॥ মনিজা রহমান ॥
মাঝে মাঝে নিজেকে খুব তুচ্ছ লাগে মা। মনে হয় মাটিতে মিশে যাওয়া কোন তৃণ কিংবা কীট। হাঁটতে গিয়ে পথচারী পায়ে মাড়িয়ে যায়। মা, একমাত্র তোমার কাছেই আমি মহামূল্যবান, পৃথিবীতে আর কোথাও নয়।
আমাদের পুরনো ঢাকার পুরনো বাড়ীতে খুব ভুতের ভয় ছিল। বাবা বাড়ীটা কিনেছিল এক হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে। যে পরিবারের বাবা ও বড় ছেলেকে গলা কেটে হত্যা করেছিল দাঙ্গাবাজরা। বাবা আর ছেলের অতৃপ্ত আত্নার হাহাকার মিশে ছিল বাড়ীর প্রতিটি কোনে কোনে। ছোটবেলায় সন্ধ্যার পরে ঘর থেকে উঠানে যেতে অজানা আতংক ভর করতো মনে। ‘মা’ বলে ডাক দিলেই তুমি এসে পাশে দাঁড়াতে।
মা তোমার মতো নির্ভরতার জায়গা কোনদিন আমার ছিল না। স্কুলে একবার ভুলে সহপাঠির বই ছিড়েছিলাম বলে ও শিক্ষককে বলে দেবার হুমকি দিয়েছিল। তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। বাসায় ফিরে আনন্দরত ছোট ভাই-বোনদের দেখে মনে হয়েছিল, ওরা কত সুখী। আর আমার মত কষ্টে কেউ নেই। মা, একমাত্র তুমি আমাকে স্বান্ত্বনা দিয়েছিলে। আমার সঙ্গে গিয়েছিলে শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে।
প্রথম শ্রেণীর প্রথম দিন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায় সংবর্ধনা পর্যন্ত তুমি আমার সঙ্গে গিয়েছ। তুমি সব সময় আমার পাশে ছিলে মা। আজ এই ভিনদেশে অচেনা শহরে আমার সব আছে। কিন্তু হঠাৎ যখন পাশে তাকিয়ে দেখি, তুমি আমার পাশে নেই, তখন খুব নি:স্ব লাগে মা। তুমিই একমাত্র মানুষ, যার কাছে আমার কোন দোষ ছিল না। মা, তোমার কাছেই আমি শুধু মহামূল্যবান, আর কারো কাছে নয়।
রাতে যখন পড়তে বসতাম, তুমি পাশে বসে থাকতে সেলাই হাতে। আমার হাতের লেখা ভালো ছিল না। তুমি গোটা গোটা অক্ষরে সব নোট কপি করে দিতে। কখনও বসে বসে পড়তে লাইব্রেরী থেকে আমার আনা কোন বই। আমার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাবার শখ ছিল। বাবা একা যেতে দিতে চাইতো না। তুমি আমার সঙ্গে যেতে পাবলিক লাইব্রেরী কিংবা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে। সেই পুরনো ঢাকা থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যেতাম আমরা।
মা, আমি তোমার ছায়া ছিলাম না। তুমিই ছিলে আমার ছায়া।
সাহিত্যিক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম চলে যাওয়ার খবর পেয়ে, মা, আমি সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে ফোন করেছিলাম। তিনি আমাদের পরিচিত কেউ নন। কিন্তু আমরা দুজনেই তাকে শ্রদ্ধা করতাম। একবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতা করার সময় তুমি পাশের একজনকে বলেছিলে, ওনার কথা আমার খুব ভালো লাগে। পাশের ভদ্রমহিলা হেসে বলেছিল, উনি আমার স্বামী। সামান্য এইসব স্মৃতি তোমার কাছে হিরন্ময় হয়ে ছিল। আমরা সময় পেলে বড় খাটটাতে বসে সেই দিনগুলির কথা বলতাম।
আমাদের টানাটানির সংসারে যখনই তোমার কাছে কিছু চাইতাম, তুমি যেভাবে হোক কিনে দিতে। কারণ তোমার নিজের কিছু কেনার ছিল না। কখনও মার্কেটে গিয়ে শাড়ি কিংবা গয়না কিনতে দেখিনি তোমাকে। অথচ এই আমি দেখ প্রতিদিনই যেন কিনি, তবু কোন তৃপ্তি নেই।
বরিশালের এক অজ পাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা মানুষ তুমি মা। তোমার বাড়ি থেকে হাটে যেতে আঠারোটা সাঁকো পার হতে হয়। সেই তুমি অনুরোধের আসরে গান শুনতে চেয়ে চিঠি পাঠাতে। আজও তুমি একবার শুনে বলে দাও- কোনটা খন্দকার ফারুক আহমেদ আর কোনটা মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর কণ্ঠ! তোমার যে একটা শিল্পী মন ছিল, কেউ কখনও জানতে চায়নি।
কেউ কখনও বলেনি মা, তুমি কত সুন্দর! গেন্ডারিয়া ফজলুল হক মহিলা কলেজে বিএ ক্লাসের ছাত্রীদের সেই গ্রুপ ছবিতে তুমি ছিলে সবচেয়ে জ্বলজ্বলে। তোমার মেয়ে হিসেবে নিজেকে খুব অসুন্দর মনে হত। সেই তুমি এখন বুড়িয়ে গেছে। বহুমুত্র রোগ কেড়ে নিয়েছে তোমার সব সৌন্দর্য্য, শক্তি, জীবনী।
তবু আজও আমি যখন বাড়ির সবচেয়ে বড় ঘরে, বড় খাটটাতে, গোলাপী মশারীর নীচে ঘুমিয়ে থাকা একজন পবিত্র, জোতির্ময় মানুষকে দেখি, মনে হয়, তুচ্ছ যে আমি, সেই আমারও এই পৃথিবীতে কোথাও যাবার জায়গা আছে। এখনও আমার কষ্টের কথা শোনার কেউ আছে।
মা, এই এত বড় পৃথিবী কত শত কোটি মানুষ, একমাত্র তোমার কাছেই আমি মহামূল্যবান, রত্নখচিত মনি।
লেখক: বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্রীড়া সাংবাদিক ও কবি।
বর্তমানে নিউইয়র্ক প্রবাসী
.................................................................................................................................................................
[প্রিয় পাঠক, নিউইয়র্ক মেইল যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত সর্বাধিক জনপ্রিয় বাংলা অনলাইন। এই অনলাইনের ”আমার চোখে আমার মা’” বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। মা’কে নিয়ে আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। আপনি এবং মায়ের ছবিসহ মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।]
এছাড়া প্রবাসে আপনার কমিউনিটির নানান খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।