তুহিন সানজিদ: সিম্পল জীবন। নেই ফ্যাশনের ছোঁয়া। নেই নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা। চলনে বলনে নেই আধুনিকতার রেশ। যা বিশ্বাস করেন তাই বলে ফেলেন। কুঁড়ে ঘরেও যেমন, রাজপ্রসাদেও তেমন। ক্ষমতা তাদের কাছে ভোগের নয়, বিলিয়ে দেয়ার। তাইতো ভারত উপমহাদেশে তারা খেতাব পেয়েছেন অগ্নিকন্যা হিসাবে। একজন বাংলাদেশের প্রভাবশালী মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপধ্যায়।
কাঁটা তারের বেড়ার দুপাড়ের বাসিন্দা তারা। তাতে কি? এ দুজনের মধ্যে মিল অনেক। এখনও মতিয়া চৌধুরী বাজার করেন কাওরান বাজারের ফুটপাতে। আর মমতা হেটে পাড়ি জমান মাইলের পর মাইল।
‘ম’ আদ্যাক্ষর দিয়েই নাম শুরু দু’জনের। ভাষাও বাংলা। দু’জনই স্বখ্যাত রাজনীতিক। বিপ্লবী, প্রতিবাদি আর সাহসি।
দু’জনই একাধিকবারের মন্ত্রী। নির্লোভ, সততা ও সাদাসিদে জীবনযাপনের জন্য তাদের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি। উপমহাদেশের এই দুই বিখ্যাত প্রবীণ নারী রাজনীতিকের মধ্যে আরো একটি বিষয়ে মিল রয়েছেÑ তা হলো নারী সাজের অনিবার্য প্রসাধনী লিপস্টিক কখনোই লাগেনি তাদের ঠোঁটে। মেকআপ তো দূরের কথা।
বিশ্বের অন্যান্য নারী মন্ত্রী ও রাজনীতিকরা লাখ লাখ টাকা ব্যয় করেন পোশাক, অলংকার আর মেকআপের জন্য। অনেকে আবার মেকআপ এবং হেয়ার স্টাইলের জন্য আলাদা বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেন । তাদের এক মাসের বেতনই কয়েক লাখ টাকা। তাদের অফিসে যাবার আগে মেকআপ, হেয়ার স্টাইল এক রকম। আবার দলীয় সভা বা সেমিনারে যাবার সময় ভিন্ন। এক অলংকার আর পোশাক দ্বিতীয় দিন পরেন না এমন নারী রাজনীতিকও আছেন এই উপমহাদেশে। পরেন এক থেকে দশ লাখ টাকা মূল্যের পোশাক। আবার আছে হাজার জোড়া জুতা। সেদিক দিয়ে এই দুই অগ্নিকন্যা একেবারেই আলাদা। হাতের মুঠোয় অসীম ক্ষমতা থাকার পরও যেমন লোভ কখনো তাদের স্পর্শ করতে পারেনি, তেমনি স্পর্শ করেনি দামি প্রসাধনীও। জীবনের এই প্রান্তে এসে বদলাননি তারা একটুও। এখনো পরেন স্বল্প মূল্যের আটপৌরে শাড়ি আর সাধারণ চটি স্যান্ডেল।
এখনো সেই মতিয়া:
বয়স ৭৬ বছর। পরনে সেই কম দামের মোটা কাপড়। চলাফেরা সেই ছাত্র জীবনের মতোই সাদামাটা। নেই সাজগোজ। সরকারি গাড়ি কিংবা অফিসে এসি থাকলেও ব্যবহার করেন না। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী হলেও চলার পথে পুলিশ প্রটেকশনের গাড়ি নেয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। সম্প্রতি সরকারের দেয়া কোটি টাকার বিলাশবহুল বিএমডব্লিউ গাড়িটিও ফেরৎ দিয়েছেন।
রাষ্ট্রীয় কাজে শত ব্যস্ততার মধ্যেও নিজেই বাজার-সদাই করেন। কারওয়ান বাজার থেকে সংসারের জন্য চাল, ডাল, শাকসবজি, মাছ ও মাংস কেনেন দরদাম করে। প্রায়ই তাকে দেখা যায় কারওয়ান বাজারের আড়ৎ থেকে বিক্রি না হওয়া বাতিল আলু, পটল ও বিভিন্ন ধরনের সবজি বেছে বেছে কিনতে। খাদ্য তালিকায় আভিজাত্যের ছাপ নেই। মোটা চালের ভাত, শাকসবজি, ভর্তা আর তরি-তরকারিই থাকে খাদ্য তালিকায়। বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তার কাঁধে। সাপ্তাহিক ছুটি কিংবা সরকারি বন্ধের দিন ছাড়া ঘুম থেকে ওঠেন ভোরে। সকাল ৮টার মধ্যে নাশতা পর্ব শেষ করেন। সোয়া ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকার লোকজন ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সাক্ষাৎ দেন। এরপর সাড়ে ৯টার মধ্যে রাষ্ট্রীয় কিংবা দলীয় কর্মসূচি না থাকলে সচিবালয়ের নিজ দফতরে পৌঁছান। বিকাল ৫টা পর্যন্ত টানা আট ঘণ্টা অফিস করলেও সরকারি অর্থে কোনো খাবার গ্রহণ করেন না।
সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৫ বার জেলে গেছেন। বহুবার আহত হয়েছেন পুলিশী নির্যাতনে। বছরের পর বছর আত্মগোপনে কাটিয়েছেন। কিন্তু মাথানত করেননি। আর্থিক সমৃদ্ধির প্রলোভন দেখানো হয়েছে। তবুও নিজের অবস্থান থেকে একচুলও নড়েননি। এজন্য মতিয়া চৌধুরীর নামটি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও সম্মানের সঙ্গে উচ্চারণ করেন।
তার জন্ম ১৯৪২ সালের ৩০ জুন। পিরোজপুরের নজিপুর উপজেলার মাহমুদকান্দায়। পিতা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন মাদারীপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মা নুরজাহান বেগম গৃহিণী। লেখাপায় হাতেখড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের এক গৃহশিক্ষকের কাছে। পিতার চাকরির সুবাদে মতিয়া চৌধুরীর শৈশব কেটেছে মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও জামালপুর শহরে।
১৯৫৮ সালে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কামরুন্নেসা গার্লস কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্টিক পাস করেন। কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ইডেন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৬২ সালে বিএসসি পাস করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৪ সালের ১৮ জুন পারিবারিকভাবেই খ্যাতিমান সাংবাদিক বজলুর রহমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৭৩ সালে ন্যাপের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৯ সালে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ১৯৯৬ সালের পর থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যতবারই সরকার গঠন করেছে ততবারই তিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন।
স্বাধীনতা-পূর্বকালে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে তার বাগ্মিতা, সংগ্রাম ও তেজস্বিতার কারণে ষাটের ছাত্ররাজনীতিতে মস্কোপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা মতিয়া চৌধুরীর নাম দিয়েছিলেন অগ্নিকন্যা। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত সাধারণ মানুষ তাকে ভালোবেসে অগ্নিকন্যা বলেই ডাকেন, ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে কলঙ্কহীন এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। প্রসাধনের আবরণে নয়, সততা, কর্তব্য-নিষ্ঠা, নীতি আর আদর্শের সৌন্দর্যে অপরূপা মতিয়া চৌধুরী একজনই।
বদলাননি মমতা:
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৫৫ সালের ৫ জানুয়ারি। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এবং সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা-সভানেত্রী। তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। বাগ্মী রাজনীতিবিদ। তিনি তাঁর অনুগামীদের কাছে ‘দিদি’ নামে পরিচিত। ২০১১ সালে তাঁর নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫৫ সালের ৫ জানুয়ারি কলকাতার হাজরা অঞ্চলে এক দরিদ্র নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারে জš§গ্রহণ করেন। পিতা প্রমীলেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। মা গায়ত্রী দেবী ছিলেন গৃহবধূ। তিনি যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে বি.এ, কলকাতার শ্রীশিক্ষায়তন কলেজ থেকে বি.এড. ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে কলকাতার যোগেশচন্দ্র চৌধুরী আইন কলেজ থেকে এলএল.বি. ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজনীতিতে প্রবেশ ছাত্রাবস্থাতেই। শিক্ষাজীবন শেষ করার পর সংসার চালানোর রাজনীতিতে আসার আগে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন কিছুদিন। কখনো টিউশনি এমনকি দোকানে সেলস গার্লসের কাজও করেছেন।
