logo
আপডেট : 17 October, 2018 13:56
সৌদি-মার্কিন সম্পর্কের আড়ালে হারিয়ে যাবে খাসোগি!
খাসোগির মৃত্যু নিয়ে বিপাকে সৌদি রিয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও
মেইল রিপোর্ট

সৌদি-মার্কিন সম্পর্কের আড়ালে হারিয়ে যাবে খাসোগি!

সৌদি লেখক জামাল খাসোগীর ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে নিখোঁজ ও সন্দেহজনক নিহতের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কূটনীতিক মঙ্গলবার সৌদি আরবের কিং সালমান ও তার ছেলে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।  

‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ কলামিস্টের কথিত হত্যাকান্ড ও দেহ খণ্ড বিখণ্ডের প্রমাণ খোঁজার জন্য তুর্কি ফরেনসিক দল সৌদি কনস্যুলেটের ভিতরে একটি অনুসন্ধান শেষ করার কয়েক ঘন্টা পরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও দুজনার সাথে হাত মেলান ও আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানান।

একটি উচ্চ পর্যায়ের তুর্কি কর্মকর্তা  দল তদন্ত চলমান থাকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে ‘দা এসোসিয়েটেড প্রেস’কে বলেছিল যে, খাসোগী হত্যার প্রমাণ পুলিশের কাছে রয়েছে। তারা এই মুহূর্তে এর বেশি কিছু বলতে অস্বীকার করে।

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সৌদি কনসুলের বাড়ির কাছাকাছি পুলিশ দ্বিতীয় অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করছে। প্রকাশিত নজরদারি ফুটেজ শোতে দেখা যায়, দোসরা অক্টোবর খাসোগী নিখোঁজের কিছুক্ষণ পর দূতাবাসের আশেপাশে কূটনৈতিক যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়। 

সৌদি কর্মকর্তারা খাসোগী হত্যায় সৌদিকে দোষারোপের বিষয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ তাকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে আসছিল। কিন্তু মঙ্গলবার মার্কিন প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, খাসোগীকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে কনস্যুলেটের ভেতরে হত্যা করা হয়েছে বলে সৌদির অন্তত স্বীকার করা উচিৎ।

সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবীর পম্পেওকে রিয়াদে অবতরণের পর অভ্যর্থণা জানান। সিআইএ এর সাবেক এই প্রধান মিডিয়ার সামনে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। এর পরপরই, পম্পেও রাজকীয় প্রাসাদে পৌঁছান, যেখানে তিনি কিং সালমানকে ‘রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে তার সফর গ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানান’। এরপরেই তারা দু'জন একটা দরজা বন্ধ করা ঘরে বৈঠক করতে চলে যান। 

সৌদি কনস্যুলেটে তুরস্কের কর্মকর্তারা ৯ ঘণ্টার তদন্ত অভিযানে ‘বিষাক্ত’ ও ‘কোনও কিছুর ওপর নতুন রঙ’ থাকার সন্ধান পেয়েছে। এ সম্পর্কে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বলেন, আমরা দ্রুতই সবকিছু জানতে পারবো কারণ আমাদের অনুসন্ধানে বিষাক্ত পদার্থ এবং সেগুলো রঙ করে মুছে দেয়ার আলামত পাওয়া গেছে।

সৌদি মুকুটের পরবর্তী উত্তরাধীকারী মোহাম্মেদ বিন সালমানের সঙ্গে একটি দীর্ঘ বৈঠক করেন। সেখানে প্রিন্স বলেন, খাসোগী সৌদি থেকে পালিয়ে তুরস্কে গিয়েছে এবং আমেরিকায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে গিয়েছে। সে আমার উত্থান নিয়ে ও আমার অনেক পলিসি নিয়ে কলাম লিখে সমালোচনা করেছে।

যুবরাজ পম্পেওকে বলে, ‘আমরা অনেক পুরাতন বন্ধু, অতীতে আমরা সব চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে মোকাবিলা করেছি, বর্তমানেও করছি এবং ভবিষ্যৎ এও আমরা একযোগে সব মোকাবিলা করব।’

ট্রাম্প পম্পেওকে খাসোগীর অন্তর্ধানের ওপর রাজতন্ত্রের সাথে কথা বলার জন্য পাঠিয়েছিলেন, তিনি সালমানের সাথে কথা বলার পর বলেন যে ‘হত্যাকারীরা’ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। ট্রাম্পকে কোন প্রমাণ সরবরাহ করা হয়নি, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের শক্তিশালী এই জোট বৈশ্বিক কূটনৈতিক তীব্র সমালোচনায় পড়েছে।

ট্রাম্প সোমবার (১৫ অক্টোবর) বলেন, ‘বাদশাহ দৃঢ়ভাবে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। কে জানে! কোন দুর্বৃত্তের দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে এমন মনে হচ্ছে। আমরা খুব শিঘ্রই ঘটনার শেষ পর্যন্ত পৌঁছানোর চেষ্টা করছি কিন্তু তিনি (বাদশাহ) স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছেন।’

