পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজে প্রতিষ্ঠিত 'দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একমাত্র' রকস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত সংগ্রহশালা দেখতে প্রতিবছর দেশ বিদেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটক এবং গবেষক ছুটে আসেন। কিন্তু সঠিক সংরক্ষণ, অর্থ ও অভিজ্ঞ লোকবলের অভাবে এই জাদুঘরে সংগৃহীত প্রাচীন নিদর্শনগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
১৯৯৭ সালে পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন অধ্যক্ষ নাজমুল হক ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলেন দেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর। পরবর্তীতে এই জাদুঘরটি রকস মিউজিয়াম নামে পরিচিতি পায়। অল্প সময়ের মধ্যে এই জাদুঘরের খ্যাতি দেশ বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্চগড় পৌরসভা ও জেলা পরিষদের সহযোগিতায় গত কয়েক বছর আগে স্বল্প পরিসরে রকস ভবন নির্মাণ করা হয়। তবে পর্যটক এবং স্থানীয় শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী ও পেশাজিবীদের অভিমত জাদুঘরে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাব রয়েছে। তারা চান সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সহযোগিতা।
রকস মিউজিয়ামের পরিচালক এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান গোলাম কিবরিয়া জানান, 'দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এটি একমাত্র রকস মিউজিয়াম। উত্তরাঞ্চলের ভূখন্ডের বয়স নির্ণয়, ভূ-বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধান, প্রাগৈতিহাসিক কালের নমুনা সংগ্রহ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং পুরাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক এ মিউজিয়াম স্থাপন করা হয়। হিমালয় কন্য খ্যাত পঞ্চগড় জেলার ভূগর্ভে রয়েছে প্রচুর নুড়ি আর গভীরে রয়েছে প্রাচীন যুগের শিলাস্তর। এই শিলাস্তরের কালানুক্রমিক নমুনা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই রকস মিউজিয়াম বা পাথরের জাদুঘর।'
এই কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক হাসনুর রশিদ বাবু জানান, যায়গার অভাবে জাদুঘরের বাইরে মাঠের মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে বিশালাকারের অনেকগুলো পাথর। রোদ বৃষ্টিতে এসব পাথরের রং বদলে যাচ্ছে। এছাড়া ভবনের ভেতরে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় পাথর। আছে জাতিতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা। এ অঞ্চলের আদিবাসী, উপজাতিদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং ভূগর্ভে প্রাপ্ত অশ্মিভূত কাঠ, তিনশ’ থেকে ২ হাজার বছরের পুরনো ইমারতের ইট, পাথরের মূর্তি এবং পোড়ামাটির নক্সা রয়েছে এখানে।
তিনি আরো জানান, উন্মুক্ত গ্যালারিতে আরও রয়েছে বিশাল আকৃতির বেলে পাথর, গ্রানাইট পাথর, কোয়ার্জাহিট, ব্যাসল্ট, শেল, মার্বেলসহ বিভিন্ন নামের শিলা, সিলিকায়িত কাঠ বা গাছ থেকে পাথর, নকশা করা অলংকৃত খিলান বিভিন্ন রেখা, লেখা ও চিত্রাঙ্কিত শিলা এবং ধূসর ও কালো রঙের কাদা। এখানে রয়েছে ২৫ ফুট ৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য প্রস্থের দুটি নৌকা। একটি মাত্র শালগাছ কেটে এই বিশাল আকারের নৌকা দু’টি তৈরি করা হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে নৌকা দুটি হাজার বছরের পুরনো। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী আদীবাসিরা এ ধরনের নৌকা ব্যবহার করতো বলে বিষেশজ্ঞ ধারনা করে থাকেন।
স্থানীয় নাট্যদল ভূমিজের নাট্যকর্মী মোস্তাক আহমেদ ও নাসরিন আক্তার জানান, প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে রকস মিউজিয়ামে সংগৃহীত বিভিন্ন সুপ্রাচীন এবং দুর্লভ জিনিসপত্র প্রতিনিয়ত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দুর্লভ এসব জিনিসপত্রে ধুলোবলি জমে গেছে। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। পুরো ঘরটি গুমোট। প্রশিক্ষিত জনবলও নিয়োগ করা হয়নি এই জাদুঘরে। গড়ে ওঠেনি আধুনিক অবকাঠামো।
এদিকে জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হক এই কলেজ থেকে বিদায় নেয়ার পর থেমে গেছে সংগ্রহ কার্যক্রমও। চিত্রশিল্পী লাফিজা নাজমিন মনে করেন এ অঞ্চলে আরও অনেক কিছু সংগ্রহ করার আছে। গবেষণাও বাকি রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আবারও সংগ্রহ অভিযান শুরু করা উচিত।
অধ্যক্ষ প্রফেসর কানাইলাল কুন্ডু জানান, এখন পর্যন্ত জাদুঘরের নামে কোন অনুদান পাওয়া যায়নি। শিক্ষার্থীদের টাকায় চলছে এই জাদুঘর। এই জাদুঘরের সংস্কার এবং উন্নয়ন প্রয়োজন। সংগৃহীত পাথরগুলোর বৈশিষ্ট, নাম ও প্রকৃতি নির্ণয় করা প্রয়োজন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহযোগিতা দরকার।