আবহাওয়াটা অন্যদিনের চেয়ে আজ একটু আলাদা। হালকা রোদ, অল্প অল্প বাতাস, আকাশে মেঘের উড়াউড়ি। পড়ন্ত বিকেল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলায় ঢুকতেই সুলতানের দেখা হয়ে গেল জেসিয়া ইমরোজ ডরোথীর সঙ্গে। গায়ে টাঙ্গাইল শাড়ি। চোখে নীল সানগ্লাস। পায়ে উঁচু হিল। খোপায় গাঁদা ফুল। হাতে নিজের লেখা প্রকাশিত নতুন উপন্যাস ‘কী করে ভালোবাসি তোমায়’। এটা ডরোথীর দ্বিতীয় উপন্যাস।
সামনে হেঁটে যেতেই সুলতান বলল
-ম্যাম, আপনার লেখা ভালো লাগে। আপনাকে দেখতেও বেশ লাগছে।
-তাই! থ্যাংকু।
-গতবার বইমেলায় আপনার ‘হৃদয়ে প্রেম’ উপন্যাসটা কিনেছিলাম। পড়ে বেশ মজা পেয়েছি। এবার আপনার বই খুঁজলাম, কিন্তু কোন প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে, না জানার কারণে পেলাম না। পত্রিকায় আপনার নতুন বইয়ের বিজ্ঞাপনও দেখলাম না। ভাবছিলাম বইমেলায় গেলে আপনার সঙ্গে দেখা করবো। সত্যিই আজ পেয়ে অনেক খুশি লাগছে। ম্যাম আপনার এবার কী বই বের হলো?
-‘কী করে ভালোবাসি তোমায়’, উপন্যাস।
-ওকে।
-ম্যাম, আপনি কী শুধু লেখেন-ই...
-হ্যাঁ, লেখাই আমার পেশা।
-আচ্ছা ম্যাম, আপনার যদি সময় হয় চলেন লেখক কুঞ্জে বসি?
-ঠিক আছে আজ নয়, অন্যদিন। আজ পাঁচটায় টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিতে হবে। ধন্যবাদ।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বের হয়ে সুলতান চলে আসল বাংলা একাডেমির লিটল ম্যাগ চত্বরে। হঠাৎ সেলফোনে ক্রিং ক্রিং শব্দ। জিন্সের প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে রিসিভ করতেই বুবলীর ফোন।
-হ্যালো.. তুমি কোথায়?
-বইমেলায়।
-অফিস থেকে কখন বের হইছো?
-সাড়ে চারটার দিকে।
-বাসায় কখন আসবা?
-রাত হবে।
-আসার সময় এককেজি আটা, লবণ, স্বপ্নের জন্য দুধ নিয়ে আইসো তো..।
-আচ্ছা আর কিছু লাগবে?
-না।
স্বপ্ন ওদের একমাত্র পুত্র সন্তান। তিন বছর ধরে সুলতান-বুবলীর একসঙ্গে পথচলা। বুবলী যখন ইন্টারমেডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে, তখন বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিবারের পক্ষ থেকে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় সমন্ধ আসে সুলতানের পরিবারের পক্ষ থেকে। তখন সুলতানের সঙ্গে বিয়ে হয়। একটি বিদেশি এনজিওতে চাকরি করে সুলতান। ঢাকার মতিঝিল কলোনীতে দুইরুমের একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বসবাস করে সে। ছোট্ট সংসার।
লিটল ম্যাগ চত্ত্বরে এসেই দেখতে পেল একটি টেলিভিশনের বইমেলা নিয়ে লাইভ প্রোগ্রাম। কবি, সাহিত্যিকদের ভিড়-ভাট্টা। সামনে এগিয়ে যায় সুলতান। লালচে পাঞ্জাবী পড়া, হাতে চুড়ি, পায়ে স্যান্ডেল পড়ে একজন উপস্থাপক সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। লেখকদের চেয়ে নারী লেখকদের সংখ্যাই বেশি। সবাইকে আবার দেখতে বেশ সুন্দরী। নানান সাজগোঁজ করে এসেছেন তারা। সবার হাতেই নতুন প্রকাশিত বই। এ সময় সুলতানের সেলফোনে রশিদের ফোন।
-দোস্ত তুই কোথায়?
-আমি তথ্যকেন্দ্রের সামনে।
-আরে নজরুল মঞ্চের সামনে চলে আয়। সেলফি তুলবো।
-কার সঙ্গে তুলবি? কোনো লেখকের সঙ্গে?
-গতকাল টেলিভিশনে টকশোতে অংশ নিয়েছিলেন জনপ্রিয় লেখিকা টি এস মারিয়া। তার সঙ্গে।
সুলতান চলে আসল নজরুল মঞ্চের সামনে। অনেক লোকের ভিড়। মঞ্চের ওয়ালে গাদা গাদা করে বসা বইমেলায় আগত পাঠক-বইপ্রেমীদের। ওরা সেলফি তুললো। সময় তখন সন্ধ্যা সাতটা। সুলতান ওখান থেকে বের হয়ে চলে আসল। বাসায় ফিরতে হবে। সকালে তো আবার অফিস আছে। রওয়ানা হলো বাসার উদ্দেশে।
রাস্তায় প্রচ- জ্যাম। গাড়ি, গাড়ি আর গাড়ি। শাহবাগ পার হতেই লাগল চল্লিশ মিনিট। বাস এক মিনিট চলে তো পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। লোকাল বাসে এ কারণেই উঠতে চায় না সুলতান। কিন্তু কিছু করার নেই। মধ্যবিত্তের ফ্যামিলিদের ঢাকায় বাসা ভাড়া দিতেই যেখানে হিমশিম, সেখানে সিটিং সার্ভিস বাসে যাতায়াত- ইচ্ছে থাকলেও হয় না। যে বেতন তাতে মাস শেষে যে টানাপোড়েন। বাসায় পৌঁছাল সুলতান। তখন ঘড়ির কাঁটা ঠিক দশটার ঘরে। বাসায় পৌঁছেই দেখে বউয়ের গোমরা মুখ। আর দেখবেই না কেন, স্বপ্ন ঘুমাবে, ঘুমানোর আগে তাকে দুধ খাওয়াতে হবে, কিন্তু বাসায় দুধ নেই। সুলতান এত দেরি করে বাসায় এল যে স্বপ্ন তখন ঘুম। ডাইনিং টেবিলের ওপর আটা, লবণ ও দুধের ব্যাগটা রেখে বেডরুমে ঢুকতেই বুবলীর জিজ্ঞাসা
-তোমার কয়টা বই বের হয়েছে যে রোজ রোজ বইমেলায় যাও? জীবনে তো একটা শব্দও লিখতে দেখলাম না।
সুলতান কোনো উত্তর দেয় না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কারণ সে জানে বউ এখন চরম হট। কিছু বললেই আরো চেঁচামেঁচি করবে। তারচেয়ে বরং চুপ করে শোনাই শ্রেয়। কিছুক্ষণ চুপ থাকলে ও (বুবলী) এমনিতেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সুলতান কাপড় চেঞ্জ করে হাত মুখ ধুয়ে বুবলীকে জড়িয়ে ধরে বলল
-জানু, খাবার দাও। পেটে প্রচ- ক্ষুধা।
-বুবলী বকতে বকতে রান্না ঘরে গিয়ে ডাইনিংয়ে খাবার দিল। সুলতান খাওয়া শুরু করল। খেতে খেতে বলল, রাস্তায় এত্ত জ্যাম, কী করে বলো তাড়াতাড়ি বাসায় আসি? আর ভাললাগে না।
ডাইনিং রুমের পূর্ব পাশের রুমটায় গিয়ে বুবলী টেলিভিশন অন করে টিভি দেখতে লাগল। সুলতান খাচ্ছে। রুমে দুইটা বুকসেলফ। সেলফগুলোতে অনেক বই। অথচ দুইজন যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সুলতান সিরিয়াস পাঠক। বুবলী এসব বই কোনোদিন ছুঁয়েও দেখে না। রান্না-বান্না, সন্তান, পরিবার নিয়েই তার সময় কাটে। সুলতান প্রতিদিন কিছুটা সময় বই পড়ে কাঁটায়। ছোটবেলা থেকেই বইপড়ার নেশা। এই নেশাটা এখনো ছাড়তে পারেনি। বই তো পড়েই, সঙ্গে বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখক পরিচিতি, লেখকের ছবিও সিরিয়াসভাবে দেখে। এটা তার প্রিয় শখ।
