যাচাই-বাছাইকৃত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত বলে অং সান সু চির দাবিকে, মিয়ানমার সরকারের ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা। আর নিরাপত্তা বিশ্লেষকর মতে, প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত করার অপকৌশল এটি। জেলা প্রশাসন বলছে, প্রত্যাবাসনে দেশটির সদিচ্ছার অভাব থাকলেও বাংলাদেশ প্রস্তুত।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে ৮ মাস পর কক্সবাজারে আসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দল। তারা নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গা ও উখিয়ার কুতুপালংস্থ ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের কথা শুনেন। এরপর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পর সোমবার মিয়ানমারে যায় প্রতিনিধি দলটি।
পরে গতকাল মঙ্গলবার নাইপিদোতে দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠকে বসেন তারা। রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরুর পর জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিয়ানমারের নেত্রীর এটাই প্রথম বৈঠক। বৈঠকের পর যাচাই-বাছাইকৃত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত বলে দাবি করেন অং সান সু চি। তবে রোহিঙ্গাদের মতে, এটি মিয়ানমার সরকারের ষড়যন্ত্র। আর স্থানীয়রা এটাকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাব বলছেন।
উখিয়ার মধুরছড়া ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গা রহিম উদ্দিন বলেন, ‘‘আমরা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক। কিন্তু মিয়ানমার সরকার আমাদের মেনে নিচ্ছে না। আমরা মিয়ানমারে যেতে আগ্রহী।’’
আরেক রোহিঙ্গা ছুরত আলম বলেন, ‘‘মিয়ানমার আমাদের না নেয়ার জন্য যত ধরনের চলচাতুরী আছে; সব করে যাচ্ছে। এদের কথা আর কাজে কোন ধরণের মিল নেই। কিন্তু তারপরও আমরা নিজদেশে ফিরতে চায়।”
উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা অধ্যাপক হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে পুরোপুরি মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে তাদের কর্মকান্ডের কারণে। তারা একটা না একটা তালবাহানা করেই চলেছে।”
নিরাপত্তা বিশ্লেষকর মতে, এমন বক্তব্য প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত করার একটি অপকৌশল। একই অভিমত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের এ নেতারাও।
মিয়ানমানের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির বক্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করার অপকৌশল বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, সুচি পুরোপুরি সামরিক বাহিনীর চাপের মধ্যে আছে। সামরিক বাহিনীর কৌশল হচ্ছে রোহিঙ্গাদের উপলক্ষ করে ধর্মীয় উগ্রবাদী সৃষ্টি করা। পুরো একটা জাতিগোষ্ঠীর ১১ লাখ মানুষকে রাতারাতি পার করে দেয়া। তার মানে এটা পরিকল্পনা করে করা হয়েছে। যে কারণে করা হয়েছে তা এখনো বর্তমান। তাদের তাড়াতাড়ি ফেরত নিয়ে যাওয়া হবে না। বিলম্ব হবে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহামুদুল হক চৌধুরী বলেন, “রোহিঙ্গারা যেভাবে হাজারে হাজারে বাংলাদেশে এসেছে; সেভাবে যদি তাদের ফেরত নেয়া হয় তাহলে আমরা মনে করতে পারি মিয়ানমার সত্যিকার অর্থে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আগ্রহী। তা নাহলে অন্যথায় আমরা বলতে পারি এটা মিয়ানমারের কূটকৌশল, সময়ক্ষেপন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার কোন ইচ্ছে তাদের নেই।”
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাব থাকলেও বাংলাদেশ প্রত্যাবাসনে পুরোপুরি প্রস্তুত। কারণ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের নেতৃত্ব একটি টিম রোহিঙ্গাদের পরিবার ভিত্তিক যাচাই-বাছাই কাজ করছে। ফলে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের দিক থেকে কোন ঘাটতি নেই।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে গত বছরের ২৫শে অগাস্টের পর বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয় ৭ লাখ রোহিঙ্গা। এখন নতুন-পুরানো সবমিলে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ১১ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।
নিউইয়র্ক মেইল/কক্সবাজার/২ মে ২০১৮/এসআর/এইচএম