বর্ষা যতই ঘনিয়ে আসছে ততই উদ্বেগ বাড়ছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে। যাদের বসবাসের জন্য পাহাড় কেটেই তৈরি করা হয়েছে ঘর। যার ফলে পাহাড়ী ঢল ও ভূমিধসের ঝুঁকিতে রয়েছে দুই লাখ রোহিঙ্গা।

এরমধ্যে ‘চরম’ ঝুঁকিতে রয়েছে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। এই  প্রাকৃতিক বিপর্যয় এড়াতে না পারলে প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে। যেখানে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শিশুও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মিয়ানমার সেনাদের নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অবস্থান কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায়। এখন নতুন ও পুরনো সবমিলে ২০টি ব্লকে বসবাস করছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। যাদের বসবাসের জন্য পাহাড় কেটেই তৈরি করা হয়েছে ঘর।

সামনে বর্ষা মৌসুম। যতই দিন যাচ্ছে ততই বিপদ ঘনিয়ে আসছে রোহিঙ্গা পল্লীতে। অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে বসতি গড়ায়, এখানে নেই কোনো পানি প্রবাহের ব্যবস্থা। ফলে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে আতংকিত হয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।

ভূমিধ্বসের আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সঠিক তথ্য নিরূপনে সরকারের সাথে কাজ করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা।

পাহাড় ধসের ঝুঁকির সঠিক তথ্য বের করতে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করেন আমেরিকার বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ ম্যারিয়া তাসভা। তাঁর গবেষণায় উঠে এসেছে ২ লাখ রোহিঙ্গা পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে থাকলেও মূলত চরম বা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। যাদের যেকোন সময় প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। তাই সব ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গাদের বর্ষা মৌসুমের আগেই নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম জানান, পাহাড় ধসের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গাদের সরিয়ে সম্প্রসারিত কুতুপালং ক্যাম্পের পশ্চিমপাশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গা এখনো বুঝেনা পাহাড় ধসের ঝুঁকি কি? এরফলে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই প্রয়োজন তাদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা।

কুতুপালং মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা আবুল ফজল (৫৫) নিউইয়র্ক মেইলকে বলেন, বিভিন্ন সংস্থার লোকজন তাদেরকে বর্ষায় পাহাড় ধস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানাচ্ছেন। পাহাড় ধস হলে তারা কোথায় যাবে। দুর্যোগ থেকে মুক্তির কোন পদ্ধতি জানা নেই তাদের।

পাহাড় ধসে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে ব্যাপক তৎপরতা চলছে রোহিঙ্গা শিবিরে। সেখানে রোহিঙ্গাদের পাহাড় ধস এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুত করার জন্য সচেতনতা মূলক বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে।

উখিয়ার মধুরছড়া ক্যাম্প-৩ সংলগ্ন একটি সেন্টারে দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের জড়ো করে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় পাহাড় ধস এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় সচেতনতা এবং করণী নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। বেশ আগ্রহ নিয়ে নাটক উপভোগ করছে রোহিঙ্গারা। বিনোদনের মাধ্যমে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানোর কারণে দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা।

নাটক শেষে কথা হয় রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ’র (৩৩) সাথে। তিনি নিউইয়র্ক মেইলকে বলেন, তাদের জানা ছিল না, কিভাবে বর্ষার সময় পাহাড় ধসের ঝুঁকি এড়ানো যায়। এবং কিভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে। এই নাটক থেকে তারা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন।  

ওই সেন্টারে নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে ইউএনএইচসিআর এর পক্ষ থেকে। এই সংস্থার হেড অব কমিউনিকেশন ক্যারোলিন গ্লাক বলেন, বর্ষা মৌসুমে সম্ভাব্য ভূমিধ্বস সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কয়েকজন অভিনয় শিল্পী, শিল্পী এবং বাদক দল নিয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ধারাবাহিকভাবে নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, এর মূল ম্যাসেজ হলো বর্ষা মৌসুমে তারা কিভাবে তুলনামূলকভাবে ভাল থাকতে পারে সেই সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। কোন একটি বিষয়কে শক্তিশালী হিসেবে বোধগম্য করার জন্য নাটক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।  

রোহিঙ্গা শিবিরের সার্বিক বিষয় গুলো সমন্বয় করে যাচ্ছে ইন্টারসেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)। এই সংস্থার কমিউনিকেশন অফিসার নায়না বোস জানান, বর্ষা মৌসুমে যাতে কোন অবস্থাতে ভূমিধ্বস বা বন্যায় প্রাণহানি না ঘটে, সেজন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এখন আগামী বর্ষা মোকাবেলা করাই একমাত্র চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

নিউইয়র্ক মেইল/কক্সবাজার/২০ মে ২০১৮/এসআর/এইচএম