ফাগুনের বিকেল। আকাশে মেঘ। বৃষ্টি আসবে আসবে বলে মনে হচ্ছে। আজও অফিস থেকে বের হয়ে চলে এলো বইমেলায় সুলতান। শাহবাগে বাস থেকে নেমে ফুলের দোকানগুলোর পাশে চায়ের দোকানে গেল। একটি টোস্ট বিস্কিট, এক গ্লাস পানি আর এককাপ চা খেয়ে হাঁটতে লাগল টিএসসির দিকে। হেঁটে যাচ্ছে।
টিএসসি থেকে বইমেলা গেইট পর্যন্ত লম্বা লাইন। সুলতান লাইনে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে গেইটের দিকে যাচ্ছে। লাইনে সুলতানের সামনে দশ-বারোজন তরুণ-তরুণী। পেছনেও। যেন এক উৎসবমুখর বিকেল।
বইমেলায় সোহরাওয়ার্দীর গেইটে ঢুকেই চলে এল যেখানে মিডিয়াদের অবস্থান ঠিক সেখানে। এখান থেকেই টেলিভিশন চ্যানেলগুলো লাইভ প্রোগ্রাম করে। আজও চ্যানেলগুলোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই লাইভ বইমেলা প্রতিদিন শুরু করবে। সুলতান দেখতে পেল তিনজন লেখক বসে আছে। পাশে গিয়ে পরিচিত হলো। তিনজনই গল্পকার। সুলতান তো অনেক আনন্দে উদ্বেলিত। তাদের নাম জিজ্ঞেসে করতেই জানালেন- নাদিয়া জাহান, নুসরাত ইশরাত ও রানী বেগম। লেখিকাদের নামগুলো যেমন সুন্দর, তেমনি দেখতেই ঠিক বলিউডের নায়িকাদের মতো। সুলতান জিজ্ঞেস করল
-আপনাদের এবার কী কী বই বের হয়েছে ?
-নুসরাত জানাল, আমাদের তিনজনের গল্পের বই এসেছে।
-আপনাদের অভিনন্দন। আপনারা কীভাবে লেখেন এত সুন্দর করে?
-নাদিয়া বলল, কই এত্ত সুন্দর লিখলাম! ভালো লিখলে তো এত্তদিনে একটা পুরস্কার পেয়ে যেতাম।
-রানী বলল, ভাই আপনি (সুলতান) মনে হয় ভালো পাঠক, আসলে আমরা লেখার চেষ্টা করি।
-সুলতান বলল, গত দুই বছর ধরে বইমেলায় আমি নিয়মিত আসি। কথাসাহিত্যে আমার একটু দুর্বলতা আছে। তবে কবিতারও খোঁজ রাখি। কিন্তু একটা বিষয় আমার একটু জানার আছে। গল্প বা উপন্যাসে নারী লেখিকারা যতদূর এগিয়ে আছে, কবিতায় কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত কোনো নারী লেখক পেলাম না। আপনারা কী বলেন?
-নুসরাত বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। নারীরা তো জীবন, বাস্তবতা, সংসার-এসব সরাসরি মুখোমখি হয়। সেজন্য নারীরা লেখকরা কথা, গল্প বলার চেষ্টা করে। এজন্য হয়তো কবিতায় কেউ ওভাবে যায় না।
-সুলতান বলল, তা ঠিক। আপনাদের ধন্যবাদ।
ওখান থেকে সুলতান চলে আসল বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে। সাথে তার কয়েকজন বন্ধুও যোগ দিল। রাশেদ সুলতানকে বলল, আচ্ছা, একটা বিষয় খেয়াল করছস? নারী লেখকরা যেমন স্মার্ট, পরিপাটি দেখি, পুরুষ লেখকদের তা পাইনা। কারো চুল লম্বা, কেউ আউলা-ঝাউলা। মিন্টু বলল, ফেসবুকে দেখি নারীরা কবিতা পোস্ট করলেই অনেক লাইক পড়ে। পুরষদের পোস্টে লাইক অনেক কম হয়। সুলতান বলল, চল কফি খাই। রাশেদ বলল, চল। ওরা চলে আসল আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনের পাশে কফির দোকানে।