মানুষ কিছু সহজাত বৃত্তি নিয়েই জন্ম গ্রহণ করেছে। এই বৃত্তিগুলো স্বাভাবিক, অপরিহার্য ও চিরন্তন। মানুষ কথা বলতে পারে, গাইতে পারে, চিন্তাভাবনা করতে পারে, এইগুলো সহজাতভাবে সৃষ্টি বলা যায়। এই বৃত্তিগুলো মানুষের কৃত্তিম সৃষ্টি নয়, এগুলো প্রকৃতির সৃষ্টি, তাই মানুষ এগুলো নষ্ট করলে সে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যায়। এই বৃত্তিগুলোর সংরক্ষণ ও বিকাশ মানুষের অবিচ্ছেদ্য অধিকার।
যেসব দেশে লিখিত সংবিধান আছে সেই সব দেশে কতিপয় অধিকার সংবিধানে বর্ণিত থাকে এবং সংবিধানে ঘোষণা দেয়া হয় যে এই সমস্ত অধিকার সাধারণভাবে অপরিবর্তনীয় এবং মৌলিক। আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এই সকল অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে পরিচিত হয়। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘে মানবাধিকার সার্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। তারই অনুকরণে পরবর্তিতে বহু দেশ তাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকার সন্নিবেশ করে।
মানবাধিকার: মানবাধিকার হল মানব অস্তিত ও পারস্পরিক সহ-অবস্থানের ভিত্তি। মানবাধিকার সর্বজনীন, অভিভাজ্য ও পরস্পর সম্পর্কিত এবং এটি মানুষের অধিকার। মানুষের জীবনে সঙ্গে মানবাধিকার অবিচ্ছেদ্য ভাবে সম্পর্কযুক্ত। মানবাধিকার মানুষের জন্য প্রযোজ্য অধিকারবলে মানুষের মধ্যেই এর কার্যকারিতা বিদ্যমান। মানুষই এই অধিকারকে সংরক্ষণ করে, লালন করে, অব্যাহত রাখে, প্রাণময় করে তোলে। এটি মানব অস্তিতের সঙ্গে জড়িত এবং মানুষের জন্য অপরিহার্য। সমগ্র পৃথিবীর সর্বস্থান ও সব কালের সকল মানুষের প্রাপ্য অধিকার হল মানবাধিকার। এই অধিকারগুলো কেউ কাউকে দেয় না, এর প্রাপ্তি কারও করুনার ওপর নির্ভর করে না। এটি মানুষের জন্মগত অধিকার।
মানবাধিকার ও সাংবাদিকতা বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত বিষয়। মানবাধিকার সম্পর্কিত বিষয়াবলী সাংবাদিকরা গণমাধ্যমে যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে তাদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন করে তুলে। আমাদের দেশে নারী, শিশু, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, অসহায় মানুষদের মানবাধিকার সুরক্ষায় সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশংসনীয়।
মানবাধিকার সুরক্ষা কিংবা লংঘনের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের ভূমিকা কোন অধিকারের উপর স্থাপিত সেদিকে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় আইন দুটোই বিদ্যমান। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত মানবাধিকার সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ধারা-১৯ বলা আছে, ‘প্রত্যেকেরেই মতামতের ও মতামত প্রকাশের স্বাধিকার রয়েছে, বিনা হস্তক্ষেপে মতামত পোষণ এবং যে কোনো উপায়াদির মাধ্যমে ও রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে তথ্য ও মতামত সন্ধান, গ্রহণ ও জ্ঞাত করার স্বাধীনতা এই অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
এবার দৃষ্টি ফেরা যাক আমাদের নিজস্ব আইনের দিকে। দেশের সর্বোচ্চ আইন তথা সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার অংশে ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। অনুচ্ছেদটিতে বলা হয়েছে- (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব-প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।
আর তাই রাষ্ট্র তার নাগরিকদের এই মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ২০০৮ সালে ‘তথ্য অধিকার অধ্যাদেশ ২০০৮’ নামে একটি আইন তৈরি করে। এই আইনের উদ্দেশ্যই হল, সরকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার নিকট থেকে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার থাকবে এবং কোন নাগরিকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে সে তথ্য সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবে। এই আইন করার ফলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জায়গাটি বড় হয়েছে নিঃসন্দেহে। সঠিক সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা এবং মানবাধিকার সুরক্ষার স্বার্থে এই আইন বেশী কাজে লাগাতে পারছেন সাংবাদিকরা। এখন সংশ্লিষ্ট সংবাদ তৈরির জন্য সাংবাদিকরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য সহায়তা পাচ্ছেন সহজে। প্রকৃতপক্ষে সংবাদটি প্রকাশিত হলে উপকৃত হচ্ছেন রাষ্ট্রের নাগরিকরাই। তাই এটা খুব স্পষ্ট, মানবাধিকার সুরক্ষায় সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমের ভূমিকা অনন্য।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।