বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা: আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যতবারই মিডিয়ার মুখোমুখি হয়েছেন ততবারই একটি কমন প্রশ্ন সামনে এসেছে। সেটা হলো- ”আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হবে কি হবে না”।
সাংবাদিকরা সুযোগ পেলেই সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে বিষয়টি তাদের সামনে তুলে ধরেছেন। জানতে চেয়েছেন রাজনৈতিক মনোভাব। প্রতিবারই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ওই প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে সরাসরি। তারা জানিয়েছেন, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে কোন ধরনের সংলাপ হবে না। কারণ নির্বাচন করা সব গণতান্ত্রিক দলের অধিকার। সেই অধিকার বলে বিএনপি নির্বাচন করতেও পারে আবার বর্জন করতে পারে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের দায় দায়িত্ব নেই। কয়েকবার এ ধরনের জবাবের পরও সাংবাদিকরা কিন্তু এক ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন করাটা বাদ দেননি। সর্বশেষ ২২ শে জুন ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। তবে প্রশ্নের ধরণটা ছিলো একেবারে ভিন্ন। সেখানে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। একটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিলো আগামী নির্বাচনে দয়া করে,করুনা করে বা ভালোবেসে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ সংলাপ করবে কি না? জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন,রাজনীতি হচ্ছে হিসাবের অঙ্ক। এখানে করুণা করা, ভালোবাসা দেয়া, প্রেম করার কোনো সুযোগ নেই। মূলত ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যই বিএনপির জন্য স্পষ্ট বার্তা। পরিস্থিতি বিবেচনায় আপাতত বলা যায় বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসবে না আওয়ামী লীগ।
যদিও রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই বলে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে প্রবাদ বাক্যটি এরইমধ্যে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিতও হয়েছে। একই সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, নির্বাচনের আগে বিএনপি’র সঙ্গে সংলাপের কোনো প্রয়োজন তো দেখছি না। গতবার তারা সেই ট্রেন মিস করেছে। গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ডেকেছিলেন। বেগম জিয়ার প্রত্যাখ্যানের ভাষাটা এখনো কানে ভাসে। কি অশালীন অশ্রাব্য ভাষা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখে। এটা ভাবতে লজ্জা লাগে। তিনি বলেন, সেদিন তারা বুঝিয়ে দিয়েছে তারা সংলাপ চান না। তারা আলোচনা চান না। এখন সংলাপ চায়, এখন সংলাপের কোনো প্রয়োজন নেই। ওবায়দুল কাদের বলেন, ২০১৩ সালে সংসদে থাকায় নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এবার বিএনপি সংসদে নেই। যখন পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল তখনও কিন্তু তারা এটায় (নির্বাচনকালীন সরকার) যোগ দেয়নি। এবার তারা দাবি করে কি না আমরা একটু দেখি। সহায়ক সরকার বলতে যে বিষয় সেখানে তাদের রূপরেখা দেবে, আমরা দেখি তারা কী করে, তাদের দাবি কী? তিনি বলেন, সেই ভুলটা তাদেরই। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনকালীন সরকার যেভাবে হয় এখানেও সেভাবেই হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনকালীন সরকার, সেই সরকার নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা দেবে। এটাই সংবিধানের বিষয়, এটাই নিয়মের বিষয়। এটাই আমাদের দেশে হয়ে আসছে। পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে এভাবেই প্রাকটিস হচ্ছে। দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে তত্ত্বাবধায়কের দাবি থেকে সরে এসে গত দুই বছর (২০১৬ ও ২০১৭) ধরে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। তবে গত কয়েক মাস যাবৎ বিএনপির নেতাদের কেউ বলছেন, সরকারকে আর খালি মাঠে গোল দিতে দেয়া হবে না। যেকোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। অবশ্য সর্বশেষ বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে ১২ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ারও ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এক ধরনে নির্বাচন বয়কটেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। কিন্তু বিএনপির এ ধরনের হুমকিতে কর্ণপাতও করেনি ক্ষমতাসীন দল। তাদের মতে, বিএনপি ব্যর্থ হয়ে বারবার নিজ অবস্থান থেকে সরে আসছে। শেষ পর্যন্ত অস্থিত্ব রক্ষায় তারা এই সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নেবে। সংলাপ-সমঝোতার প্রয়োজন হবে না। এদিকে সংলাপ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে বলেছেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের (বিএনপি) সঙ্গে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেয়া সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। তাতে কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে নেবে, না নিলে না নেবে- সেটা তাদের দলের সিদ্ধান্ত। আমাদের কিছু বলার দরকার নেই। তবে বিএনপি মনে হয়- আর আগের মতো ভুল করবে না, নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে আসবে। আওয়ামী লীগ নেতারাও মনে করেন, কোনো শর্ত মানা বা সংলাপের প্রয়োজন হবে না। বিএনপি তার প্রয়োজনে নির্বাচনে আসবে। টানা দুই জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিলের ভয় ও রাজনীতির মাঠে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় এমনিতেই নির্বাচনে আসবে তারা। যদি নাও আসে, তাতেও বিএনপিকে ছাড় দেয়া ঠিক হবে না। গত ২০১৩ ও ২০১৪ সালের মত কোনো জ্বালা-পোড়াও বা আন্দোলনের কর্মসূচি দিলে মাঠেও নামতে দেয়া হবে না বিএনপিকে- এমনটা প্রকাশ্যেই বলছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না আসলে তাদের কোনো ছাড় নয়। আগের মত আন্দোলনের জননিরাপত্তা বিঘিœত করেত চাইলে, জ্বালাও পোড়াও করতে চাইলে তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে। সবমিলিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন মহল থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ আয়োজনের দাবি জোরালো হচ্ছে। আর এ ইস্যুতে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখনও পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। তবে বিএনপি মনে করছে নির্বাচনের আগে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যাতে এক পর্যায়ে সরকারী দল আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে সংলাপে রাজি হবে। আর আওয়ামী লীগ মনে করছে সংবিধান অনুসারে নির্বাচন করলে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের কোন প্রয়োজন নেই। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে ডিসেম্বরে নির্বাচনের লক্ষ্যে অক্টোবরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে সংবিধান অনুসারে অক্টোবরেই অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে আর এ সরকারের আকার ছোট হবে। নির্বাচন কমিশন ও সরকারের এ অবস্থানের কথা জেনে নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিও নড়ে চড়ে বসেছে।
বিএনপি অবশ্য অনেক আগে থেকেই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংলাপের দাবি জানিয়ে আসছে। তবে বিএনপির এ দাবি আমলে নিচ্ছে না সরকারী দল আওয়ামী লীগ। এ কারণে বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকারের একটি রূপরেখা ঠিক করে রাখলেও তা প্রকাশ করছে না। তবে কিভাবে সরকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে বসা যায় এ নিয়ে নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, আন্দোলন কর্মসূচী পালনসহ দেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হবে যে সরকারী দল আওয়ামী লীগ সংলাপ করতে বাধ্য হবে। এদিকে আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুসারে নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে। তারা এখন আর কোনভাবেই বিএনপির সঙ্গে সংলাপে রাজি নয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ফোন করে সংলাপের আমন্ত্রণ জানানোর পরও তিনি তা নাকচ করে দেন। এ ছাড়া ২০১৫ সালে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানাতে চাইলেও তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। অনেকক্ষণ গেটে অবস্থান করার পরও গেট খুলে প্রধানমন্ত্রীকে ভেতরে প্রবেশ করতে না দেয়ায় তিনি সেখান থেকে গণভবনে ফিরে যান। তাই এখন যতবারই বিএনপি সংলাপের দাবি জানাচ্ছে আওয়ামী লীগও ততবারই সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে। এদিকে বিএনপি যাতে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ করতে পারে সে জন্য ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সহযোগিতা চায়। এ জন্য বিএনপি নেতারা ঘন ঘন তাদের সঙ্গে বৈঠক করছে। এ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কিছু রাজনীতিককে দিয়ে চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি।