দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বমঞ্চে এখন সরব পদচারনা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। আস্থা ও নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে তারা কাজ করছেন। বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনছেন গৌরব ও সম্মান। শান্তি ও মানবতা রক্ষায় লাল-সবুজের পতাকাকে তুলে ধরছেন স্ব-মহিমায়। সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক কাজী মুহা: আফিফুজ্জামান (কাজী সোহাগ) সেনাবাহিনীর একটি উচ্চ পদস্থ টিমের সঙ্গে গিয়েছিলেন মধ্য আফ্রিকায়। সেখানে সরেজমিনে দেখেছেন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম। নিউইয়র্ক মেইলের জন্য তিনি লিখেছেন ১০ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ পড়ুন তার নবম পর্ব।
ভূল চিকিৎসায় মৃত্যুর কারণে যেখানে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হচ্ছে সেখানে উল্টো চিত্র মধ্য আফ্রিকায়। সেখানে বাংলাদেশী চিকিৎসকদের নিয়ে রীতিমত বন্দনা করা হচ্ছে।
প্রচলিত রয়েছে,বাংলাদেশী চিকিৎসকদের হাতে পড়লে নাকি রোগ পালিয়ে বাঁচে। কারণ তাদের ওপর রয়েছে অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস। তাই তো শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের ১২টি ইউনিটের সদস্যরা অসুস্থ হলেই ছুটে আসেন বাংলাদেশ মেডিকেল লেভেল-টু হাসপাতালে। এছাড়া দূর্গম অঞ্চলে কষ্ট স্বীকার করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করেছে বাংলাদেশ।
মধ্য আফ্রিকার কেন্দ্র কাগা-বান্দোরো নামক স্থানে অবস্থিত মেডিকেলটি ব্যানমেড নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। ৬৯ জন জনবল নিয়ে ২০ বেডের এ হাসপাতালটি পরিচালনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের তিনটি কন্টিনজেন্টের মধ্যে এটা অন্যতম। অপর দুটি কন্টিনজেন্টের একটি রয়েছে রাজধানী বাংগুইতে বাংলাদেশ স্পেশাল ফোর্স বা ব্যানএসএফ ও বোয়ারে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন বা ব্যানব্যাট।
রাজধানী বাংগুই থেকে হেলিকপ্টারে দেড় ঘন্টা পর কাগা-বান্দোরোতে পৌঁছে বাংলাদেশ থেকে আসা সেনাবাহিনীর ৮ সদস্যর ডেলিগেশন টিম। এর নেতৃত্ব ছিলেন মেজর জেনারেল এস এম শামিম-উজ-জামান। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন,ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাফিজ আহসান ফরিদ,কর্ণেল নুরুল হুদা, লে.কর্ণেল সিদ্দিকুর রহমান,মেজর মঈদুল হায়দার চৌধুরী, মেজর ইসমাইল কবির, মেজর সাকিবুল হক ও ক্যাপ্টেন খোরশেদ হাসান। ২৭ জুন থেকে ৬ই জুন পর্যন্ত দলটি এখানে অবস্থান করবে।
সরেজমিনে ব্যানমেডে গিয়ে দেখা যায়, পাকিস্তান ও রুয়ান্ডার দুই শান্তিরক্ষী চিকিৎসা নিচ্ছেন। অপর পাশে চিকিৎসা নিতে দেখা যায় স্থানীয় কয়েক নারী ও শিশুকে। পেটে তীব্র ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্য মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, চারদিন আগে ভর্তি হয়েছি। সত্যিই আমি অভিভুত এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা দেখে। বিশেষ করে চিকিৎসকদের দক্ষতা ও সেবার ধরণ একেবারে আলাদা। একই প্রতিক্রিয়া জানালেন রুয়ান্ডা সেনাবাহিনীর সদস্য।
মধ্য আফ্রিকার সেন্টারে অবস্থিত সব দেশের শান্তিরক্ষীরা এখানে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকেন। এর মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য দেশ হচ্ছে- মৌরতানিয়া, বুরুন্ডি,রুয়ান্ডা,নাইজার ও পাকিস্তানের চারটি কন্টিনজেন্ট। সবমিলিয়ে এখানকার ২১৬০ জন শান্তিরক্ষীর চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ সেবা দিতে গিয়ে প্রতিমূহুর্তে তাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে নানা ধরণের চ্যালেঞ্জের। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বৈরি আবহাওয়া, ভাঙ্গাচোরা রাস্তাঘাট,প্রত্যন্ত ও দূর্গম অঞ্চল এবং টানা ছয় মাস বৃষ্টি। এরউপর রয়েছে নিরাপত্তার শংকা। প্রায় প্রতিদিনই ক্যাম্পের বাইরে গোলাগুলি চলে। নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে সংঘর্ষ এখানে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। কথিত আছে গরুর পা ভাঙ্গা নিয়ে লাগা মারামারিতে ১০ জনের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে। এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশে জীবনবাজি রেখে কাজ করে চলেছেন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা।
বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য চিকিৎসক মেজর সাকিবুল হক বলেন, সাধারণত প্রতিটি কন্টিজেন্টে লেভেল-১ হাসাপাতাল থাকে। বাংলাদেশ শান্তিরক্ষীদের লেভেল-২ হাসপাতাল রয়েছে মাত্র দুটি। একটি মধ্য আফ্রিকার কাগা-বান্দোরোতে আরেকটি পশ্চিম সাহারাতে। এ ধরণের হাসপাতালে বলা যায় সব ধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থা তাকে। বিশেষ করে মেডিসিন, সার্জিক্যাল, ডেন্টাল, শিশু, প্যাথলজি, গাইনোলজি, রেডিওলজি থেকে শুরু করে অবেদন পর্যন্ত। কোন কারণে লেভেল-২ হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ না থাকলে তাদের পাঠানো হয় লেভেল-৩ হাসপাতালে। এ হাসপাতাল রয়েছে উগান্ডায়।
বাংলাদেশের লেভেল-২ হাসপাতালের গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩ শে জুন পর্যন্ত চিকিৎসা সেবার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে,এ সময়ের মধ্যে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে দুই হাজার ৮০২ জনকে। এছাড়া বিভিন্ন রোগের জন্য ভর্তি হন ১২২ জন,জটিল অপারেশন করা হয় ২০ জন রোগীকে। পাশাপাশি ছোট অপারেশন করা হয়েছে ৩৯টি,সার্জিক্যাল ড্রেসিং ১৬০ জনের, দাঁতের রোগী দেখা হয়েছে ২৩৯ জন, হেলিকপ্টারে করে লেভেল-৩ হাসাপাতালে পাঠানো হয়েছে ৪ জনকে। এর মধ্যে দুই জন সামরিক ও ২ জন স্থানীয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তারা হাসপাতালে ভর্তি হন। ৮ মাসে বিভিন্ন ধরণের ল্যাব টেস্ট করা হযেছে ৫ হাজার ৫৪৪টি, ম্যালেরিয়া রোগী দেখা হয়েছে ৪০জন,এইডস রোগী ছিলো ৪ জন, এক্সরে করা হয়েছে ১ হাজার ১৮০টি ও ইউএসজি ১৬৫টি।
হাসপাতালের সিনিয়র চিকিৎসক লে. কর্নেল রাশেদ মিনহাজ সিদ্দিকী বলেন, হাসপাতালে ২০টি বেডের পাশাপাশি আমরা আরও ৫০ জন রোগীকে একবারে চিকিৎসা সেবা দিতে পারি। শান্তিরক্ষী মিশনে থাকা ব্যক্তিদের পাশাপাশি এ হাসপাতালের মাধ্যমে নানা বেসামরিক, স্থানীয় ও এ এলাকায় কাজ করা বিভিন্ন এনজিও কর্মীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়।
তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালের দরজা সব সময় সবার জন্য খোলা থাকে। অসুস্থ হয়ে কেউ হাসপাতালে আসলে আমরা তাদের ফিরিয়ে দেই না। এখানে মানবতার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয় সবচেয়ে বেশি। ২/৩ মাস পরপর প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকি। এ ধরণের ৩টি ক্যাম্প করেছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি ব্যানমেডের কাছে আইডিপিতে থাকা মানুষদের স্বাস্থ্য সচেতনতায় কাজ করা হয়।
সন্ত্রাসীদের ভয়ে যারা নিজ এলাকায় থাকতে পারেন না তারা শান্তিরক্ষী ক্যাম্পের আশেপাশে আইডিপিতে থাকেন। এরকম ৫ হাজারের বেশি মানুষ রয়েছে আমাদের ক্যাম্পের পাশে থাকা আইডিপিতে। হাসপাতালের নার্সিং অফিসার মেজর নুরুন্নাহার বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা পেয়ে এখানকার প্রতিটি মানুষ খুব খুশি। এখানে আমরা দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি। তাই সবাই সবার জায়গা থেকে সেরা কাজটা করে দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশের সুনাম অর্জনকারি এ হাসপাতালটিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কন্টিনজেন্ট কমান্ডার (সিসি) কর্নেল আমিনা হাসনাত চৌধুরী। মধ্য আফ্রিকায় বাংলাদেশের প্রথম নারী কন্টিনজেন্ট কমান্ডার তিনি। এর আগে ২০১৬ সালে আইভরিকোস্টে প্রথম নারী কন্টিনজেন্ট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কর্নেল নাজমা বেগম।
তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ৬৯ জন কর্মীর মধ্যে ৮ জন রয়েছে নারী শান্তিরক্ষী। সবাই পেশাগতভাবে খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছেন। সুখের বিষয় এ পর্যন্ত আমাদের কেউ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হননি। সবাই জানেন এখানে ম্যালেরিয়া একটি বড় বাধা। তিনি বলেন, শান্তিরক্ষীদের পাশাপাশি স্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়মিত জরুরি চিকিৎসা সেবা হচ্ছে।
কাজের চ্যালেঞ্জ হিসেবে বলেন, প্রথম চ্যালেঞ্জ ম্যালেরিয়া, এইচআইভি, চিকিৎসা সেবার অনেক কিছু স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় না। এছাড়া দূর্গম এলাকা তো রয়েছেই। মধ্য আফ্রিকায় প্রথম নারী কন্টিজেন্ট কমান্ডার হিসেবে কাজ করার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে কন্টিনজেন্ট কমান্ডার হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ। এ পদে দায়িত্ব পালন করতে পেরে খুবই গর্বিত। এক্সাইটেড। নিজের মতো করে কাজ করতে পেরে ভালো লাগছে। কয়েক মাস পর চলে যাবো। কিন্তু জায়গাটার ওপর এরইমধ্যে মায়া পড়ে গেছে।