বহু গুনে গুনান্বিত মমতা লিখেছেন বহু কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ, এমনকি উপন্যাসও। চিত্রশিল্পী হিসেবে ছবিও আঁকেন। তার আঁকা ছবি বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকার পুরোটাই তিনি জমা দেন দলের ফান্ডে।
৭০-এর দশকে অত্যন্ত অল্প বয়সে কংগ্রেস (আই) দলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কর্মজীবনের সূচনা হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি স্থানীয় কংগ্রেস নেত্রী রূপে পরিচিত হয়। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কংগ্রেস (আই)-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাজিত করে সাংসদ নির্বাচিত হন। সেই সময় তিনি ছিলেন দেশের সর্বকনিষ্ঠ সাংসদের অন্যতম। এই সময় তিনি সারা ভারত যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকও মনোনীত হয়েছিলেন।
১৯৯৭ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস-এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ‘সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস’ নামে নতুন দল গঠন করেন। কিছুদিন পর তাঁর দল দীর্ঘকাল বামফ্রন্ট-শাসিত পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধীশক্তিতে পরিণত হয়।
১৯৯৮ সালের ১১ ডিসেম্বর সমাজবাদী পার্টির সাংসদ দারোগা প্রসাদ সরোজ ‘মহিলা সংরক্ষণ বিলের’ বিরোধিতায় লোকসভার ওয়ালে নেমে গেলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জামার কলার ধরে টানতে টানতে তাঁকে ওয়ালের বাইরে বের করে দেন। নন্দীগ্রাম আন্দোলনও মমতাকে জনপ্রিয়তার চূড়ায় তুলে দেয়।
ভারতবর্ষে অগ্নিকন্যার পাশাপাশি ‘দিদি’ হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত মমতা ব্যানার্জি। অতি সাধারণ এবং সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত মমতা এখনো পড়েন তাঁতের সাদা শাড়ি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীই শুধু নন, ভারতের রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনীতিক হওয়ার পরও দক্ষিণ কলকাতার ঘিঞ্জি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে টালির বাড়িতে থাকেন মমতা ব্যানার্জি। এখনো অল্প বৃষ্টি হলেই তার বাড়ির সামনে চলাফেরার পথে জমে যায় পানি। তখন মমতা বাড়ির সামনে পাতা ইটের ওপর পা রেখে হেঁটে বড় রাস্তায় গিয়ে গাড়িতে ওঠেন। দু’বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েও সরকারি টাকায় বাড়ির সামনের রাস্তা পাকা করেননি তিনি।
মমতা সাধারণ খাবার খান, সাধারণভাবে চলাফেরা করেন। শত শত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রহরা তিনি পছন্দ করেন না। জনগণের নেত্রী, তাই জনগণের সঙ্গেই চলাফেরা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পরিবারের কাউকে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাননি।
প্রকৃতি ভালোবাসেন মমতা। তাইতো সময় পেলেই বেরিয়ে পড়েন দার্জিলিংয়ের পাহাড় বা মেদিনীপুরের জঙ্গলে। নিজেই ক্যামেরা দিয়ে প্রকৃতির ছবি তোলেন। ফটোগ্রাফি তার শখ। সময় পেলেই শোনেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, পাঠ করেন নজরুলের কবিতা। হাওয়াই চটি, আটপৌরে শাড়ি এখনও পরেন।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অর্থ আর স্বার্থের পেছনে ছোটেননি উপ মহাদেশের জনপ্রিয় এই দুই নারী রাজনীতিবিদ। প্রসাধনের আবরণে নয়, সততা, কর্তব্য-নিষ্ঠা, নীতি আর আদর্শের সৌন্দর্যে নিজেদেরকে বিলিয়ে দিয়েছেন সাধারণ জনতার মাঝে। শত লোভের হাতছানিতে বদলাননি কখনও। আসলে মমতা, মতিয়ারা বদলান না। ক্ষমতাও তাদের বদলাতে পারেনি।