ইদানীং ‘কোটা সংস্কার’ একটি বহুল উচ্চারিত শব্দ। এই কোটা সংস্কার নিয়ে বেশ ক’মাস দেশব্যাপী খুব অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বর্তমান কোটা পদ্ধতি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি আছে। কিন্তু এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোটা পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়ন যে প্রয়োজন তা সবাই উপলব্ধি করছে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও ১১ এপ্রিল কোটা পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়নের কথা বলেছেন এবং সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করার জন্য একটি কমিটিও গঠন করে দিয়েছেন। কমিটি ইতিমধ্যেই তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটায় নিয়োগ ৫৬ শতাংশ এবং বাকি ৪৪ শতাংশ মেধায়। কোটার শতাংশের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা, নারী, নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ২৬ শতাংশ। মোট কোটা নিয়োগের সিংহভাগ যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা কোটা এককভাবে দখল করে আছে, এজন্য এই কোটা নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে।
এ নির্দিষ্ট কোটা নিয়ে আলোচনার আরও একটি কারণ হল- মুক্তিযোদ্ধা কোটা এখন আর মুক্তিযোদ্ধা কোটা নেই! এটি এখন ‘পোষ্য কোটা’য় পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য, সামাজিক নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ১৯৭২ সালের গণপরিষদ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে কোটা পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই নিহত হয়েছিলেন, অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে অনেকের পরিবার আবার স্বর্বস্ব হারিয়েছিলেন। যুদ্ধের পর তাদের যথোপযুক্ত পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি। এ কথা বিবেচনা করে নিহত, যুদ্ধাহত এবং নিঃস্ব মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছিল। আমাদের সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে কোনো বিধান নেই, এই কোটা পদ্ধতি যুগ যুগ ধরে চালু থাকবে সেই রকম কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনাও তখন ছিল না।
কিন্তু যুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর সরাসরি প্রতিক্রিয়া তাদের সন্তানদের ওপরও পড়েছিল, এ কথা বিবেচনা করে পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের এই কোটার সুযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। এরও পরে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিনাতনিদেরও এই কোটার সুযোগ করে দেয়া হল। কিন্তু নাতিনাতনিদের অন্তর্ভুক্ত করার পর জনগণ এ ব্যবস্থাকে সহজ চোখে নিতে পারল না।
জনমনে প্রশ্ন, সাধারণ মানুষের আবেগকে জিম্মি করে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা- এই দুটি স্পর্শকাতর ইস্যুকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যেই এ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের গণপরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি অন্তর্বর্তীকালীন কোটা ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার জন্য যুগের পর যুগ চালু রাখা যায় না।
বর্তমান কোটা পদ্ধতি সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষ্যমের সৃষ্টি করছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক! এ ছাড়া সংবিধানের ১৯(১) এবং ১৯(২) ধারারও পরিপন্থী। ১৯(১) ধারায় বলা আছে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’। ১৯(২) ধারায় চাকরিতে নিয়োগ সম্পর্কে আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগ সমান থাকিবে।’
কোটা সংস্কারের দাবি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। শিক্ষিত ও মেধাবী চাকরিপ্রত্যাশী যুবসমাজের কর্মসংস্থানের প্রশ্নে এখন এই দাবি গণমানুষের দাবিতে পরিণত হয়ে গেছে। বিশেষ করে কোটা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারসমর্থিত ছাত্রলীগের বর্বোচিত আচরণের পর।
দেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্ব, স্থানীয় ব্যক্তি ও সুশীলসমাজ একযোগে এই দাবির পক্ষে যৌক্তিকতা তুলে ধরে সহমত পোষণ করেছেন এবং বিভিন্ন বক্তৃতা ও বিবৃতির মাধ্যমে তাদের সমর্থন জানিয়েছেন। বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির যে সংস্কার প্রয়োজন সে ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছেন। আমরা জানি, ইতঃপূর্বে কোটা পদ্ধতি সম্পর্কিত বিভিন্ন কমিটি ও কমিশন গঠন করা হয়েছিল।
এ ছাড়াও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকেও কোটা পদ্ধতি মূল্যায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়েছিল। এসব কমিটি, কমিশন বা সংস্থার প্রতিটি প্রতিবেদনে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সাবেক সচিব এটিএম শামসুল হকের নেতৃত্বে বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও আমলাদের নিয়ে ১৩ সদস্যের ওই কমিশন ২০০০ সালের ২৫ জুন সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু সময় স্বল্পতাহেতু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিবেদন বাস্তবায়ন করে যেতে পারেনি।
