logo
আপডেট : 4 May, 2018 00:21
বাংলাদেশে ফ্রি-ট্রেড জোন প্রতিষ্ঠা জরুরি
সৈয়দ আবুল হোসেন

বাংলাদেশে ফ্রি-ট্রেড জোন প্রতিষ্ঠা জরুরি

আমি বোয়া ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ)’র ইনিসিয়াল ফাউন্ডার মেম্বার ও বাংলাদেশের প্রধান প্রতিনিধি। বিগত ৮-১১ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত বিএফএ’র বার্ষিক সম্মেলনে আমি অংশগ্রহণ করেছি। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও এশিয়ার অনেক রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ ও তাদের প্রতিনিধি এ বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। চীনের হাইনান প্রদেশের বোয়া সিটিতে চার দিনব্যাপী এ সম্মেলন ছিল- এশিয়ার উন্নয়নে এক দিকনির্দেশনা ও নতুন নতুন উদ্ভাবনীমূলক কর্মসূচী গ্রহণে ঐক্যমত্য, যা এশিয়াসহ বিশ্ব উন্নয়নের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এক সেমিনারে অংশ নিয়ে এশিয়ার দেশগুলোর উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি গ্লোবাল উন্নয়নের কথা বলেন। এশিয়া ও গ্লোবাল উন্নয়নে চীনের অঙ্গীকারের কথা পুর্নব্যক্ত করেন। তিনি বিশ্ব-বাণিজ্যের সংরক্ষন নীতির ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার কথা বলেন। অর্থনৈতিক গ্লোবালাইজেশনে চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার ও অর্থনৈতিক উদারিকরণ নীতির কথা বলেন। তিনি বলেন, সবাই পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এশিয়াসহ সারা বিশ্বের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।

প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং হাইনান প্রদেশের বোয়ায় একটি ফ্রি-ট্রেড জোন গঠনের উদ্যোগের কথাও জানান। বিশ্বনেতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমাদের শেষ সাক্ষাতের পর অনেকদিন কেটে গেছে। এখান থেকে বিদায়ের আগ পর্যন্ত আমরা একটা বড় সময় একত্রে কাটাতে পারবো। চায়না প্রবাদ আছে- মাটির সমন্বয়ে পর্বতের সৃষ্টি। পানির সমন্বয়ে সমুদ্র সৃষ্টি। কিন্তু মানুষের সুখ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যত এমনি হয় না। একবিন্দু পানির মধ্যে যেমন সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করি, তেমনি বিভিন্ন এলাকার উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয় সে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে। অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্মুক্ত নীতি চায়নার দ্বিতীয় বিপ্লব। এ দ্বিতীয় বিপ্লব শুধু চায়নার নিজস্ব উন্নয়ন নয়, এ উন্নয়নের আবর্তিত ফলাফলে প্রভূত উপকৃত হবে সারা বিশ্ব। চায়নার অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্মুক্ত নীতি হবে সফলতার স্মারক। আমি দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে চাই, চীন তার অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্মুক্ত নীতি পরিত্যাগ করবে না এবং এ নীতি উন্মুক্ত থাকবে এবং ক্রমান্বয়ে এর পরিধি বাড়বে। আমি মনে করি, বিনিয়োগ পরিবেশ হবে স্বচ্ছ বাতাসের মতো এবং একমাত্র বিশুদ্ধ বাতাসই অধিকতর বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবে। যারা সংস্কার নীতি ও নতুন উদ্ভাবনী কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করবে তারা পেছনে পড়ে থাকবে এবং তারা ইতিহাসের আস্তাখুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। শান্তি ও উন্নয়ন- সারা বিশ্বের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিভূ। স্নায়ুযুদ্ধ ও একলাচলা নীতি এখন অচল। অন্যকে দাবিয়ে রাখা, অধিকার- বঞ্চিত করা- এখন আর সম্ভব নয়। চায়নার  কোনো ভূ-রাজনীতিক নীতি নেই। চায়না ব্যবসা-বাণিজ্যে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা আরোপ করে না। চায়না নিজস্ব উন্নয়নসহ সামগ্রিকভাবে বিশ্ব উন্নয়নে অবদান রাখতে অঙ্গিকারাবদ্ধ এবং সে লক্ষ্য অর্জনে আমরা কাজ করে চলেছি।

প্রসঙ্গত, ২০২৫ সালের মধ্যে হাইনান প্রদেশে একটি পরিপূর্ণ ফ্রি-ট্রেড জোন স্থাপনে চীন প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। এখানে যে কোন বিদেশি বিনিয়োগ করতে পারবে। বিদেশি কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি এবং যাদের পেশাগত দক্ষতা রয়েছে- তারা হাইনানের উন্নয়নসহ বিশ্ব উন্নয়নে কাজ করতে পারবে এবং হাইনানের স্থায়ী রেসিডেন্টের জন্য আবেদন করতে পারবে। এসব পদক্ষেপ চীনসহ বিশ্বের উন্নয়নে চায়নার উদারীকরণ নীতির প্রতিফলন।

চীনের প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের আলোকে অন্য এক সেসনে চীনের অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা চীনের উন্নয়নে বোয়ায় ফ্রি-ট্রেড জোন গঠনের নানা দিক তুলে ধরেন। তারা মনে করেন, অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি ও বোয়ায় ফ্রি-ট্রেড জোন- চীনে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবে। পর্যটকদের আগমন বাড়াবে। চীনের উন্নয়নে গতি সঞ্চার করবে। বিশ্ব-অর্থনীতিও এর মাধ্যমে উপকৃত হবে। দেশে দেশে বাণিজ্যের অন্তরায়গুলো এর ফলে কমে আসবে। পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হবে। সর্বোপরি, বিশ্ব-অর্থনীতির অগ্রগতি তরান্বিত হবে।

এশিয়া ও বিশ্ব-ভৌগোলিক আবহে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পরিকল্পনা হলো- ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে বাংলাদেশকে উন্নীত করা। এলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছেন। বোয়া ফোরাম ফর এশিয়ার নেতৃবৃন্দের আলোচনা প্রেক্ষিতে, আমি মনে করি, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ‘ফ্রি-ট্রেড জোন’ গঠন করা জরুরি। এ ধরনের ফ্রি-ট্রেড জোন প্রতিষ্ঠা করে ইতোমধ্যে দুবাই সফল হয়েছে। ফ্রি-ট্রেড জোন হলো- একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, যেখানে কর রেয়াত ও কাস্টম ডিউটিমুক্তসহ নানা উৎসাহমূলক প্রণোদনা দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করা। দুবাইতে ৩০টির বেশি ফ্রি-ট্রেড জোন রয়েছে। এজন্য আমিরাত সরকার বিশেষ আইনি কাঠামো ও কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যবসার ১০০% মালিকানা, কর ও শুল্ক রেয়াত ব্যবস্থা, সম্পদের মালিকানা প্রদান, ব্যবসার গোপনীয়তা রক্ষার গ্যারান্টি, ব্যাংক হিসাব খোলার অধিকার ও গোপনীয়তার সুরক্ষা প্রদান, একাধিক ব্যবসায় বিনিয়োগের অবাধ সুযোগ প্রদান এবং ইচ্ছে মাফিক ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার অধিকার প্রদান করেছে। এই ফ্রি-ট্রেড জোন দুবাইসহ আমিরাতের উন্নয়নে এক অনন্য রোলমডেল। যে কোন দেশ এ মডেল গ্রহণ করে লাভবান হতে পারে। উন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও চীন এ অবাধ ফ্রি-ট্রেড নীতি হাইনান প্রদেশের বোয়া-তে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে।

আমার জানা মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৮টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন আছে যা এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট সময়ে মধ্যম আয়ের দেশ ও উন্নত দেশে উন্নীত করতে হলে দুবাই ও চীনের বোয়ার আদলে বাংলাদেশে ফ্রি-ট্রেড জোন প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। এই ‘ফ্রি-ট্রেড জোন’ বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার যাবতীয় উপাদান বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যমান। পণ্য চলাচলে বাংলাদেশের রয়েছে সামদ্রিক বন্দর ও এয়ার রুট। আমাদের পণ্যের রয়েছে ইউরোপসহ বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে শুল্কমুক্ত ও কোটা ফ্রি প্রবেশাধিকার। আকর্ষণীয় ব্যবসা ও বিনিয়োগের সুন্দর পরিবেশ। রয়েছে ১৬৪ মিলিয়ন অধ্যুষিত জনসংখ্যার দেশের পন্যের বাজার। আমাদের আছে দক্ষ যুবশক্তি। আমাদের রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, পানি ও উর্বর ভূমি। আমরা যদি বাংলাদেশের সুবিধাজনক জায়গায় ‘ফ্রি-ট্রেড জোন’ গঠনে হুবহু দুবাইয়ের নীতি গ্রহণ করি, বোয়ার উদ্যোগকে ধারণ করি, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নপূরণে, উন্নত বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন কার্যক্রম তরান্বিত হবে।

এজন্য আমার প্রস্তাব: পদ্মার দক্ষিণ পাড়- মাদারীপুর ও শরিয়তপুরের যে কোন উপযুক্ত জায়গা, এটা শিবচর বা পদ্মা নদী সংলগ্ন যে কোন স্থান ও খেপুপাড়ার পায়রা বন্দর এলাকা হতে পারে। উপযুক্ত জায়গা চিহ্নিত করে মাদারীপুর-শরিয়তপুর ও খেপুপাড়ায় আলাদা দুইটি ফ্রি-ট্রেড জোন প্রতিষ্ঠা করা যায়। ফ্রি-ট্রেড জোনের সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য পদ্মার তীরে একটি কন্টেনার পোর্টও নির্মাণ করতে হবে।

বৈশ্বিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে লক্ষণীয় যে, ফ্রি-ট্রেড জোন গঠনের মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে আমিরাতের দুবাই সফল হয়েছে। উন্নত দেশ চীনও হাইনান প্রদেশের বোয়ায় ফ্রি-ট্রেড জোন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা জানি, ব্যবসা-বাণিজ্যে সিংগাপুর সফলতা অর্জন করেছে। কৃষিতে চীন ও থাইল্যান্ড সুনাম অর্জন করেছে। ব্যাংকিং এ সুইজারল্যান্ড আজ সুপরিচিত দেশ। গবেষণা ছাড়াই বাংলাদেশ এসব দেশের প্রযুক্তি ও পরিকল্পনা এবং কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। আমরা ইতোমধ্যে কৃষিসহ অর্থনীতির বিভিন্ন নির্নায়কে অগ্রগতি লাভ করেছি। বাংলাদেশ ফ্রি-ট্রেড জোন প্রতিষ্ঠা, বাণিজ্য, কৃষি ও ব্যাংকিং এর ক্ষেত্রে হুবহু দুবাই, সিঙ্গাপুর, চীন ও থাইল্যান্ড এবং সুইজারল্যান্ডের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু প্রয়োজন সমন্বয়। প্রশাসনে মেধাবীদের সম্পৃক্তকরণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগে বিশেষ সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা।

 

লেখক: সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী