
তুহিন সানজিদ, নিউইয়র্ক: কানাডা ছেড়ে আপাতত নিউইয়র্কের বাসিন্দা হয়েছেন বাংলাদেশের বহুল আলোচিত সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা)। বড় কিংবা নামকরা কোনো নগরীতে নয়, ছোট্ট এক নিরিবিলি শহরকেই বেছে নিয়েছেন নিজের অস্থায়ী আবাস হিসাবে। সেখানে নিভৃত জীবন যাপন করছেন তিনি।
অপরিসর ফ্ল্যাটে একেবারেই অনাড়ম্বর সাদামাটা জীবনের একমাত্র সঙ্গী স্ত্রী সুষমা সিনহা। বই পড়ে আর লেখালেখি করেই সময় কাটছে তার। কারো সাথে দেখা করেন না, কথা বলেন না, এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটির সঙ্গেও নেই তেমন কোনো যোগাযোগ। ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু ছাড়া এখানে অবস্থানের খবর তার আত্মীয়স্বজনরাও জানেন না। সবমিলিয়ে অনেকটা নিভৃতেই দিন কাটাচ্ছেন বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সাবেক এই শীর্ষ ব্যাক্তিত্ব।
এস কে সিনহার একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র নিউইয়র্ক মেইলকে জানিয়েছেন, কানাডায় বসবাসরত মেয়ের কাছ থেকে কয়েক মাস আগেই যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন তিনি। তবে নিউইয়র্ক কিংবা লস এঞ্জেলেসের মতো বড় কোনো নগরীতে নয়, নিউইয়র্কের অদুরে অপরিচিত ছোট্ট একটি শহরকেই বেছে নেন তিনি আপাতত বসবাসের জন্য। প্রথম কয়েক সপ্তাহ ছিলেন এক বন্ধুর বাসায়। বাইরের জগতের সঙ্গে নিজেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রেখেছিলেন সে সময়। স্ত্রী সুষমা সিনহা তখনও ঢাকায়। তাই একাকীই কেটেছে কয়েক মাস। চেষ্টা করছিলেন স্ত্রীকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে। অবশেষে কিছুদিন আগে তাঁর কয়েক মাসের একাকিত্বের অবসান ঘটে। স্ত্রীকে কাছে পাওয়ার পর বন্ধুর বাসা ছেড়ে উঠেন নিজের ভাড়া করা ছোট্ট একটি ওয়ান বেডরুম এপার্টমেন্টে। বর্তমানে সেখানেই পড়াশোনা ও লেখালেখি করেই কাটছে তাঁর সময়। অবশ্য অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার প্রয়োজনে আজকাল কদাচিত বাসা বাইরে বের হন বলে জানা গেছে।
বিচারপতি সিনহার ঘনিষ্ঠ সূত্রটি আরো জানিয়েছেন, দীর্ঘদিনের অভ্যাস অনুযায়ি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেন তিনি। অষ্ট্রেলিয়া ও কানাডায় বসবাসরত দুই মেয়ের সাথে কথা বলেন চা খেতে খেতে। তারপর লেখালেখিতে মনোযোগ দেন। এসময় ফোন বন্ধ রাখেন। খুব প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে ফোনেও কথা বলেন না। দিনের বেশিরভাগ সময় লেখালেখি আর বই পড়ে কাটান। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পর স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটতে বের হন নির্জন এলাকায়।
কারো উপর নির্ভর করতে চান না বলেই মেয়ের বাড়ি ছেড়ে নিউইয়র্কে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি- আলাপচারিতায় ওই ঘনিষ্টজনকে এমনই জানিয়েছেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। তাছাড়া লেখালেখির জন্য একেবারে আলাদা এবং নিরিবিলি পবিবেশই তার পছন্দ। যেটা মেয়ের বাড়িতে থেকে সম্ভব হচ্ছিল না।
সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনিই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম অমুসলিম প্রধান বিচারপতি। ১৭ জানুয়ারি তিনি দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এর আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০০৮ সালে আবারো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৬ আগস্ট তাকে আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
তিনি সরকারের অত্যন্ত আস্থাভাজন হওয়ায় প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর থেকে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। তবে বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করার অভিযোগ এবং নিন্ম আদালতের বিচারক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ নিয়ে সরকারের তার বিরোধ শুরু হয়।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুলাই মাসে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সরকারের সাথে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। ৩ জুলাই উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল রেখে রায় দেয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ।
রায়ে প্রধান বিচারপতির কয়েকটি মন্তব্যে নাখোশ হয় সরকার এবং আওয়ামী লীগ। প্রধান বিচারপতির ‘অগ্রহণযোগ্য’ বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার কথা বলে সরকার। কিন্তু এস কে সিনহা তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অনঢ়।
২২ আগস্ট দায়িত্ব ছাড়তে এস কে সিনহাকে সময় বেঁধে দেয় আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা। তা না হলে তাকে অপসারণে আন্দোলনের হুমকি দেয়া হয়। বিভিন্ন সভা সমাবেশে প্রকাশ্যে বিষোধগার করতে থাকেন সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীরা। ১৩ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং তার কিছু পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে জাতীয় সংসদে প্রস্তাব গ্রহণ করে সরকার। এসময় বিচারপতি সিনহার তীব্র সমালোচনাও করা হয়।
বেঞ্চের কয়েকজন বিচারপতি একই সঙ্গে এজলাসে বসতে রাজি হননি। প্রতিবাদ আর নানামুখি চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে হয় তাকে। বিদেশে বসেই পদত্যাগপত্র পাঠাতে হয়। ওই রায় প্রকাশের পর থেকে পাঁচ মাসের মধ্যেই ঘটে যায় সব ঘটনা।
১ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি সিনহা অসুস্থ্যতাজনিত কারণ দেখিয়ে এক মাসের ছুটি চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে একটি চিঠি দেন। পরে আরেকটি আবেদনে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত ছুটি চান তিনি। ১৩ অক্টোবর রাতে তিনি অস্ট্রেলিয়ার মেয়ের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশে দেশ ছেড়ে যান বিব্রত ও শঙ্কিত এই প্রধান বিচারপতি। ছুটির আবেদনে অসুস্থ্যতার কথা লেখা থাকলেও দেশ ছাড়ার সময় তিনি অসুস্থ্য নন বলে সাংবাদিকদের জানান। ১৭ অক্টোবর তার স্ত্রী সুষমা সিনহাও অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে দেশ ছাড়েন।
এরপর গত বছরের ১১ নভেম্বর অষ্ট্রেলিয়া থেকে কানাডায় আরেক মেয়ের বাড়ি যাবার পথে যাত্রাবিরতি করে সিঙ্গাপুর দূতাবাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান বহুল আলোচিত এই প্রধান বিচারপতি। বয়স অনুযায়ী এ বছর ৩১ জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে মেয়াদের ৮১ দিন আগেই তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।
অষ্ট্রেলিয়া থেকে কানাডায় ছোট মেয়ে আশা সিনহার বাসায় উঠেন বিচারপতি সিনহা। সেখানে ভালোই সময় কাটছিল তার। তবে বসবাসের জন্য কানাডার চাইতে যুক্তরাষ্ট্র বেশি পছন্দ হওয়ায় গত এপ্রিল মাসে সেখান থেকে নীরবে পাড়ি জমান নিউইয়র্কে। এখানে আসার পর নিজেকে আড়াল করে রাখছেন তিনি। ঘনিষ্ঠ কারো কারো সাথে ফোনে কথা হলেও অনেকে তার ঠিকানা জানেন না। এমনকি তার এখানে বসবাসের খবর কোনো সংবাদ মাধ্যমেও প্রচার হয়নি। তবে দেশ ছাড়া সাবেক এই প্রধান বিচারপতি শেষ পর্যন্ত হয়তো যুক্তরাষ্ট্রেই স্থায়ী আবাস গড়তে যাচ্ছেন।