একটি দূর্ঘটনা নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন দাবীর চিত্রটাই বদলে দিয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎই চেষ্টা করা হয়েছে সড়ক পরিবহন আইন পাসের। কিন্তু আইনে কঠোর কিছু থাকলেই বেকে বসতেন একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, যে কিনা একজন পরিবহন শ্রমিক নেতা। পরিস্থিতি তার অনুকুলে না দেখলেই ধর্মঘটের ডাক দিতেন। দেশ হতো অচল। অগত্যা সরকার আইন পাস করা থেকে সরে আসতে বাধ্য হতো। দূর্ঘটনার পর সেই মন্ত্রী কাম শ্রমিক নেতার একটি নির্লজ্জ হাসি দেশের পরিস্থিতি ‘বদলে দিয়েছেন’।
ফুটওভারব্রিজ থাকলেও আমরা ব্যবহার করি না, জেব্রা ক্রসিং থাকলেও যেখান দিয়ে মন চায় হাত উঠিয়ে রাস্তা পার হই, নির্ধারিত স্টপেজ মানি না, যেখানে নামা প্রয়োজন সেখানেই বাসের গায়ে থাপ্পর দিয়ে বলে বসি‘ওস্তাদ একটু ব্রেকে পাও দেন’। ফুটপাত দিয়ে হাটতে ইচ্ছে করে না। ফুটপাত দিয়ে না হাটার কিছু কারণও আছে। যেমন: ফুটপাত হকারদের দখলে থাকে সবসময়, যেখান দিয়ে ফাঁকা, সেখানে থাকে ময়লার স্তুপ। তবে সব থেকে বেদনাদায়ক বিষয় হলো আমাদের আইন না মানার মানসিকতা।
প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনে শাস্তি বাড়ানো হয়েছে। খসড়া আইনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় হলো-ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে কম পক্ষে অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে। আগে যেখানে কোন শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজনই ছিল না। শুধু রং চিনলে এবং গরু ছাগল চিনলেই লাইসেন্স দেয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হত, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে ছয় মাসের কারাদন্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, গাড়ির হেলপার বা কন্ডাক্টরের (ভাড়া আদায়কারী) লাইসেন্স থাকাও বাধ্যতামূলক। হেলপার ও কন্ডাক্টরের যোগ্যতা হিসেবে বলা হয়েছে, তাকে লিখতে ও পড়তে পারতে হবে। হেলপার বা কন্ডাক্টরের লাইসেন্স না থাকলে এক মাসের কারাদন্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সংরক্ষিত নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের নির্ধারিত আসনে বসতে না দিয়ে কেউ ওই আসনে বসলে এক মাসের কারাদন্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। চালক মোবাইল ফোন বা এরূপ কোনও ডিভাইসব্যবহার করলে এক মাসের জেল বা পাঁচ হাজারটাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড, বেপরোয়া গাড়ি চালালে ২ বছরের কারাদন্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড, বেপরোয়া গাড়ি চালানোয় দুর্ঘটনা ঘটলে তিন বছরের কারাদন্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে, দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত নিহতের ঘটনা ঘটলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং আমলযোগ্য অপরাধে বিনা পরোয়ানায় আটকের বিধান রাখা হয়েছে। নতুন আইনে ৬ মাসের কারাদন্ড এবং ৫০ হাজার টাকার বেশি জরিমানা হলে সেটি জামিন অযোগ্য হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবে অপরাধীকে। আর অতিরিক্ত ওজন বহনে মালিক ও চালকের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে আইনে। পাঁচ টনের ট্রাক যদি ১৫ টন ওজন বহন করে, সে ক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদন্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড, জাল লাইসেন্স ব্যবহার করলে চালক ও হেলপারের দুই বছরের কারাদন্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ফুটপাত দিয়ে মোটর সাইকেল চালালে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেল (কারাদন্ড) এবং ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা। মোটর সাইকেলের ক্ষেত্রে চালক ও সহযাত্রীর দুজনেরই হেলমেট থাকতে হবে, গাড়ীর সামনে ও পেছনে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে কোনও কিছু বহন করা যাবে না, চলন্ত অবস্থায় প্যাসেঞ্জার ওঠা-নামা করানো যাবে না, সাইড করে গাড়ি রেখে যানজট সৃষ্টি করা যাবেনা, উল্টো পথে বা রং সাইট দিয়ে মোটর সাইকেল চলাচল করতে পারবেনা।
আইন পাস না হয় হলো। এবার প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ ও আইন মানার অভ্যাস গড়া। আমাদের দেশে আইনপ্রয়োগ একটা বড় সমস্যা। যারা আইন প্রয়োগ করবেন তাদের মধ্যে চাঁদাবাজির প্রবণতা বেশি। গাড়ি থামিয়ে কালেকশন করবেন না আইন মানতে বাধ্য করবেন? দুটি তো একসাথে চলতে পারে না। আর আইন প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা হচ্ছে ক্ষমতা। আমাদের ধরলেই পরিচয় দেই আমি সাংবাদিক, আমি আইনজীবী, আমি শিক্ষক, আমি ডাক্তার, আমি অমুক নেতার শালার চাচাতো ভাইর বন্ধু, আমি পুলিশকর্তার দুঃসম্পর্কের নিকটআত্মীয় ইত্যাদি। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাছ বিচার করতে করতে কম্বলের মত পশমই থাকেনা। আর যাদের উপর প্রয়োগ হয় তাদের কোন ক্ষমতা নেই বা অন্যায়টাকে টাকার বিনিময়ে ফাদ ফাকরে ফেলেন। তবে যে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আইন পাস হলে কিছুটা তো কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করা হবে। দু-চারজন ক্ষমতা ও চাতুরতা দিয়ে বেরিয়ে গেলেও কিছু ফল পাওয়া যাবে। তাই এখনই সময় আইন পাস করার এবং আইন ব্যবহারকরার। আবারও বলছি, হেলায় সুবর্ণ সুযোগ হারাবেন না, প্রিয় রাষ্ট্রযন্ত্র।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট