logo
আপডেট : 16 August, 2018 02:08
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী বাংলাদেশ
ড. মোহাম্মদ হাসান খান

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী বাংলাদেশ

একটি দুঃসহ ভোরের কথা বলছি। একটি দুঃসহ সুবেহ সাদিকের গল্প বলছি। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। ফজরের আজান হচ্ছে। আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম। একজন মুসলমান আজান শুনে নামাজ পড়তে যাবে। অথচ সেদিনের সেনা ঘাতকেরা গেল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হল। দশ বছরের রাসেল ও চার বছরের সুকান্ত বাবুও বাদ গেল না। এরা কেমন মুসলমান যারা মানুষ হত্যা করে ? ওইদিন শুধু একজন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি। হত্যা করা হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতার মূল চেতনা, সংস্কৃতি ও সংবিধানকে। 

দেশ স্বাধীন হয়ে ১০০ বছর এগিয়ে ছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মাধ্যমে পেছাল আরও ১০০ বছর। শুরু হল ধর্মের  সাথে আমাদের সংস্কৃতি ও সংবিধানের সংঘাত ঘটানোর রাজনীতি। একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি তুলে সস্তা জনপ্রিয়তা নেয়ার জন্য সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম ঢুকানো হল। আর অপরদিকে ইনড্যামনিটি এ্যাক্ট জারি করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করা হয়। এ কেমন ইসলামী রাষ্ট্রযন্ত্র তারা তৈরি করল যেখানে হত্যার বিচার চাওয়া যায় না। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই থামেনি জাতীয় ৪ নেতাকেও হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও রেহানাকে দেশে আসতে দেয়া হয়নি। শুরু হয় বিদেশে তাদের রিফিউজি জীবন। ভারত তাদেরকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়। ১৯৮১ সালে তদান্তাধীন প্রেসিডেন্ট মেজর জিয়া ভারতের চাপের মুখে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ঢুকতে দিলেও ৩২ নম্বরে ঢুকতে দেয়নি। ৩২ নম্বরের রাস্তায় বসে আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিলাদ দেন।

পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশকে অনেক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সাক্ষী হতে হয়। ক্ষমতার পালাবদলে এদেশে পাকিস্তানী দোসররাও সরকার গঠনে সুযোগ পায়। রাজকারদের গাড়িতে ওড়ে স্বাধীনতার লাল সবুজ পতাকা। বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিতে চলে ইতিহাস বিকৃতির উৎসব। কিন্তু অপচেষ্টাকারীরা জানে না, ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু আদর্শের কোন মৃত্যু নেই। আদর্শই ব্যক্তিকে জীবিত রাখে যুগ যুগ ধরে। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করেন তিনি ইচ্ছা করলে ১৫ আগস্টের ঘাতকদের বিচার করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি, ঘাতকদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরি দেয়া হয়, গণহারে মুক্তিযুদ্ধা সেনা অফিসারদের হত্যা করা হয়। রাজাকার আলবদর বাহিনীর প্রধান গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। জেল থেকে মুক্তি দেন নিজামিকে, এসব কিছুই প্রমাণ করে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৮০ সালে যুক্তরাজ্যে শেখ মুজিব, তাঁর পরিবার ও চার নেতা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে একটি কমিটি করা হয়। এ কমিটি বাংলাদেশে আসতে চাইলেও জিয়া সরকার তাদের ভিসা দেয়নি। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। শেখ হাসিনাকে দমিয়ে রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠী কম চেষ্টা করেনি। ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু কন্যাকে হত্যার চেষ্টা করে তারা আবার চেয়ে ছিল এই বাংলাদেশ যেন আলো না দেখে, বাংলার পূর্ব আকাশে যেন আর সূর্য না উঠে। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বাঙালি জাতির আরেক আলোকবর্তিকা। যিনি আজ এদেশ তথা বাঙালিকে নিয়ে গেছেন মহাকাশে ও বিশ্বের বুকে এক নক্ষত্র হিসাবে।  ১৯৯৬ সালে পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর শেখ হাসিনার রাজপথে থেকেছেন। এ বছরই তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলার জনগণকে ঘুরে দাঁড়াতে বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা নিপীড়িত হয়েছেন, জেল জুলুম সয়েছেন, মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন কিন্তু পথহারা হননি। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে বিজয়ের পর বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়াল। স্বাধীনতার চেতনা সমুন্নত হল। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু হলো। বর্তমানে টানা দু মেয়াদে জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনা করছেন। তাঁকেও নিচিহ্ন করে দেওয়ার জন্য দেশীবিদেশী শত্রুরা বহুবার চেষ্টা করেছে। এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কন্যাকে হত্যার জন্য ১৯ বার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি এতে মোটেও ভীত নন। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ ও লালন করে বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করে দক্ষ হাতে দেশ পরিচালনা করে যাচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। ফলে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন রোলমডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হাজার বছরের পরাধীন জাতিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা। তিনি এদেশের মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন। তার বিনিময়ে স্বাধীন দেশে কেউ তাঁর রক্ত ঝরাবে, এটি ছিল তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অকল্পনীয় বিষয়। যার কারণে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েও অবাধে সাধারণ মানুষের সাথে মিশেছেন, সর্বত্র যাতায়াত করেছেন নির্দ্বিধায়। তাঁর পরিবারের মানুষজনও রাষ্ট্রীয় প্রটৌকল নিতে চাইতেন না। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ কামালসহ পরিবারের কেউই চাকচিক্য পছন্দ করতেন না। শিশু শেখ রাসেল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সামনের সড়কে একা একা সাইকেল চালাতো। বরেণ্য সাংবাদিক এ বি এম মুসা স্মৃতিকথায় লিখেছেন, শেখ রাসেল স্কুলে যাওয়ার সময়েও তার সাথে কোনো নিরাপত্তা বাহিনী থাকত না। কেবল শিশু রাসেল নয়, বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাই এভাবে চলাফেরা করতেন। রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি বঙ্গভবনে থাকেননি। অনেক শুভাকাক্সিক্ষ তাঁকে নিরাপত্তার জন্য বঙ্গভবনে যেতে বললেও তিনি যাননি। তিনি মনে করতেন, বঙ্গভবনে থাকলে তাঁর সাথে সাধারণ মানুষের দূরত্ব তৈরি হবে। স্বভাবতই তিনি জনগণ থেকে দূর থাকতে চাননি। ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান। তাঁর লেখা ‘ফ্যান্টম্স্ অব চিটাগং’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘এবারও আমি লক্ষ্য করলাম, তাঁর বাসায় কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। সব রকমের মানুষ সময়-অসময়ে যখন-তখন এসে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার চাইতো। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা লোকদের কোনো বাছবিচার নেই। এ কথা তুলতেই তিনি বললেন, “আমি জাতির জনক, দিন বা রাতে কোনো সময়েই তো আমি আমার দরজা বন্ধ করে দিতে পারি না।” বঙ্গবন্ধুর এমন সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে নিয়েছিল পঁচাত্তরের ঘাতকরা। ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এ কথা বঙ্গবন্ধুকে জানালেও তিনি গুরুত্ব দেননি। জওহরলাল নেহরুর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা আর এন কাও ১৯৮৯ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে সানডের সংখ্যায় লিখেছেন, ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আমি নিজে ঢাকায় এসে মুজিবকে এ ষড়যন্ত্রের খবর দিই। কিন্তু মুজিব সেটি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওরা আমার সন্তান। আমার কোনো ক্ষতি ওরা করবে না।’ শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ সালের মার্চে  তাঁর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ঢাকা পাঠান। শেখ মুজিবর রহমানকে তিনি জানান, সেনাবাহিনীর সাজোয়া ও গোলন্দাজ অংশের দুটি ইউনিটে তাঁর বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। এবারও বঙ্গবন্ধু এ সতর্কবার্তায় কান দেননি। কারণ তিনি ভেবেছিলেন, যাদের জন্য তিনি প্রাণ বাজি রেখেছিলেন, যাদেরকে তিনি সন্তান হিসেবে জানেন তারা তাঁকে কেন হত্যা করবে!

বঙ্গবন্ধু সবাইকে মহানুভবতা ও ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। এটিই শেষ পর্যন্ত তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়’ রচনায় আবদুল মান্নান তথ্য-প্রমাণসহ দেখিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন এমন অনেকেই পঁচাত্তরে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীতে উচ্চ পদে কর্মরত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এদের অনেকে ষড়যন্ত্র টের পেলেও তারা তা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেননি। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাত আটটায় বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির নিজ বাসায় ফিরেছিলেন। তাঁর সহকারী এ এফ এম মুহিতুল ইসলামের তথ্যমতে, সেদিন বঙ্গবন্ধু পরিবার রাত ১২টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন। গভীর রাতে ঘাতকরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে হামলা চালায়। তাদের গুলিতে প্রথম শহীদ হন শেখ কামাল। সর্বশেষ ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় মাত্র দশবছর বয়সী শেখ রাসেলকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মুহূর্তটি বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বর্ণনা দিয়েছিলেন মুহিতুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শেখ কামালকে হত্যার পর হত্যাকারীরা বেপরোয়া গুলি চালিয়ে বাড়ির উপরের দিকে যাচ্ছিল। উপরে উঠেই শুরু হয় নির্বিচার হত্যাকাণ্ড। চারিদিকে তখন শুধু গুলির শব্দ। উপরে তো তাণ্ডবলীলা চলছে। চারিদিকে একটা বীভৎস অবস্থা। ঠিক সে মুহূর্তে উপর থেকে চিৎকার শুরু করলো যে পাইছি পাইছি। এরপরে বঙ্গবন্ধুর একটা কণ্ঠ শুনলাম। তিনি বললেন, তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাস ? এরপরে ব্রাশফায়ার। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ আমরা আর শুনতে পাইনি।’ ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত অধ্যায় লেখা হল। সপরিবারে নিহত হলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। সে দিন তারা শুধুমাত্র জাতির জনককে হত্যা করেনি, একই সাথে হত্যা করতে চেয়ে ছিল বাঙ্গালীর সংস্কৃতি ও বাংলাদেশকে। তারা বাংলাদেশকে এবং বাঙ্গালীর কন্ঠ রোধ করতে চেয়েছিল। তাদের প্রকৃত লক্ষ ছিল বাঙ্গালী জাতি এবং বাংলাদেশকে অভিভাবকহীন করা। বাংরাদেশকে আবার পাকিস্তান তৈরী করা। তখন বাঙ্গালী বুঝেনি ’পিতা’ হারানোর বেদনা এতো দুঃসহ হবে। পুরো বাঙ্গালী জাতি যেন পিতৃহীন হয়ে গেল। ওই সময় বিদেশে ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তাঁরা প্রাণে বেঁচে গেলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যায় যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন তারা সবাই বঙ্গবন্ধুর কাছে আস্থাভাজন ছিলেন। খন্দকার মোশতাকরা এই আস্থার সুযোগ নিয়েই বেঈমানী করেছিলেন। ফলে বাংলাদেশের আকাশ থেকে সবচেয়ে বড় নক্ষত্রটি অকালে বিদায় নিলেন।

অন্যদিকে তাঁর মৃত্যুর পর দেশের অগ্রগতি থমকে দাঁড়িয়ে উন্নয়নের চাকা পেছনে ঘুরতে লাগল। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর আরেক নির্মম ঘটনার সাক্ষী হল বিশ^বাসী। কারাগারের অভ্যন্তরের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হল জাতীয় চার নেতাকে। ঘাতকদের কাছে এ চার নেতার অপরাধ ছিল ঘাতকদের দেয়া কোন পদ তারা গ্রহণ করেননি। তাঁরা প্রকৃত অর্থেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত ছিলেন। মৃত্যুকে বেছে নিলেও তারা ঘাতক নরপশুদের সাথে কোনো আপস করেননি। জিয়াউর রহমানকেও বঙ্গবন্ধু  স্নেহ করতেন। জাতির জনকের বাসায় তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিলো। বঙ্গবন্ধু তার জন্য উপ-সেনাপ্রধান পদ পর্যন্ত তৈরি করেছিলেন। ১৫ আগস্টের অন্যতম ঘাতক ফারুক রহমান অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে জানিয়েছেন, জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ ফারুক জিয়াউর রহমানকে মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা শোনান। জবাবে জিয়াউর রহমান ফারুক রহমানকে বলেছিলেন, ‘তোমরা করতে চাইলে করতে পারো। কিন্তু আমি তাতে যোগ দিতে পারব না।’ গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘দেশের রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করার প্রায় পাঁচ মাস আগে থেকেই ষড়যন্ত্রের কথা জিয়া জানতেন। কিন্তু সেনাপ্রধান অথবা রাষ্ট্রপতি কাউকেই তিনি এ কথা জানাননি। এটা তার পবিত্র দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা। সেদিক দিয়ে বিচার করলে মুজিব হত্যার পরোক্ষ দায় তিনি এড়াতে পারেন না।’ অথচ জিয়া এ বিষয়টি দায়িত্ববান কাউকে জানালেও ১৫ আগস্টের নির্মম ঘটনার সাক্ষী হতে হত না বিশ^বাসীকে। খন্দকার মোশতাকরা যেমন বিশ্বাসঘাতক ছিলেন, জিয়াউর রহমানও তেমনি ছিলেন।

