
বিশ্বব্যাপী মানবিক সংকট সমাধানে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রত্যয় নিয়ে শেষ হলো ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) ৪৫তম পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গতকাল শনিবার ও আজ রোববার এ সম্মেলন হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। ওআইসিভুক্ত ৫৭টি দেশের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সম্মেলনে অংশ নেন।
এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘টেকসই শান্তি, সংহতি ও উন্নয়নের জন্য ইসলামী মূল্যবোধ’। ওআইসির সব সদস্য রাষ্ট্র, পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র, ওআইসি প্রতিষ্ঠানসমূহ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানসহ ছয় শতাধিক প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশ নেন। এদের মধ্যে প্রায় ৪০ জন মন্ত্রী ও সহকারী মন্ত্রী।
সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী মানবিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সংকট দূর করতে এবং এই খাতগুলোর উন্নয়নে কমপক্ষে ১২০টি প্রস্তাব পাস করা হয়। যার মধ্যে রোহিঙ্গা সংকট, প্যালেস্টাইন ইস্যু, সিরিয়া পরিস্থিতি, ওআইসির সংস্কার, নারী ও যুব সম্প্রদায়ের উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য।
সম্মেলনের ফাঁকে বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রায় ৪০টি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়।
এবারের সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড অংশ নেন।
ঢাকায় এসেই ওআইসির সদস্যভুক্ত দেশের প্রতিনিধিরা গত শুক্রবার সকালে কক্সবাজারের একাধিক শিবির পরিদর্শন করেন। সেখানে তারা সরেজমিনে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে এই সংকট সমাধানে জাতিসংঘকে আরো জোরাল ভূমিকা রাখার আবেদন জানান।
মুসলিম বিশ্বের সংঘাত ও চ্যালেঞ্জসমূহ, আন্তর্জাতিক ইস্যু, দেশে দেশে মুসলমানরা যে ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলোর সমাধান, মুসলিম উম্মাহর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, ওআইসি দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং সাংস্কৃতিক বিষয়সহ বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতার ক্ষেত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয় এ সম্মেলনে।
সম্মেলনে বাংলাদেশের যত প্রস্তাবনা :
আগামীতে ভারতকে ওআইসির পর্যবেক্ষক হিসেবে রাখতে সম্মেলনে প্রস্তাব রাখে বাংলাদেশ। এছাড়া সম্মেলনের আয়োজক দেশ হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রোববার এক বার্তায় জানানো হয়, সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চারটি নতুন প্রস্তাব দেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছে- আঞ্চলিক উন্নয়নে আরো সংযোগ বাড়ানো, টেসকই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গণমাধ্যম খাতের উন্নয়ন, ওআইসির সংস্কার (তুরস্কের সঙ্গে যৌথভাবে) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওআইসি চেয়ার সৃষ্টি করা।
এদিকে, সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার (৫ মে) রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে বলেন। এছাড়া এই সংকট সমাধানে মিয়ানমারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে বিশ্ববাসীর কাছে আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট বিষয় প্রস্তাব করেন। এগুলো হচ্ছে- ইসলামের মূল বিশ্বাসের ওপর আস্থা রাখা। শান্তিপূর্ণভাবে দেশে দেশে চলমান সংঘর্ষের অবসান ঘটানো। স্বীয় চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলা, যাতে আলোকিত জীবনযাপন করা যায়। দারিদ্র্য এবং মানবিক সংকট দুর করতে উন্নয়ন নিশ্চিত করা। ইসলামি মূল্যবোধকে জাগিয়ে তোলা, যাতে শান্তি, ন্যায়বিচার ও সমতা নিশ্চিত করা যায়।
রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন ইস্যুতে মন্ত্রিপরিষদ কমিটি গঠন:
সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকটের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন ইস্যুতে একটি মন্ত্রিপরিষদ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে ওআইসি। রোববার ওআইসি সম্মেলনে রোহিঙ্গাবিষয়ক বিশেষ সেশনে এ প্রস্তাব করা হয়। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এই বিশেষ কর্মঅধিবেশন হয়। পরে কমিটি গঠনের প্রস্তাবটি পাস করা হয়।
এ বিশেষ সেশনে গাম্বিয়ার প্রস্তাবিত গোয়েন্দাবিষয়ক একটি রেজ্যুলেশনের সংশোধনও চায় বাংলাদেশ। ওই রেজ্যুলেশনে বলা আছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের দায়বদ্ধতার জন্য ওআইসির অ্যাডহক মন্ত্রী পর্যায়ের একটি কমিটি কাজ করবে। বাংলাদেশ অপরাধের পরিবর্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন শব্দটির প্রতিস্থাপন করার সংশোধনী চেয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এই সংশোধনীর প্রস্তাব করেন।
মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান:
মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চলছে, তাতে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় রোধে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন ওআইসি মহাসচিব ইউসেফ বিন আহমদ আল-ওথাইমি। রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশের পাশে এগিয়ে আসতে হবে বলেও জানান তিনি।
রোববার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা ওআইসির ৪৫তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের শেষ দিনে এ কথা বলেন ওআইসি মহাসচিব।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বের এই বিশেষ সেশনে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত বব রে, জাতিসংঘের অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল রশিদ খালিকভ, ওআইসির ইনডিপেনডেন্ট হিউম্যান রাইটস কমিশনের সভাপতি, আরাকান ইউনিয়নের পক্ষে ড. ওয়াকার উদ্দিন বক্তব্য রাখেন।
এরপর উন্মুক্ত আলোচনায় ইরাক, মিসর, তুরস্ক, কাজাখস্তান, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, উগান্ডা, জিবুতি ও সুদানের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।
এবারের সম্মেলনে সর্বাধিক সদস্য দেশের অংশগ্রহণ:
সম্মেলন শেষে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৫তম সম্মেলন সফলভাবে শেষ হয়েছে। এর আগে ওআইসির সম্মেলনগুলোতে একই সঙ্গে এতো দেশ অংশগ্রহণ করেনি। কারণ, এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্ক টানেপোড়েন থাকায় তখন সেটি হয়নি। যা বংলাদেশের বেলায় সম্ভব হয়েছে।
শাহরিয়ার আলম আরো বলেন, বাংলাদেশে এ সম্মেলন হওয়াটা আমাদের জন্য বড় অর্জন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ওআইসির সংস্কারে তুরস্কের সঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ। এতে তুরস্ক নেতৃত্ব দেবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামীতে ভারতকে ওআইসির পর্যবেক্ষক হিসেবে রাখতে প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ। যেহেতু ওআইসি এখন শুধু মুসলিম দেশগুলোর মধ্যই আবদ্ধ নয়। ওআইসি এখন মুসলিম বিশ্বের সহযোগী হয়ে কাজ করছে। অনেক মুসলিম দেশের থেকেও বেশি সংখ্যক মুসলমান ভারত, কানাডা এবং যুক্তরাজ্যে বসবাস করছে।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে হয় এই সম্মেলন। গতকাল শনিবার সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ সংকট সমাধানে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রত্যয়ে ঢাকা ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই সম্মেলনের পর্দা নামে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ২৫ বছর পর ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এই সম্মেলনের আয়োজন করে। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারের সময়ে ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ১৪তম সম্মেলন হয়।
সূত্র: রাইজিংবিডি ডটকম