কমিশনের প্রতিবেদনে ৩০টি অন্তর্বর্তীকালীন সুপারিশ করা হয়েছিল। উল্লিখিত ৩০টি সুপারিশের মধ্যে মেধা কোটা শতকরা ৪৪ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ৫৪ ভাগ করার কথা বলা হয়েছিল। এই কমিশন আরও মতপ্রকাশ করে, সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশা ও প্রকৃত চাহিদা পূরণে যে বিশাল ও জটিল উন্নয়নমূলক কাজ করতে দক্ষতার প্রয়োজন হয়, সিভিল সার্ভিসের সে দক্ষতা নেই। সেই দক্ষতা অর্জনে চাই মেধাবী, দক্ষ ও কর্মস্পৃহাসম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী। কিন্তু বিদ্যমান কোটা পদ্ধতিতে মেধা কোটার প্রার্থীদের চাকরি পাওয়ার সুযোগ সীমিত; এ কারণে ‘সিভিল সার্ভিস সংস্কার’ প্রসঙ্গে সুপারিশ প্রণয়নকালে ১৯৯৭ সালের কমিশন নিয়োগ নীতিপর্বে কোটা পদ্ধতি ক্রমান্নয়ে বিলোপের সুপারিশও করে। ১১ এপ্রিল সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণেও কমিশনের এই সুপারিশটিই প্রতিধ্বনিত হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রীর কোটা বাতিলের ঘোষণার পর সরকারসমর্থিত ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কৃতিত্ব ছিনতাই করে নিয়ে এটি তাদের বিজয় বলে ঘোষণা দেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আনন্দ মিছিল করে। বিভিন্ন প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আগ বাড়িয়ে এই বিজয় তাদের আন্দোলনের ফসল বলে দাবিও করে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে পড়ে।
অতঃপর সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীকে ‘মাদার অব এডুকেশন’ উপাধি দিয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত করে প্রজ্ঞাপন জারির অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু দীর্ঘ আড়াই মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও প্রজ্ঞাপন জারির কোনো লক্ষণ না দেখে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কোটা সংস্কার আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নিয়ে তাদের ভেতর সংশয় দেখা দেয়।
এরই মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রজ্ঞাপন জারির ব্যাপারে উচ্চমহল থেকে কোনো দিকনির্দেশনা পাননি বলে জানালে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভেতর হতাশার সৃষ্টি হয়। দৃশ্যত এ নিয়ে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা ৩০ জুন পাবলিক লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেন।
অতঃপর সেদিন সাংবাদ সম্মেলন করতে গেলে ছাত্রলীগের সদস্যরা বাধা দেয় এবং সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের ওপর নৃশংসভাবে আক্রমণ করে আহত করে। এরপর দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা আন্দোলনকারী নেতাদের খুঁজে খুঁজে বের করে একযোগে আক্রমণ চালায় এবং হাতুড়িপেটা করে। ছাত্রলীগের এসব ক্যাডার নিজ উদ্যোগে আন্দোলনকারী কয়েকজন নেতাকেও পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে ঘটেনি। এ সময় ঢাকায় ছাত্রলীগের কর্মীরা প্রকাশ্যে একজন কলেজপড়ুয়া ছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটায়।
একটি অরাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে এহেন হিংসাত্মক আচরণ ঐতিহ্য ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দৈন্যদশার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হয়। ছাত্রলীগের এ ধরনের কর্মকাণ্ড স্বাধীনতাপূর্ব আইয়ুব-মোনায়েম খানের মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন এনএসএফ-এর দুর্ধর্ষ নামকরা পাণ্ডা খোকা, আবু, জাহাঙ্গীর এবং তৎকালীন ফজলুল হক হলের পাঁচপাত্তুর কর্মকাণ্ডকে মনে করিয়ে দেয়। মনে রাখা জরুরি, ১৯৬৫ সালের অত্যন্ত প্রতাপশালী এনএসএফের ক্যাডাররা মাত্র চার বছরের মাথায়ই ১১ দফা ছাত্র আন্দোলনের ঘূর্ণিঝড়ের এক ফুঁৎকারে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল।
ছাত্রলীগের হিংস্র আক্রমণের পর কোটা সংস্কার আন্দোলন আপাতত স্তিমিত মনে হচ্ছে। অনেকে বলেন, ছাইচাপা দিয়ে আপাতত আগুন প্রশমিত করা হয়েছে। কখন যে আবার দমকা হাওয়ায় এই ছাইচাপা আগুন অগ্নিস্ফূলিঙ্গের রূপ নেয়, তা দেখার অপেক্ষার পালা। কারণ বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের একটা ঐতিহ্য আছে। ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাধারণ জনগোষ্ঠীর দাবি আদায়ের ইতিহাস খুবই উজ্জ্বল।
১৯৪৭ সালের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক এমন একটিও উদাহরণ নেই, যেখানে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশে ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা শুরু হয়। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের ১১ দফা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ১/১১-এর পর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। অতএব, কোনো কোনো মহল যদি ভেবে থাকেন, ওরা শিরদাঁড়া খাড়া করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না; কোটা আন্দোলনের এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটেছে, তাহলে ভুল করবেন।
২.
যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে এতকথা, এত আলোচনা-সমালোচনা সেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা আমরা আজ পর্যন্ত কি তৈরি করতে পেরেছি? এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র নিয়ে অনেক তুঘলকিকাণ্ড হয়ে গেছে। বিশেষ করে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর ঘোষণা দিলে মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণ করার হিড়িক পড়ে যায়।
যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে যোগদানের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেব কোথাও ঘোষণা দেননি, চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণার পর ধীরে ধীরে তাদের অনেকেই নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাহির করতে শুরু করেন। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর চারটি মানদণ্ড বা শর্ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই চারটি মানদণ্ডের মধ্যে চাকরিতে যোগদানের সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, এমন অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে যোগদানকালে ঘোষণা না দিয়েও নানা কৌশলে ও জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাগিয়ে নিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন এবং সরকারপ্রদত্ত সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আমলা থেকে শুরু করে এমএলএসএস পর্যন্ত এই তালিকায় রয়েছেন।
যে সিভিল সার্ভিসের চাকরির জন্য মুক্তিযাদ্ধা কোটা নিয়ে এত বিতর্ক, সেই সিভিল সার্ভিসেরই পাঁচ পাঁচজন সচিব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখিয়ে দিব্যি বর্ধিত চাকরির সুবিধা ভোগ করে গেলেন। এই পাঁচজন সচিবের মধ্যে খোদ মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব মাসুদ সিদ্দিকী অন্যতম। ‘এ যেন সরষের ভেতর ভূত দেখার মতো’! এ পর্যন্ত জানামতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ১৮২ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করেছে।
অপরদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১৯ জন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করেছে। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ইতঃপূর্বে ভুয়া সনদ ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৪৪৩ জন পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগেরও অভিযোগ করেছে। দুদক কর্তৃক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত ১৯ জন পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে সহকারী পুলিশ সুপার, পুলিশ সুপার, ডিআইজি এবং অতিরিক্ত আইজি পদের একাধিক কর্মকর্তা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে অবসর গ্রহণের বয়সসীমা বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অথচ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদের সবার বয়স ১১ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে ছিল বলে দুদকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে; যা এক প্রকার অবিশ্বাস্য ঘটনা হিসেবে দুদক তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। জানা যায়, টাকার বিনিময়ে এসব মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগৃহীত হয়েছিল।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে বিভিন্ন সময় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচুর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বেরিয়েছে। জাল সনদের হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংবাদ আমরা দেখেছি। যথাযথ লোক ধরে প্রতিশ্র“ত টাকা খরচা করলেই মিলছে মুক্তিযুদ্ধ না করেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাওয়া, গেজেটভুক্ত হওয়া এসব কোনো কষ্টসাধ্য ব্যাপারই না। এই সুযোগে অনেক রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীও মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন। এভাবেই মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এখন স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, যেখানে টাকার বিনিময়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ম্যানেজ করে চাকরির মেয়াদ বাড়ানো সম্ভব, সেখানে একই উপায়ে ম্যানেজ করা সনদ দেখিয়ে রাজাকারের নাতিনাতনিরাও যে মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুবিধা নিচ্ছে না, তারই বা কী নিশ্চয়তা আছে? স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও যখন আমরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করতে পারিনি, সেখানে ভুয়া সনদ দাখিল করে মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুযোগ নিয়ে সরকারি চাকরি বাগিয়ে নেয়ার পথ বন্ধ করি কী করে?