ইউরেশিয়া গ্রুপের মিডওয়েস্ট এবং উত্তর আফ্রিকার বিভাগীয় প্রধান আয়হাম কামেল বলেন, ‘দেশ দুটির মধ্যে একটি কূটনৈতিক সংকট এড়াতে এবং উত্তেজনা কমানোর পথ খুঁজে পেতে দৃশ্যের পেছনের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। রিয়াদকে সাংবাদিক নিখোঁজের ঘটনায় অবশ্যই ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে। কিন্তু এমনভাবে যে কোনও দাবি থেকে নেতৃত্বকে দূর করে দেয় যে, বিশিষ্ট সাংবাদিককে হত্যার জন্য সিনিয়র স্তরে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।’

মার্কিন বার্তা সংস্থা ‘সিএনএন’ জানায় যে, সৌদিরা হত্যাকাণ্ড স্বীকার করতে যাচ্ছিল কিন্তু যুবরাজ তা প্রত্যাখ্যান করার আদেশ দিয়েছিল- যা কিনা বিশ্লেষক এবং বিশেষজ্ঞদের রাজ্যের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞানের সঙ্গে মিলছে না।

‘নিউইয়র্ক টাইমস’ জানায় যে, সৌদি রাজকীয় আদালত রাজ্যের গোয়েন্দা পরিষেবাদিগুলির মধ্যে একজন কর্মকর্তা যিনি প্রিন্স মোহাম্মদ এর বন্ধু তিনি এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। সেই অভিযোগ অনু্যায়ি, যুবরাজ খাসোগীকে ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটি অনুমোদন পাশ করিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যুবরাজের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ সম্পূর্ণ করতে অসমর্থ হয়েছে। 

সৌদি পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অজ্ঞাতনামা সূত্রের বরাত দিয়েই উভয় প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ‘এপি’র পুনঃপুন অনুরোধের পরেও আলোচ্য এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত সৌদি কর্তৃপক্ষ কোন ধরণের মন্তব্য করেনি। 

ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কনস্যুলেটটিতে কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের প্রবেশ ও বাহিরের দায়িত্বে তুর্কি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা বাহিনী থাকবে। বিধান অনুযায়ী হোস্ট দেশটি দূতাবাসের সার্বিক নিরাপত্তা ও শ্রদ্ধায় দায়িত্বরত। 

গত রবিবার (১৪ অক্টোবর) শেষ রাতে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান ফোন করে যুবরাজ সালমানের সঙ্গে আলোচনা করে কনস্যুলেটে অনুসন্ধানের অনুমতি পায়। 

রাষ্ট্র পরিচালিত ‘আন্দলু’ খবর সংস্থা রিপোর্ট অনুযায়ী, তুর্কি পরিদর্শন দলের মধ্যে একজন প্রসিকিউটর, একজন ডেপুটি প্রসিকিউটর, সন্ত্রাসবিরোধী পুলিশ এবং ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা ছিলেন। কনস্যুলেটের কিছু এলাকা সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও কর্মকর্তারা নজরদারি ক্যামেরা পরিদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন।

এরদোয়ান মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন যে, পুলিশ ‘বিষাক্ত’ উপকরণের ট্রেস চেয়েছিল এবং কনস্যুলেটের কিছু অংশ সম্প্রতি পেইন্ট করা অবস্থায় পেয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানায়, সৌদি কনস্যুলের বাড়ি তদন্তেরও অনুমতি চেয়েছিল পুলিশ। সরকারের বিধিনিষেধ ও আইন অনুযায়ী অনুমতি চাওয়া হয়েছে, কবে নাগাদ তা পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে কোন নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।

সৌদি সমালোচক সাংবাদিক খাসোগী সালমানের নীতিমালা ও রাষ্ট্রপরিচালনায় বিরোধিতা করেছিলেন। প্রিন্স মোহাম্মদ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের গন্তব্য হিসেবে আগ্রাসীভাবে রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু খাসোগীর অন্তর্ধানের কারণে রিয়াদে আসন্ন বিনিয়োগ সম্মেলন থেকে ইতোমধ্যেই বহু বিনিয়োগকারী ও প্রচারমাধ্যম মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

খাসোগি নিখোঁজের ঘটনায় সৌদি রাজত্বের কোন সংশ্লিষ্টতা থাকলে দেশটিকে ‘গুরুতর সাজা’ পেতে হবে বলে সম্প্রতি ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় সৌদি মিডিয়া তেলকে অস্ত্র বানানোর পালটা হুমকি দেয়। 

সম্প্রতি ট্রাম্প সালমান ও ওপেক কে তেল উত্তোলনের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে নির্দেশনা দেয়, যাতে করে তেলের মূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করে ইরানের তেল রপ্তানির ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।