স্বাধীনতার চারদশক পর জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করতে সমর্থ হয়েছেন। আদালত ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ১২ খুনির মৃত্যু দণ্ডাদেশ দেন। এর মধ্যে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ ও মুহিউদ্দিন আহমেদের ফাঁসি কার্যকর হয়। এখনো ৬ খুনি পলাতক রয়েছে। এদেরকে যদি দেশে এনে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করা যায় তবে বাঙালির কিছুটা হলেও দায়মুক্তি হবে। জাতীয় শোক দিবসকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার এই আবেদন রইল।

১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট আকাশবাণীতে শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার সংবাদ পর্যালোচনায় বলা হয়, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন লক্ষ লক্ষ লোক ক্রস ধারণ করে তাঁকে স্মরণ করছেন। মূলত একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’ আসলেই তিনি ৭৫ যিশু। আকাশবাণীর এ ভবিষ্যৎ বাণীই সত্যি হয়েছে। মুজিব হত্যার পর ঘাতকরা চেয়েছিল কেউ যেন তাঁর নাম উচ্চারণ না করে। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি। বরং আজ ঘরে ঘরে শ্রদ্ধার সাথে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করা হচ্ছে। হাজার অপচেষ্টাও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে মানুষের মন থেকে মুছে দিতে পারেনি। আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শোককে শক্তিতে পরিনত করতে হবে। পুরো জাতি এখন শোককে শক্তিতে পরিনত করে দেশ গঠনের কাজ করে যাচ্ছে। যার ফলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা এখন বাস্তবায়নের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। এ শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি তাঁর স্বরনে কিছু ভাল কাজ করতে প্রতিটি সচেতন নাগরিককে অনুরোধ জানাই। তবেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রকৃত অর্থে শ্রদ্ধা জানানো হবে। আসুন আজ আমরা সফথ নেই পিতা, আমরা তোমার আদর্শকে ভুলি নাই তোমাকে ভুলবো না, তোমার আদর্শে স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে এগিয়ে যাবো।

পরিশেষে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পিতার উদারতা, দক্ষতা নিয়ে দেশ পরিচালনা করছেন। দেশের অভ্যন্তরের শত্রুদের সম্পর্কেও তিনি সচেতন থাকবেনÑএই প্রত্যাশা করছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুব নিকটেজনের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে অসচেতন ছিলেন। আমরা আশা করব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই ভুল করবেন না। আমরা চাই মুজিব থেকে যেমন হাসিনা, তেমনি হাসিনা থেকে জয়। বাংলাদেশ এই চক্রে আবর্তিত হোক। বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক। কোন স্বাধীনতা বিরোধী চক্র, ইতিহাস বিকৃতিকারী যেন আর কখনও ক্ষমতায় আসতে না পারে, কোন অশুভ শক্তি যেন এ দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত না করতে পারে সেজন্য আমাদেরকেও সচেতন থাকতে হবে। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করলেই বাংলাদেশ একটি সুখী, সমৃদ্ধ, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলাদেশে পরিণত হবে।

 

লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট,  সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, চাঁদপুর জেলা।