যে পাঁচজন সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করা হয়েছে তাদের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণের জন্য বলা হলেও তারা তা করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, এতকিছুর পরও তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা গেল না।
সাধারণ মানুষ যখন দেখে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণের পরও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে এমএম নিয়াজউদ্দিন মিয়া জাতিসংঘের ৬৯তম সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সফরসঙ্গী হয়ে নিউইয়র্ক যাচ্ছেন, তখন মুক্তিযাদ্ধা কোটার শতকরা হার অপরিবর্তিত রাখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সবার মনে সংশয় জাগে বৈকি!
‘মুক্তিযোদ্ধা’র মতো এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে জোচ্চুরির পরও এসব দুশ্চরিত্র ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী যখন দৃশ্যমান কোনো শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না, তখন সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অন্য অনেক পদক্ষেপই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সাধারণ জনমনে দেখা দেয় সংশয় ও সন্দেহ।
রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ে যখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আবিষ্কৃত হয় অথচ কিছুতেই কিছু হয় না, তখন সমাজের অন্যান্য স্তরের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরেরা যে মুক্তিযোদ্ধা কোটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে না, মানুষের এই সন্দেহকে আমরা দূর করি কী করে? মুক্তিযুদ্ধকে পণ্য করে বাণিজ্য করার পরও যখন কেউ কেউ বিশেষ বিবেচনায় ছাড় পেয়ে যায়, তখন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মন খারাপ হয়, তারা দুঃখবোধ করেন, আহত হন। আমরা কি একবার অন্তত কান পেতে তাদের বুকের গভীরে এই নীরব রক্তক্ষরণের শব্দ শোনার চেষ্টা করেছি?
৩.
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী কোটা পদ্ধতি বাতিলের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, বর্তমানে তিনি তার সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন বলে মনে হয়। ১২ জুলাই জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনের সমাপ্তি দিনে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ সংরক্ষণের হাইকোর্টের আদেশ আছে উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল সম্ভব নয় বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন।
তার এই ঘোষণার পর দেশব্যাপী সাধারণ ছাত্রদের ভেতর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণের পর সাধারণ জনমনেও হতাশা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে সবার মনে একটি ছোট্ট প্রশ্ন জেগেছে- হাইকোর্টের এমন একটি আদেশ থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে গোটা কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দিলেন কী করে?
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় তাহলে কি সঠিক তথ্য প্রধানমন্ত্রীকে দেয়নি? সেদিন কোটা বাতিল ঘোষণার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি, সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে সরকারের কি রিভিউ করার কোনো সুযোগই নেই? এখানেও তথ্যের কিছুটা বিভ্রাট রয়েছে বলে মনে হয়। হাইকোর্টের আদেশে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধার নাতিনাতনিদের কথা বলা হয়নি। কাজেই সরকার ইচ্ছা করলেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য হাইকোর্টের ওই আদেশ এবং আপিল আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশনে যেতে পারে।
কোটা সংস্কারের দাবি বর্তমানে শুধু সাধারণ ছাত্রদের দাবির মধ্যে নেই, এই দাবি এখন গণমানুষের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া কোটা পদ্ধতি মূল্যায়ন সংক্রান্ত এ পর্যন্ত গঠিত যতগুলো কমিটি, কমিশন ও সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তাদের প্রতিটি প্রতিবেদনে কোটা সংস্কারের সুপারিশ রয়েছে।
এতকিছুর পরও মুক্তিযোদ্ধা কোটা যদি অবিকল রাখা হয়, তাহলে দেশবাসীর কাছে ভুলবার্তা পৌঁছবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের পর তাদের নাতিনাতনিদের অন্তর্ভুক্তি অব্যাহত রাখলে সাধারণ মানুষ তা সহজ চোখে দেখবে না।
সুযোগসন্ধানীরা সুযোগ খুঁজবে এবং নিন্দুকেরা নিন্দা করবে, বলবে- ‘সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মুক্তিযোদ্ধা সন্তান বাদেও তাদের নাতিনাতনিদের চাকরির সুবিধা নিশ্চিত করে একশ্রেণীর অনুগত সরকারি কর্মকর্তা তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে, এরা হল- ১৯৭৩ সালের ক্যাডারের নবসংস্করণ’। দেশের নাগরিকদের ভেতর এরূপ ধারণা বদ্ধমূল হওয়ার আগেই যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
জনগণের এই ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ১১ এপ্রিলের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কোটা পদ্ধতির একটি গ্রহণযোগ্য সংস্কার করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি চিহ্নিত ও অচিহ্নিত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বিশেষ বিবেচনায়’ কোনো ছাড় না দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; তাহলেই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি সম্ভব হবে প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন করা।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা