logo
আপডেট : 9 September, 2018 20:16
ধারাবাহিক প্রতিবেদন: ষষ্ঠ পর্ব
শান্তিরক্ষীদের দুই চ্যালেঞ্জ

শান্তিরক্ষীদের দুই চ্যালেঞ্জ

দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বমঞ্চে এখন সরব পদচারনা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। আস্থা ও নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে তারা কাজ করছেন। বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনছেন গৌরব ও সম্মান। শান্তি ও মানবতা রক্ষায় লাল-সবুজের পতাকাকে তুলে ধরছেন স্ব-মহিমায়। সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক কাজী মুহা: আফিফুজ্জামান (কাজী সোহাগ) সেনাবাহিনীর একটি উচ্চ পদস্থ টিমের সঙ্গে গিয়েছিলেন মধ্য আফ্রিকায়। সেখানে সরেজমিনে দেখেছেন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম। নিউইয়র্ক মেইলের জন্য তিনি লিখেছেন ১০ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ পড়ুন তার ষষ্ঠ পর্ব।

 

দুই চ্যালেঞ্জ নিয়ে মধ্য আফ্রিকার মতো দূর্গম অঞ্চলে প্রতিকুল পরিবেশে কাজ করছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। একটি হচ্ছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাত থেকে সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষা করা, অপরটি প্রতিবেশি দেশ ক্যামরুন থেকে দেশটির জন্য আসা রসদের নিরাপত্তা দেয়া। এই দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমে মধ্য আফ্রিকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করছে।

তিনটি কন্টিনজেন্ট নিয়ে এখানে আছে বাংলাদেশ। একটি হলো ব্যানএসএফ,যার সদস্য সংখ্যা ১৫০ জন। কমান্ডো ট্রেনিংসহ বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা এরইমধ্যে সাফল্যের সঙ্গে অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। ব্যানব্যাট নামে আরেকটি কন্টিনজেন্টের সদস্য রয়েছেন ৮০২ জন। এছাড়া চিকিৎসা সেবার জন্য গঠিত ব্যানমেড কন্টিনজেন্টের সদস্য রয়েছে  ৬৯ জন। সবমিলিয়ে বর্তমানে এখানে কাজ করছেন ১০৪৬ জন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী।

মধ্য আফ্রিকার দূর্গম অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আধূনিক মারণাস্ত্র নিয়ে সক্রিয় রয়েছে প্রায় ১০টি দূর্ধর্ষ বাহিনী। সংখ্যায় তারা প্রায় ৯ হাজার। এদের মধ্যে এন্টি বালাকা আর এক্স সেলেকা সবচেয়ে বেশি দূর্ধর্ষ। এসব সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে রয়েছে-এম-১৬ ,আরপিজি, এইচএমজি ও কানাশনিকভ এর মতো অত্যাধুনিক অস্ত্র। নিজেদের ৫টি ক্যাম্প থেকে তারা একের পর এক সন্ত্রীসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। ক্যাম্পগুলো আছে-বেলেকো, বোকারাঙ্গা, বোসামতেলে, বোসামবেলে আর হেডকোয়ার্টার বোয়ারে।

সম্প্রতি পৃথক দুটি অপারেশনে একটানা ৮২ ও ৩০ দিন সময় লেগে যায়। এসময়টুকু তাদের থাকতে হয়েছে গহীন জঙ্গল আর ঝুঁকিপুর্ণ এরিয়ায়।  মধ্য আফ্রিকার গ্রীমারিতে ৪টি এপিসি ও ২টি এলএবি নিয়ে ৫ দিন ধরে আটকে ছিলেন ৮০ জন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী। এপিসিতে ত্রুটি দেখা দেয়ায় ঘন জঙ্গলের মাঝে আটকে থাকেন তারা। দলটি বাংগুই থেকে ৩৮০ কিলোমিটর দূরত্বে অবস্থিত বামবারিতে যাচ্ছিলো। সাধারনত এ রাস্তা যেতে সময় লাগে ৩ দিন।

অন্যদিকে আফ্রিকা মহাদেশের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত 'সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক'-এর লাইফ লাইন রক্ষায় কাজ করছেন বাংরাদেশী শান্তিরক্ষীরা। দেশটির একমাত্র মহাসড়ক দিয়ে সপ্তাহের ছয়দিন খাদ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে নির্বিঘœ নিরাপত্তা দেয়। তা নাহলে না খেয়েই মরতে হতো অসংখ্য হতদরিদ্র মানুষকে। এই ব্যবস্থাকে জাতিসংঘের পরিভাষায় বলা হচ্ছে, মেইন সাপ্লাই রুট বা এমএসআর। দেশটির রাজধানী বাংগুইসহ সারাদেশের মানুষের খাবারসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী আসে কামেরুন বর্ডার দিয়ে। ল্যান্ডলকড (কোন সমুদ্র বন্দর নেই) কান্ট্রি হিসাবে পার্শ্ববর্তী অন্য কোন দেশ থেকে কোন পণ্যসামগ্রী আনার সুযোগ নেই তাদের। শেষ ৭ মাসে ৮ হাজারের বেশি গাড়িকে নিরাপত্তা দিয়েছে ব্যানব্যাটের সদস্যরা।

অতীতে এ রুটে অসংখ্য গাড়ি লুটের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি আগুণ দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে অসংখ্য মালবাহি গাড়িকে। কথিত আছে, রাস্তায় কোন পণ্যবাহি গাড়ি বিকল হলে স্থানীয়রা মনে করে, ঈশ্বর তাদের জন্য উপহার পাঠিয়েছেন। তাই তারা সেটি নিজ দায়িত্বেই লুটে নেন। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা দায়িত্ব নেয়ার পর এ ধরনের হামলার সংখ্যা শূণ্যের কোঠায় গিয়ে পৌঁছেছে।

জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ি প্রথমদিকে ক্যামেরুনের সীমান্ত এলাকা বেলেকো থেকে মধ্য আফ্রিকার রাজধানী বাংগুই পর্যন্ত ৬১০ কিলোমিটার সড়কের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হয়। এরইপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে ৭৫০ সদস্য নিয়ে শুরু হয় এই ব্যাটালিয়নের কার্যক্রম। এরপর থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চৌকষ সদস্যরা তাদের কাজের মাধ্যমে ব্যপক সুনাম অর্জন করেন। এতে আস্থা বাড়ে জাতিসংঘেরও। এ কারনে গত বছর থেকে এ ব্যাটালিয়নের ওপর বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে দেয়া হয় স্থানীয় মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। ৬ হাজার স্কয়ার কিলোমিটার থেকে এক লাফে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬১ হাজার স্কয়ার কিলোমিটার এলাকা। কাজের পরিধি বাড়ে ক্যামেরুন ও চাদ সীমান্ত পর্যন্ত। জাতিসংঘের এই আস্থার মর্যাদা দিতে প্রতিদিন অক্লান্ত পরিশ্রম আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা।

সরেজমিনে ব্যানব্যাটের কার্যালয় বোয়ার থেকে বোসামতেলের ক্যাম্পে যাওয়া হয়। চলাচলের অনুপযুক্ত এ সড়কের নিরাপত্তা দেয়া সতিই দুরুহ বিষয়। এ রাস্তায় একটি গাড়ি বিকল হয়ে পড়লে তা উদ্ধারের কোন উপায় নেই। তাই রাস্তার দুই পাশে দেখা গেলো অসংখ্য বড় বড় গাড়ি পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। মজার বিষয় এদেশে গাড়ি উদ্ধারে কোন যন্ত্রপাতি নেই। মাঝে মাঝে এপিসি নিয়ে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা ওই রাস্তায় গেলে দূর্ঘটনায় শিকার গাড়িকে উদ্ধার করে। এমনকি একটি গাড়ি নষ্ট হলে অনেক সময় তিন চারদিন সেখানে অস্থায়ী তাবু টানিয়ে বসে থাকতে হয়। ক্যামেরুন থেকে মিস্ত্রি এনে সেটা সারানো হয়। এরকম পরিবেশের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এখানে কাজ করছেন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা।

মধ্য আফ্রিকায় প্রচুর পরিমাণে হিরা, ইউরোনিয়াম, তেল এবং সোনার খনি রয়েছে। কিন্তু নিজেদের হানাহানির কারনে সেই সম্পদ তাদের ভাগ্যবদলে কাজে লাগছে না। নিজেদের অভ্যন্তরীন সংঘাতে রক্ত ঝরছে নিয়মিত। এখানকার মানুষের হাতে হাতে অস্ত্র। অসংখ্য সশস্ত্র গ্রুপ পরষ্পরের সঙ্গে হানাহানিতে লিপ্ত। বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় পাঁচগুন বড় সেন্ট্রাল আফ্রিকায় মানুষ মাত্র ৪৭লাখ। এই অল্প সংখ্যক মানুষের দেশটিতে দীর্ঘদিন ধওে চরা জাতিগত সংঘাতে বিপজ্জনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিশ্বের দ্বিতীয় অশান্তিময় দেশ হচ্ছে এই সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক।