ফিলিস্তিনি কিশোরী উইসেল শেখ খালিল। খুবই সাধারণ একটি মেয়ে। গাজার রাস্তায় এক্কাদোক্কা খেলে বেড়াত। অঙ্ক ও নাচে দখল ছিল। ভালো ছবিও আঁকত।
সেই শান্ত কিশোরীই হঠাৎ করে ক্ষোভে ফেটে পড়ল। পরিবারের সদস্যরা অনেক বোঝাল। বলল সীমান্তে গেলে ইসরাইলি সেনারা গুলি করে মেরে ফেলবে।
কিন্তু কারও বারণ শোনেনি ১৪ বছরের এ কিশোরী। সোমবার সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ১১ বছরের ছোট ভাইকে নিয়ে বিক্ষোভ করতে চলে যায় সে।
সেখানে ইসরাইলি সেনাদের গুলি ও কাঁদানে গ্যাস উপেক্ষা করেই একেবারে সীমান্তে পৌঁছে যায় সে।
প্রথমে সে বিক্ষোভকারীদের পানির বোতল এগিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু ইসরাইলি সেনারা দমন-পীড়ন বাড়ালে ক্ষিপ্ত হয়ে যায় এ ফিলিস্তিনি কিশোরী।
একেবারে সীমান্ত লাগোয়া জায়গায় হাজির হয় সে। তার মাতৃভূমি ফিলিস্তিনকে দখল করে গড়ে তোলা ইসরাইলের কাঁটাতারের বেড়া কেটে ফেলতে চেষ্টা করে।
একপর্যায়ে ইসরাইলি সেনাদের স্নাইপার রাইফেলের নিশানায় পরিণত হয় সে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে কিশোরী উইসেল।
গত ৩০ মার্চ থেকে ইসরাইলের দখল করে নেয়া ঘরবাড়িতে ফিরতে ফিলিস্তিনিদের পদযাত্রা কর্মসূচি শুরু হয়েছে।
এ কর্মসূচির প্রথম দিনেই একের পর এক ফিলিস্তিনিকে গুলি করে ইসরাইল। তখন ১৮ জন নিহত ও কয়েকশ আহত হন। তবে উইসেল শুরু থেকেই এ কর্মসূচিতে যেতে রাজি ছিল না।
কিন্তু গত ১৪ মে ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিব থেকে পবিত্র জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরের দিন উইসেল আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি।
ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ পৃথিবী সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান ছিল না যার, সেই অসম সাহসী কিশোরীই ইসরাইলের নিপীড়নবিরোধী মিছিলে শামিল হয়ে যায়।
যা তাকে ইসরাইলি স্নাইপারদের নির্বিচার গুলিতে নিহতদের একজনে পরিণত করে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত ৩০ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত নিহত ১১০ জন।
ইসরাইলের অবরোধে গাজা উপত্যকার অর্থনৈতিক অবস্থা চরম দুর্দশায় চলে গেছে।
উপকূলীয় অঞ্চলে দারিদ্র্যের সর্বনিম্ন সীমার মধ্যে বাস করছে উইসেলের পরিবার। রাজনীতির সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ ছিল না।
একসময় ইহুদিবাদী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে ছোট্ট উইসেলের মন।
নিহত হওয়ার আগে সে জানিয়েছিল, এভাবে মুখ বুঝে আর ইসরাইলি বর্বরতা মেনে নেবে না সে। অবশ্যই অন্যদের সঙ্গে সীমান্তে গিয়ে বিক্ষোভ করবে।
এ কথা শুনে অন্য ভাইবোনরা উইসেলকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। সে যাতে বিক্ষোভে না যায়, তা বোঝাতে চেষ্টা করে। কারণ ইসরাইলি সেনারা নির্বিচারে সবাইকে গুলি করে হত্যা করছে।
পরিবারের বাধা কানেই তোলেনি উইসেল ও তার ১১ বছরের ছোট ভাই। ১৪ মে তারা বিক্ষোভে অংশ নেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিক্ষোভে যোগ দিতে গিয়ে তারা সীমান্তে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভেতর গিয়ে ইসরাইলি নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায়। তখনই ইসরাইলি স্নাইপারের গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে উইসেল।
এ ঘটনায় তার পুরো পরিবার শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সান্ত্বনাও খোঁজেন না তারা। কারণ তাদের মেয়ে নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে গিয়েছিল।
চাচি আনওয়ার বলেন, উইসেল এখন শহীদ। আমি প্রস্তুত। সে যা করে দেখিয়েছে, তাতে আমরা ভীত নই।
উইসেলের ছোট ভাই বলেছে, সোমবারে সীমান্তের বেড়া কাটতে গিয়েছিল তার বোন। তার হাতে একটা বেড়া কাটার যন্ত্রও ছিল।
অন্যরা জানান, উইসেল বিক্ষোভকারীদের পানি সরবরাহ করে দিত। এমনকি ইসরাইলের সেনাদের দিকে ছুড়তে সে পাথর নিয়ে এসে প্রতিবাদকারীদের হাতে দিত।
সোমবারের বিক্ষোভে নিহতদের তালিকায় উইসেল ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন পুরুষ।
কিন্তু গাজায় শিশুদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা বিরল কিছু নয়। প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটছে।
জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ জানিয়েছে, ফিলিস্তিনিদের বসতবাড়িতে ফেরার অধিকার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হলে এ পর্যন্ত এক হাজার শিশু আহত হয়েছে।
সেভ দ্য চিলড্রেন বলেছে, তাদের হিসাবে আড়াইশ শিশু ইসরাইলের তাজা গুলিতে বিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে।
আল বুরেইজ শরণার্থী শিবিরে উইসেলের পরিবারকে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতেই সময় পার করতে হচ্ছে। মাসহ তারা ছয় ভাইবোন একটি ছোট্ট কক্ষে বসবাস করত।
আবার ঠিক সময় ভাড়া শোধ করতে না পারলে তাদের সেই কক্ষে থেকে উচ্ছেদ করা হতো।
বন্ধুরা জানায়, উইসেলকে সবসময় রাস্তায় এক্কাদোক্কা খেলতে দেখা যেত। আর তার মায়ের ফোনে অডিও ভার্সন ডাউনলোড করে কোরআন শুনত।
সুযোগের অভাবে তার জন্য পড়াশোনা ছিল বেশ কষ্টের। কিন্তু সে অঙ্ক করতে ভালোবাসতো। সুযোগ পেলেই গণিতের বই নিয়ে বসে পড়ত।
অংকে পারদর্শিতা দেখে তার শিক্ষক তাকে বলেছিলেন, বড় হলে সে যেন এ বিষয়ের ওপর উচ্চশিক্ষা নেয়।
এ ছাড়া আঁকিবুকি ছিল তার শখের কাজ। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগেও নিজের নোটবইয়ে সে বেশ কয়েকটি ছবি এঁকেছিল।
উইসেলে ছবির আঁকার খাতা বের করে তার মা বলেন, সে ছিল আমার পরানের পরান। রাজনীতিতে অনাগ্রহী তার মেয়েটা বিক্ষোভে যোগ দেয়ার আগে তাকে বলে যায়, মা, আমি যদি মারা যাই, তবে আমাদের ছোট্ট কক্ষটিতে আমার ভাইবোনরা একটু আরামে থাকতে পারবে। তারা থাকতে একটু বেশি জায়গা পাবে।
জালে শত শত মাছ আটকে গেলে যেমন দেখায়, উইসেলরাও একটি কক্ষে সেভাবে গাদাগাদি করে থাকত।
তার বন্ধুরা জানিয়েছে, উইসেল ঠিক আর সবার মতো ছিল না। সে কখনও নাচ তো, কখনও গান গাইত। আবার কখনও বা সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত।
ইউনিসেফ বলেছে, গাজা উপত্যকার প্রতি চারটি শিশুর একটিকে মানসিক চিকিৎসা দেয়া দরকার।
গত এক দশকে ইসরাইল ও মিসরের অবরোধে গাজার অর্থনীতির পতন ঘটেছে। সেখানে ৪০ শতাংশ লোক বেকারত্বের মধ্যে রয়েছে। তাদের ঋণের বোঝা দিনে দিনে বাড়ছে।