দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বমঞ্চে এখন সরব পদচারনা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। আস্থা ও নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে তারা কাজ করছেন। বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনছেন গৌরব ও সম্মান। শান্তি ও মানবতা রক্ষায় লাল-সবুজের পতাকাকে তুলে ধরছেন স্ব-মহিমায়। সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক কাজী মুহা: আফিফুজ্জামান (কাজী সোহাগ) সেনাবাহিনীর একটি উচ্চ পদস্থ টিমের সঙ্গে গিয়েছিলেন মধ্য আফ্রিকায়। সেখানে সরেজমিনে দেখেছেন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম। নিউইয়র্ক মেইলের জন্য তিনি লিখেছেন ১০ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ পড়ুন তার চতুর্থ পর্ব।
চারদিকে অস্ত্রের ঝনঝনানি। সতর্ক আর তটস্থ থাকতে হয়। কারণ যে কোন সময় হতে পারে বড় ধরণের আক্রমনের ঘটনা। কোমরে সব সময় রাখতে হয় গুলিভর্তি অস্ত্র। বাথরুমে গেলেও সঙ্গী হিসেবে থাকে অস্ত্র। বিশ্রামে গেলেও সশস্ত্র হয়ে প্রস্তুত থাকতে হয়। ঠিক এরকম একটি পরিবেশে মধ্য আফ্রিকার দুর্গম অঞ্চলে কাজ করছেন ১৮ জন নারী শান্তিরক্ষী। এর মধ্যে ১০ জন রয়েছে সেনাবাহিনীর, ২ জন নৌবাহিনীর আর মেডিকেল টিমের ৬ জন।
প্রতিনিয়ত মৃত্যু হুমকি নিয়ে জীবনবাজি রেখে চলেছেন তারা। পরিবার পরিজন ফেলে লাল-সবুজের পতাকার জন্য কাজ করছেন বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮ হাজার কিলোমিটার দুরত্বে। শুধু তাই নয় জাতিসংঘের অধীনে থাকা বিশ্বের ২১টি দেশের শান্তিরক্ষীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন বাংলাদেশী নারী শান্তিরক্ষীরা। শত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে মিশনের প্রতিটি দিন অতিবাহিত করছেন তারা।
বাংলাদেশ থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণ এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সহায়তা করছে বলে তারা জানান।
নারী শান্তিরক্ষীরা বলেন, মিশনে কাজ করা নি:সন্দেহে দুরুহ ব্যাপার। অনেক কিছু মোকাবেলা করে এখানে থাকতে হয়। অবদান রাখতে হয় বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায়। তারা জানান, এখানে যেসব সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে তারা খুবই হিংস্র্র। তাদের মোকাবেলার জন্য অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হয়।
নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি ভাষাগত সমস্যা, দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা। সবচেয়ে বড় সমস্যা সংস্কৃতিক। নানা দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
নারী শান্তিরক্ষীরা বলেন, তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে তারা কখনও পিছপা হন না। দেশ আর পতাকা এই দুটো বিষয় মাথায় রেখে কাজ করি। তারা জানান এ ধরণের মানষিকতা রেখে কাজ করার তৃপ্তিই আলাদা। মধ্য আফ্রিকার সেক্টর ওয়েস্ট হেডকোয়ার্টারে স্টাফ অফিসার হিসেবে কাজ করছেন ২ নারী শান্তিরক্ষী মেজর ইশরাত ও মেজর নুসরাত। এর মধ্যে অপারেশন বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন ইশরাত আর গোয়েন্দা বিভাগে নুসরাত।
মধ্য আফ্রিকার কাগা বান্দারো নামক স্থানে বাংলাদেশ মেডিকেল বা ব্যানমেড কন্টিনজেন্টে কাজ করছেন সেনাবাহিনীর ৫ নারী শান্তিরক্ষী। এর মধ্যে কন্টিনজেহন্টের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পারন করছেন কর্ণেল আমিনা। আরেক কন্টিনজেন্ট বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন বা ব্যানব্যাট এ আছেন ৩ নারী শান্তিরক্ষী। তারা হলেন-মেজর মোবাশ্বেরিন, মেজর তাসনীমা আর ক্যাপ্টেন শামীমা। এছাড়া বাংগুইতে ফোর্স হেডকোয়ার্টারে স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নৌ-বাহিনীর দুই চৌকষ নারী শান্তিরক্ষী।
মধ্য আফ্রিকায় শান্তিরক্ষী মিশনে স্টাফ অফিসার হিসেবে বাংলাদেশী নারী শান্তিরক্ষীরা প্রথম কাজ শুরু করেন গত বছর থেকে। চলতি বছরের শেষ দিকে তাদের মিশনের মেয়াদ শেষ হবে। অতীতে অন্যান্য দায়িত্বে নারীরা এলেও স্টাফ অফিসার পদে এবারই প্রথম। নিজেদের কাজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে মেজর ইশরাত বলেন, হায়ার হেডকোয়ার্টার থেকে সব ধরণের নির্দেশনা গ্রহণ করি। পরে তা জানায় কন্টিনজেন্টে। এরপর অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করা হয়।
তিনি জানান, এখানে অপারেশন পরিকল্পনা তৈরি করা কঠিন। নানা ধরণের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হয়। পরিকল্পনায় কোন ধরনের ঘাটতি থাকলে হয়তো বড় ধরণের দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। পরিরকল্পনা মতো একটি প্যাট্রল অপারেশনে বের হয়ে যাওয়ার পর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই সঠিক সময়ের মধ্যে অপারেশন সফর করাটা সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ।
২০১৫ সালে আইভরিকোস্টের মিশনে ছিলেন মেজর ইশরাত। বাংলাদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মধ্য আফ্রিকার মতো দূর্গম অঞ্চলে কিভাবে কাজ করছেন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখানে আসার আগে ২ বছর পার্বত্য চট্রগ্রামে কাজ করেছি। সেখানকার কিছু অভিজ্ঞতা এখানে কাজে লাগছে। তবে এখানকার চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি।
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত পরিকল্পনা অনুযায়ি যে কয়টি অপারেশন পরিচালনা করা হয়েছে তার বেশিরভাগই সফল হয়েছে। দেশে রেখে আসা পরিবার-পরিজন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৮ বছর বয়সী মেয়ে তাজরীবা তৌহিদ ইয়াশানাকে খুব মিস করি। ফোন করলে বলে মা আসো, মা আসো। মেয়ের এই ডাক উপেক্ষা করতে হয়। স্বামী সেনা কর্মকর্তা। তিনিও কাজ করছেন পার্বত্য চট্রগ্রামে।
তিনি জানান, এসবের মধ্যেও সবচেয়ে বড় তৃপ্তি দেশের জন্য কাজ করতে পারছি। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জলে ভূমিকা রাখতে পারছি। বোয়ারে অবস্থিত ব্যানব্যাট এ কর্মরত মেজর মোবাশ্বেরিন বলেন, এখানে কাজ করা ছয় মাস হয়ে গেছে। প্রথমদিকে অনেক বিষয়কে সমস্যা মনে হলেও এখন মানিয়ে নিয়েছি।
তিনি বলেন, দেশের জন্য কাজ করতে পারাটাই আমার জন্য আনন্দের। তাই যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। মধ্য আফ্রিকার দূর্গম অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আধূনিক মারণাস্ত্র নিয়ে সক্রিয় রয়েছে প্রায় ১০টি দূর্ধর্ষ বাহিনী। সংখ্যায় তারা প্রায় ৯ হাজার।
এদের মধ্যে এন্টি বালাকা আর এক্স সেলেকা সবচেয়ে বেশি দূর্ধর্ষ। এসব সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে রয়েছে-এম-১৬,আরপিজি, এইচএমজি ও কানাশনিকভ এর মতো অত্যাধুনিক অস্ত্র। প্রতিনিয়ত এদের সঙ্গে লড়েই মধ্য আফ্রিকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষীরা। বিশ্বের ২১টি দেশের ২৭টি কন্টিনজেন্ট কাজ করছে মধ্য আফ্রিকায়। মাত্র ৩টি কন্টিনজেন্ট নিয়ে শান্তি রক্ষায় কাজ করছে বাংলাদেশ।