়ে কাজ করেন। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ ও প্রাণবৈচিত্র থেকে শুরু করে উত্তরের বিস্তীর্ণ জনপদ, হাওর-বাওর বেষ্টিত উত্তর পূর্বাঞ্চলের মানুষের জীবন ও দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় জনপদের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন সব সময়। বিশেষ করে সুন্দরবন উপকূলের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে।
সসস্ত্র জলদস্যুদের ট্রলারে সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম
২০০৯ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ‘আইলা’র পর সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রাম গাবুরার অসহায় মানুষদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন জলদস্যুদের বিষয়টি। ঘুর্ণিঝড় আইলা’য় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ তাকে জানান, ঝড়ের ক্ষতি তারা কিছুদিনের মধ্যে হয়তো সামলে উঠতে পারবেন কিন্তু তার চেয়ে বড় ঝড়ের নাম ‘জলদস্যু’। অভিশপ্ত এই ঝড় উপকূলের লাখ লাখ মানুষের জীবন ল-ভ- করে করে চলেছে বছরের পর বছর ধরে। নিষ্ঠুর সাইক্লোনে সব হারানো যে মানুষগুলো নদীর ধারে বেড়িবাঁধের ওপর খোলা আকাশের নীচে বসবাস করছে তাদের কাছে খাবার বা মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন জলদস্যুদের হাত থেকে নিরাপদে থাকা। কবে না জানি শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে তাদের হাতে তুলে দিতে হয় সব সময় সেই ভয়।
গাবুরাবাসীর কথা শুনে অনেক চেষ্টার পর জলদস্যুদের সাথে যোগাযোগের একটি মাধ্যম পেয়ে যান মোহসীন-উল হাকিম। ২০১০ সালে তিনি প্রথমবারের মতো যোগাযোগ করতে সক্ষম হন মোতালেব বাহিনীর প্রধান মোতালেবের সঙ্গে। রিপোর্ট করার পাশাপাশি তাদেরকে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য বোঝাতে থাকেন। প্রথমে রাজি হলেও পরে তারা আত্মসমর্পণ করেনি। এর কিছুদিন পর র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় বাহিনী প্রধান মোতালেব।
কিন্তু থেমে থাকেননি এই সাংবাদিক। আস্তে আস্তে সুন্দরবনের অন্যান্য বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। একটানা সংবাদ প্রচার ও ফলোআপের পাশাপাশি তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য বোঝাতে থাকেন। এজন্য দিনের পর দিন তাকে থাকতে হয়েছে জলদস্যুদের সাথে। দু’বছরে একশ’ বারেরও বেশি তাকে যেতে হয়েছে সুন্দরবনে। জলদস্যুদের আত্মসমর্পণে আগ্রহী করে তোলার পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছেও বিষয়টি তুলে ধরতে থাকেন তিনি। বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর হলেও ধীরে ধীরে দুই পক্ষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম।
সুন্দরবনের ত্রাস মাষ্টার বাহিনীর প্রধান আত্মসমর্পণ করতে চান যমুনা টিভিতে এই রিপোর্ট করার পর নড়েচড়ে বসে সরকার। র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ওই সাংবাদিকের সাথে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে ফোন করে কথা বলেন। বিষয়টি বিস্তারিত শুনে আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং আত্মসমর্পণ করলে তাদের পুরষ্কৃত করার ঘোষনা দেন।
অবশেষে ২০১৬ সালের ৩১ মে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যু বাহিনী ‘মাস্টার বাহিনী’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। এরপর পর্যায়ক্রমে ২০টি জলদস্যু বাহিনীর প্রায় আড়াইশ’ সদস্য আত্মসমর্পণ করে।
হাতে গোনা কয়েকজন বাদে আত্মসমর্পণকারি সবাই এখন জামিনে মুক্ত আছেন। সবাই বিভিন্ন কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। পুনর্বাসনের লক্ষ্যে এরই মধ্যে আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের প্রত্যেককে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা, বেসরকারী একটি ব্যাংকের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার ও র্যাবের পক্ষ থেকে জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। তাদের সার্বক্ষণিক দেখভাল করছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
বদলে যাওয়া এক দস্যু সর্দার
সুন্দরবনের এক সময়ের ত্রাস ‘মাষ্টার বাহিনী’র প্রধান কাদের ওরফে কাদের মাষ্টারের আসল নাম মোস্তফা শেখ। জন্ম খুলনার মংলা উপজেলার মিঠাখালী গ্রামে। শৈশব কেটেছে রামপাল উপজেলার কাটাখালী এলাকায়। এই মানুষটি অন্যদের মতো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ২০০৫ সালের দিকে এলাকার প্রভাবশালী বাবুল মিয়া (বর্তমানে বেড়িখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান) তার হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে সুন্দরবনে পাঠিয়ে দেয়।
অস্বীকৃতি জানালে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দেয়া হয় তাকে। সেসময় দলের নেতা ছিল রাজু। ‘রাজু বাহিনী’ সেসময় ছিল সুন্দরবন উপকূলের ত্রাস। এই বাহিনীর সাথে সুন্দরবনে চাঁদাবাজি, জেলে-মৌয়াল অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের কাজে নেমে পড়ে মোস্তফা। কয়েকবছর পর আলাদা হয়ে নিজেই গড়ে তোলে নতুন এক বাহিনী। নাম দেয়া হয় ‘মাষ্টার বাহিনী’।
একসময়ের ভয়ংকর দস্যু সর্দার মোস্তফা শেখ ওরফে কাদের মাষ্টার
মোস্তফা শেখের নাম বদলে হয়ে যায় কাদের মাষ্টার। কিছুদিনের মধ্যে পশুর নদী এক প্রান্ত থেকে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত একক আধিপত্য বিস্তার করে এই বাহিনী। মাষ্টার বাহিনীর অপহরণ, চাঁদাবাজি মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা জানার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়ে উঠে তাকে গ্রেফতারের জন্য।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে একসময় মোস্তফা শেখ ওরফে কাদের মাষ্টার হয়ে উঠে সুন্দরবনের মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী। বহুবার কম্বাইন্ড অপারেশন চালিয়েও গ্রেফতার করা যায়নি তাকে। ভয়ঙ্কর হিং¯্র সেই দস্যু সরদার হঠাৎ করেই বদলে যায়। অন্ধকার পথ ছেড়ে ফিরে আসতে চায় স্বাভাবিক জীবনে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুন্দর সাজানো একটি সংসারের স্বপ্ন দেখে। ২০১৬ সালের ২৯ মে ৫২টি অস্ত্র আর সাড়ে ৫ হাজার গুলি এবং ১০জন সহযোগি নিয়ে সে র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তার একদির পর ৩১ মে মংলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সশস্ত্র জলদস্যু বাহিনী প্রথমবারের মতো আত্মসমর্পণ করে।
মোস্তফা শেখ ওরফে কাদের মাষ্টার তার বদলে যাওয়ার নেপথ্য কাহিনী বলেছেন নিউইয়র্ক মেইল এর প্রতিবেদকের সাথে। নিউইয়র্ক থেকে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কেউই নিজের ইচ্ছায় কোনো খারাপ পথে পা বাড়ায় না। এলাকার প্রভাবশালী বাবুল প্রথমে তার হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে অন্ধকার জগতে ঠেলে দেয়। আর একবার এই জগতে ঢুকে গেলে ফিরে আসা খুবই কঠিন। হয়তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করবে, নয়তো ক্রসফায়ার অথবা প্রতিপক্ষ কোনো দস্যু বাহিনীর হাতে মরতে হবে। সেজন্য ইচ্ছা থাকলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কথা তারা চিন্তা করতো না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের নাম করে চাঁদাবাজি করতো বাবুলসহ তার লোকজন। প্রতিবছরে কয়েক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হতো মাছ ব্যবসায়ি, জেলে আর মৌয়ালদের কাছ থেকে। উপকূলের ব্যবসায়ি ও ধনী মানুষরাও রেহাই পেত না। এ ধরনের অনেক ঘটনাই আমাদের জানার বাইরে ঘটতো। কারণ আমরা সুন্দরবন থেকে কখনও বাড়িতে বা উপকূলেও আসতে পারতাম না। গডফাদাররা ভয় দেখাতো, লোকালয়ে আসলেই পুলিশ এবং র্যাব ক্রসফায়ারে শেষ করে দেবে। আমাদের জন্য শুধু খাবার পাঠানো হতো। পরিবারের জন্য শুধু খাবার টাকা ছাড়া বাড়তি কোনো টাকা পয়সা দেয়া হতো না। এভাবে ৭/৮ বছর কেটে যায় বনের মধ্যে।
‘স্ত্রী-সন্তান রেখে অন্ধকার জীবন আর ভালো লাগছিল না। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাই কিন্তু বিশ্বস্ত কোনো মাধ্যম পাচ্ছিলাম না। ঠিক এসময় মনে হয় সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিমের কথা। রাজু বাহিনীতে থাকার সময় তিনি একবার দেখা করে আত্মসমর্পণের জন্য অনেক বুঝিয়েছিলেন। সেসময় কেউ রাজি হইনি। আমি তার ফোন নাম্বার যোগাড় করে কল করি। উনাকে দেখা করার কথা বলি। তিনি দ্রুত সাড়া দিয়ে দেখা করেন। অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরে আসার অনুরোধ জানান। তিনি বোঝান অন্ধকার আর স্বাভাবিক জীবনের তফাৎ। ভালোভাবে বাঁচার ইচ্ছা তৈরি হয় মনের মধ্যে। মোহসীন ভাই চলে আসার পর আমরা আর কোনো খারাপ কাজ করিনি। আস্তে আস্তে আমরা সবাই বদলে যেতে থাকি। কোনো জেলে-বাওয়ালীকে অপহরণ করিনি। শুধু অপেক্ষায় ছিলাম কবে পরিবারের কাছে ফিরতে পারবো।’
‘তিনি আশ্বাস দেন প্রশাসন ও সরকারের সাথে সুষ্ঠু আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান করে দেবেন। সবকিছু ঠিকঠাক করে আবারও তিনি ফিরে আসেন আমাদের কাছে। সবকিছু বিস্তারিত শুনে বিশ্বাস করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আগে তার কাছেই আমরা সমস্ত অস্ত্র ও গুলি জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের পর আমাদের জেলে পাঠানো হয়। জেল থেকে বের হয়ে বাগেরহাট মাজারের সামনে একটি মোটর গ্যারেজ চালু করেছি। এটা দিয়ে এখন আমার সংসার ভালোই চলছে। মেয়ের বয়স ১০ বছর আর চারমাস আগে একটা ছেলে হয়েছে। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাকি জীবনটা এভাবেই কাটাতে চাই।’
আলাপচারিতার শেষপ্রান্তে মোস্তফা বলেন, ‘সন্ত্রাসের পথে পা বাড়ানো মানুষদের জীবনের গল্প প্রায় একই। একবার এ পথে ঢুকলে বের হবার পথটি খুবই কঠিন ও ভয়ঙ্কর। একটা সময় অন্ধকার পথের সব মানুষই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়, বদলে যেতে চায়। শুধু এই সমাজে আমাদের মাঝে প্রয়োজন বদলে দেবার মতো একজন মোহসীন-উল হাকিম।’
সুন্দরবনের দস্যুদের মাধ্যমে লাভবান হয় সমাজের এক শ্রেণির মানুষ। উপকূলীয় অঞ্চলের বেশ কিছু প্রভাবশালী মানুষ নানা ভাবে তাদের সহযোগিতা করে। বিশেষ করে যারা অস্ত্র সরবরাহ করে, দস্যুতা করতে ট্রলারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম সরবরাহ করে, দস্যুদের বাজার সরবরাহ করে। তাদের তালিকা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নতুন নতুন বাহিনীগুলোকেও তারাই ইন্ধন দিচ্ছে। তাদের ধরে আইনী ব্যবস্থা নেয়া না হলে আবারও ছোট ছোট বাহিনীগুলো বড় বাহিনীতে পরিণত হতে পারে।
যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মোহসীন-উল হাকিম টেলিফোনে নিউইয়র্ক মেইলকে বলেন, ‘আমি সব সময় মাথায় রেখেছি আমি একজন সাংবাদিক। রিপোর্টিংয়ের মুল টার্গেটই থাকে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আর এটাই আমাকে পথ দেখিয়েছে। পেশাগত কাজের পাশপাশি আমি দেশের একজন সাধারণ সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করেছি। তাদের কারণে সাধারণ মানুষের আতংক, ক্ষতি, কষ্ট এবং অসহায় জীবন যাপনের কথা তুলে ধরেছি জলদস্যুদের কাছে’।
তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকতা করার কারণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথেও আমি কথা বলতে পেরেছি আবার জলদস্যুরা আমাকে বিশ্বাস করেছে। সাধারণ মানুষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর জলদস্যু সবপক্ষেরই আস্থা অর্জন করতে পেরেছি বলেই এ কাজটি করা সম্ভব হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে মোহসীন বলেন, ‘বহু চেষ্টার পরও সুন্দরবনের জলদস্যুদের দমন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হতো তাদের আত্মসমর্পনের মধ্যস্ততা করতে। একজন সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত কাজের বাইরে এ কাজটি করতে আমি করতে পারায় উপকূলে সন্ত্রাস বন্ধ হয়েছে। সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পেরেছি। সত্যিকারের সাংবাদিকতার জয় হয়েছে’।
র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, আত্মসমর্পনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চেয়ে সন্ত্রাসিরা একটি নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্থ মাধ্যম খোঁজে। সেক্ষেত্রে একজন সাংবাদিক হিসেবে মোহসীন-উল হাকিম যা করেছেন দেশের ইতিহাসে তা একটি উদাহরণ। আমরা সবসময় এ ধরনের কাজে যে কোনো মানুষকে স্বাগতম জানাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘আগামীতেও এ ধরনের কর্মকা-ে যারাই এগিয়ে আসতে চায় র্যাবের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদানে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।’ সন্ত্রাস নির্মূলে সবাইকে মোহসীন-উল হাকিমের মতো এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল টেলিফোনে নিউইয়র্ক মেইলকে বলেন, ‘জলদস্যুদের আমরা দমন করতে সক্ষম হয়েছি। ‘এক্ষেত্রে র্যাব ও অন্যান্য বাহিনীর পাশাপাশি সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিমের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। তার মধ্যস্থতার কারণে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে। এজন্য তাকে এবং যমুনা টিভিকে ধন্যবাদ জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, আত্মসমর্পণকারি জলদস্যুদের পুর্নবাসন করা হয়েছে। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপও নিয়েছে’।