ঢাকায় কেনাকাটার জন্য খুবই জনপ্রিয় চাঁদনী চক, গাউসিয়া ও নিউমার্কেট এলাকা।
সেখানে গেলে সবচেয়ে প্রথমেই চোখে পড়বে প্রবেশপথে ও রাস্তার দুই ধারে ভিড় করে থাকা হকার ও ক্রেতাদের।
ক্রেতা-বিক্রেতাদের দরকষাকষি, কথাকাটাকাটি, এসব কিছুই ঢাকার মার্কেটগুলোর অনুষঙ্গ।
বেশির ভাগ পুরনো মার্কেটের বাইরেই এমন দৃশ্য। এই ভিড় ঠেলে ভেতরে যেতে অনেক বেগ পেতে হয়।
ভেতরে গেলে দেখা যাবে প্রতিটি দোকানে ও গলিতে কাপড় দিয়ে ঠাসাঠাসি অবস্থা।
কাপড়গুলোর নিচে রয়েছে বিদ্যুতের তার। হাঁটার গলিগুলো খুবই সরু।
সেই সরু গলিতেই ঝোলানো বা স্তূপ করে রাখা অসংখ্য কাপড়।
হাঁটার পথ আটকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের কথাবার্তা চলছে।
একটু পরপর কারো সঙ্গে ধাক্কা লাগবে। অর্থাৎ পদে পদে বাধা। এখানে কিছু ঘটে গেলে পালানোর পথ নেই। বের হওয়ার জায়গা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছানোর আগেই সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।
চাঁদনী চকের একজন বিক্রেতা বলার চেষ্টা করছিলেন, আমাদের সব তলাতেই আগুন নেভানোর ফায়ার-এক্সটিংগুইশার রয়েছে,
কিন্তু তা চোখে পড়ল না। আগুন নেভানোর এই ফায়ার-এক্সটিংগুইশার আনতে যত সময় লাগবে ততক্ষণ কী করবেন, সেটির কোনো উত্তর তারা দিতে পারলেন না।
এটি ব্যবহার করতে জানেন কিনা সেটি দোকানিদের জিজ্ঞেস করা হলে তাদের প্রত্যেকে বললেন, না।
কিন্তু কিছু ঘটে গেলে এই দোকানিদের কতটা প্রশিক্ষণ আছে। সেটির উত্তরও এলো, না।
ঢাকার গুলশানে গত বছরের জানুয়ারি মাসে সিটি কর্পোরেশন মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ২০১৭ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত রাজধানীর ১৩০০ পাঁচটি শপিংমল ও মার্কেটে জরিপ চালিয়েছে।
তাদের হিসেবে এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি ছাড়া বাকি সবই অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে।
ছয় শতাধিক রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। ঢাকার মার্কেটগুলোতে নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণী ব্যবস্থা। নেই ফায়ার ড্রিলের ব্যবস্থা।
দামি শপিংমল বা পুরনো চাঁদনী চক, গাউসিয়া বা মৌচাক, ঢাকার কোনো মার্কেটেই এর প্রচলন নেই।
কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতা কাউকেই তেমন একটা চিন্তিত মনে হলো না।
একজন হাসতে হাসতে বললেন, কখনো তো কিছু হয়নি। আমরা তো সব সময় এখানে আসি।
তবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে অপারেশন্স অংশের পরিচালক মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলছিলেন, অনেক বিষয় বিবেচনা করে তারা ঢাকার মার্কেটগুলোর ঝুঁকি নির্ধারণ করছেন এবং পরিস্থিতি ঢাকার নতুন-পুরনো সব মার্কেটের জন্যই ভীতিকর।
তিনি বলেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে এক্সিট নেই। মানুষজন আগুন থেকে বাঁচার উপায় কিছু জানে না। নিয়মিত ফায়ার ড্রিল হয় না। ফায়ার-এক্সটিংগুইশার আছে কিন্তু কেউ তা কেউ চালাতে জানেন না। মার্কেটে আগুন নেভাতে পানির ব্যবস্থা নেই। মার্কেটে ঢোকার পথ সরু। সিঁড়ির ছাদ পর্যন্ত যাওয়ার কথা কিন্তু তা একটা জায়গা পর্যন্ত দিয়ে শেষ হয়ে গেছে। ছাদে গিয়ে দেখা যাচ্ছে অন্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব কিছু বিবেচনা করে আমরা ঝুঁকি নির্ধারণ করেছি।
তিনি আরও বলছেন, ট্রান্সফরমার, জেনারেটর, বিদ্যুতের সাবস্টেশন সব এক জায়গায় করা। এগুলোর একটায় আগুন লাগবে সব পুড়ে যাবে। তাতে আগুন নেভানো যন্ত্রপাতি তো কাজ করা বন্ধ হয়ে যাবে। ফায়ার অ্যালার্ম বাজবে না।
তিনি বলছেন, বিভিন্ন মার্কেট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও হয়েছে।
মার্কেট কর্তৃপক্ষ কতটা উদ্যোগ নিয়েছে? এই প্রশ্ন রেখেছিলাম চাঁদনী চক বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমানের কাছে। তিনি বলেন, আমাদের মার্কেট অনেক পুরনো। নেভানোর জন্য যে ব্যবস্থা নেই সেটা সত্যি। তবে ফায়ার ডিপার্টমেন্ট আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর আমরা এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করে নিরাপত্তা বিধানে সক্ষম হয়েছি। এর আগে যে দু-একবার দুর্ঘটনা হয়েছিল তারপর থেকে আমরা নিজস্ব বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি।
কিন্তু প্রতিটা দোকানে একটি করে এই যন্ত্র রাখার নিয়ম বা দোকানিদের প্রশিক্ষণ বা ফায়ার ড্রিলের ব্যাপারে কি করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে তারা কর্মসূচি নেবেন।
তবে সেই কর্মসূচি কবে শুরু হবে তা নিশ্চিত নয়। ঢাকায় শুধু আগুন নয়, মার্কেটগুলোর অন্যান্য নানাবিধ ঝুঁকিও রয়েছে। বিশেষ করে পুরনো মার্কেট ভবনগুলোর।
ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন ২৮টি মার্কেটও খুব দুর্বল অবস্থায় রয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ১৬টি মার্কেট ঝুঁকিতে রয়েছে।
উত্তরের পরিকল্পনা ও নকশা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হাসান মোহাম্মদ আল মাসুদকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই পরিস্থিতি কীভাবে হলো? আর তা নিরসনে কী করা হচ্ছে?
তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে লোড কমাতে হবে। আমাদের মার্কেটগুলো অনেক বেশি মালপত্র রাখে। গুদাম হিসেবে ব্যবহার করে। মানে ডিজাইনের অতিরিক্ত মাল রাখা হয়।
তিনি আরও বলেন, সমস্যা হচ্ছে বিল্ডিংগুলো অনেক পুরনো। বুয়েটের পরীক্ষার পর তারা বলেছিল, এগুলো টিকিয়ে রাখতে হলে ব্যাপক পরিমাণে মজবুতকরণ দরকার হবে। সে জন্য দোকানিদের অন্য কোথায় সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু দোকানিরা মনে করে এতে তাদের লোকসান হবে। ভেঙে নতুন ভবন করার ব্যাপারেও তারা ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা মনে করে।
আর সে জন্যই ঢাকায় পুরনো মার্কেট ভবনগুলো খালি করা নিয়ে রয়েছে বেশকিছু মামলা।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের হিসেবে এখন মোট ৮টি মামলা চলছে।
আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে অনেক সময় মার্কেটগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া পিছিয়ে গেছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো মৌচাক মার্কেট নিয়ে মামলা।
জরাজীর্ণ ভবনটি মজবুতকরণের মাধ্যমে ব্যবহার করা যাবে বলে আদালতের রায়ে বলা হয়েছে।
রাজউকের চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী বলছেন, ব্যবসায়ীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দোকানের জায়গা দীর্ঘদিনের জন্য পজিশন নিয়েছেন।
ভবনের মালিক রাজি হলেও অনেক সময় রাজি হচ্ছেন না দোকান মালিকেরা।
তিনি বলছেন, তারা সবাই চায় আমাদের সবাইকে পুনর্বাসিত করুক। তাদেরও তো এক জায়গায় বসতে হবে। পুনর্বাসন মানেই হলো টাকা। তবে সিটি কর্পোরেশন আর আমরা একসঙ্গে যোগাযোগ রেখে এনিয়ে কাজ করছি।
কিন্তু ঢাকার গাউসিয়া, চাঁদনী চকের মতো পুরনো জনপ্রিয় মার্কেটগুলোকে মজবুতকরণ করে টিকিয়ে রাখা কতটা সম্ভব?
জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আনসারীর কাছে।
তিনি বলছেন, রেট্রোফিটিং হলো যেমন ধরুন মূল কলাম আছে ১০ ইঞ্চি। আর ভবন আছে ছয়তলা। আমরা তখন মডেল করে দেখি, কলাম কত ইঞ্চি করলে ভবনটা ওজন সহ্য করতে পারবে, যা পর্যাপ্ত মনে হয় তখন সেই অনুযায়ী বাইরের আবরণে রড কংক্রিট দিয়ে মোটা করে দেই। এটা শুধু কলাম নয়, বিম ও মাটির ভিত্তির ক্ষেত্রেও করা যায়।
তিনি আরও বলছেন, ঢাকায় গাউসিয়াতে এই কাজ ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। আপনারা টেরও পাননি। আমরা রেট্রোফিটিং করে ঢাকার অনেক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ভবনকে তার পুরনো শক্তিতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছি।
ওদিকে ঢাকার মার্কেটগুলোতে উঁচু ভলিউমে গান, কেনাকাটা আর তার এক ফাঁকে খাওয়াদাওয়াও যেন আগের থেকে আরও অনেক বেশি জমে উঠেছে।
এমন পরিবেশে হঠাৎ করে কোন দুর্ঘটনার কথা হয়তো ক্রেতাদের মনেও পড়ে না।
কিন্তু বেশকিছু শপিংমল ও মার্কেট ভবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়াটা যে খুব জরুরি তা খালি চোখে দেখেই বোঝা যায়।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।