লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিবেদনের কারণে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
যদিও গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে জীবন বাঁচাতে সাড়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তার পরও রাখাইনে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা।
অ্যামনেস্টি মিয়ানমারের সেনাদের পক্ষে যায় এমন প্রতিবেদন প্রকাশের পর এই অবশিষ্ট রোহিঙ্গারা নতুন করে হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়ার আশঙ্কা করছেন। আর বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনও অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনের কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এরই মধ্যে অ্যামনেস্টির ওই প্রতিবেদন নিয়ে মিয়ানমারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাঙ্গাপ্রবণ উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
বিশেষ অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনকে পুঁজি করে মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ নাগরিকরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহারে বিষোদগার করছে।এ অবস্থায় রোহিঙ্গা অ্যাকটিভিস্টরা অভিযোগ করেছেন, অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনটি ও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হয়ে করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে রাখাইন রাজ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আলোকপাত করেছে অ্যামনেস্টি।
সংস্থাটির দাবি, গত বছরের আগস্টে শিশুসহ অন্তত ৯৯ হিন্দুকে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি-আরসা।
অ্যামনেস্টি বলছে, রাখাইনের মধ্যে ও বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় তদন্ত করে তারা হিন্দুদের নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে, যাতে আরও হিন্দু গ্রামবাসীকে অপহরণ ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে থাকতে পারে।
গত বছরের আগস্টে পুলিশের নিরাপত্তাচৌকিতে আরসার হামলার জের ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মূল অভিযান শুরু করে।এতে প্রাণ বাঁচাতে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
ভারতীয় সংবাদ সংস্থা কুইন্ট জানিয়েছে, অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনের পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে রোহিঙ্গা অ্যাকটিভিস্টরা। তারা সংস্থাটির এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
অন্যরা অবশ্য মনে করছেন, যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন, পুরো রাখাইন সংকটে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পূর্ণ তদন্তে এ প্রতিবেদনও যুক্ত হবে।
অ্যামনেস্টি দাবি করেছে, সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালোচনা করে তারা এ বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে সমাধানে আসতে পেরেছে যে আরসা যোদ্ধারা ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী।
এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিভিন্ন রোহিঙ্গা অ্যাডভোকেসি গ্রুপকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কেবল আরসাকে দায়ী করা হয়নি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকেও দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।
অথচ এর রোহিঙ্গারাই কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকারে পরিণত হয়েছেন। তাদের ওপর দিয়ে গণহত্যা, ধর্ষণ, অঙ্গহানি, বসতবাড়ি ও ক্ষেতের ফসল ভস্মীভূত করে দেয়াসহ হেন কোনো নিপীড়ন নেই, যেটা করা হয়নি।
রোহিঙ্গাদের ভয় হচ্ছে, অ্যামনেস্টির এই উসকানিমূলক প্রতিবেদন রাখাইনে অবস্থান করা নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের জীবনকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। কয়েক দশক ধরে নির্যাতন শিকার হয়ে তারা এমনিতেই ব্যাপক হতাশা ও নড়বড়ে অবস্থার মধ্যে রয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার কর্মীরা অ্যামনেস্টির সাক্ষ্যপ্রমাণের পদ্ধতি, পর্যালোচনা পরাধীন ও অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেন।
তারা বলেন, আরসার অপরাধ নিয়ে অ্যামনেস্টির যুক্তির মধ্যে গোজামিল রয়েছে। কারণ বাংলাদেশে হিন্দু শরণার্থীরা জানিয়েছে, কালো বাহিনী (ব্ল্যাক ফোর্স) হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়কেই হত্যা করেছে।
পরিবারের সদস্য হারানো হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি কালো বাহিনীকে দায়ী করেছেন। কীভাবে মুসলিম ও হিন্দুরা গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছেন, সেই বর্ণনা দিয়েছেন আরেক হিন্দু ব্যক্তি।
কিন্তু অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে যে হত্যাকাণ্ডের কথা বলা হয়েছে, তাদের মুখ থেকে সেই তথ্য পাওয়া যায়নি।
অ্যামনেস্টি কীভাবে সাক্ষাৎকার নিয়েছে ও কোন কর্তৃপক্ষ তাদের সেখানে ঢুকতে দিয়েছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বৌদ্ধ অ্যাকটিভিস্ট মাওউয়ং জার্নি।
তিনি বলেন, তাদেরকে রাখাইনের সিত্তে হামলার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের বাছাই করে দিয়েছে কে? কারা এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে? উত্তর রাখাইন থেকে সিত্তে ও মধ্য রাখাইনে যেখানে প্রবেশের ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকার কঠোর বিধিনিষেদ আরোপ করে রেখেছে, সেখানে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে কে প্রবেশাধিকার দিয়েছেন?
মাওইয়ং জার্নির ভাষ্য, মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে সহায়তা করেছে। তিনি বলেন, এই মন্ত্রণালয়ই কেন্দ্রীয়ভাবে মিয়ানমারের তথ্য, পররাষ্ট্রবিষয়ক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও রাখাইন রাজ্য প্রশাসনকে সমন্বয় করে।
তারা ‘হ্যাঁ’ না বললে কোনো বিদেশি দল সেখানে সফর করতে পারবেন না। অ্যামনেস্টির সাক্ষাৎকারের জন্য হত্যাযজ্ঞের হিন্দু প্রত্যক্ষদর্শী ও বেঁচে যাওয়া লোকজনকে সিত্তে নিয়ে এসেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। সেখানে অ্যামনেস্টির গবেষকরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। রোহিঙ্গা ব্লগার নেই স্যান লিউন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব তদন্তকে স্বাগত জানাই। কিন্তু অ্যামনেস্টির তদন্ত অদক্ষভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। এতে যথাযথ ব্যাখ্যা নেই।
তিনি বলেন, অ্যামনেস্টি সাম্প্রতিক ঘটনাবলি উপেক্ষা করেছে। হিন্দু জনগোষ্ঠী কীভাবে মিয়ানমার সরকারের জন্য ফুটবল খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে, তা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। অতিসত্বর এই প্রতিবেদন প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত।