একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবেলায় ব্যস্ত থাকবে পুলিশ। এ সুযোগে দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারে প্রায় দেড় হাজার জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গি।
এদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। তাদের কে কোথায় আছে, কী করছে এসব বিষয়ে এরই মধ্যে সারা দেশে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা নজরদারি শুরু করেছেন। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শেষে এসব জঙ্গির প্রোফাইল পুলিশ সদর দফতরে পাঠানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তাদের জামিন বাতিলের পাশাপাশি পলাতক জঙ্গিদের নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু করতে আদালতে আবেদন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর, অ্যান্টি-টেরোরিজম ইউনিট ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
পুলিশের অ্যান্টি-টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত আইজি (পুলিশ সদর দফতরে বদলির আদেশপ্রাপ্ত) শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, যেসব জঙ্গি পালিয়ে আছে তাদের নিয়েই আমরা বেশি তৎপর। কারণ নির্বাচন সামনে রেখে তারা নাশকতার ছক আঁকছে বলে একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সারা দেশে জঙ্গিদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পাশাপাশি বিশেষ অভিযান চলছে।
চলমান বিশেষ অভিযানে সম্প্রতি নরসিংদীতে এক জঙ্গি দম্পতি নিহত হয়েছে। দুই নারী জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেছে। চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে দুই জঙ্গি নিহত হয়েছে। জেএমবির রাজশাহী অঞ্চলের সমন্বয়কসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বগুড়া থেকে ৩ জঙ্গিকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ২০০৩ থেকে এ পর্যন্ত পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ৩ হাজার ১৬৯ জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে। এদের মধ্যে জেলহাজতে আছে ১ হাজার ৪৩১ জন। জামিন পেয়েছে ১ হাজার ৩৪৬ জঙ্গি। জামিনের পর পালিয়ে গেছে ২১৯ জন। খালাস পেয়েছে ২৩৬ জন। পুলিশের অভিযানে ৭৬ জন নিহত হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়া শেষে ২৬ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। দেশের বাইরে পালিয়ে আছে ২০-২৫ জঙ্গি। এছাড়া ৬০-৭০ জঙ্গি এ মুহূর্তে নিখোঁজ আছে। নিখোঁজ জঙ্গিদের বিষয়ে পুলিশের কাছে কোনো তথ্য নেই।
জঙ্গিরা এখন ঘাপটি মেরে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। অর্থ সংকটের কারণে তারা অস্ত্র, গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে পারছে না। তাই অর্থ জোগাড় করতে তারা এখন পেশাদার অপরাধীদের দলে টানছে। সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জের শাহজাহান বাচ্চু হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে কাকা বাবু নামের একজনের নাম জানা যায়। প্রকৃত অর্থে বাবু জঙ্গি নয়। সে পেশাদার ডাকাত। অর্থ সংগ্রহের জন্য জঙ্গিরা তাকে দলে টেনেছিল। পুলিশ জানায়, ডাকাতি করে যে অর্থ পাওয়া যায় সেটির ৩ ভাগ করা হয়। এক ভাগ ডাকাতদের দিয়ে দেয়া হয়। এক ভাগ ব্যয় করা হয় অস্ত্র, গোলাবারুদ কেনায়। অপরভাগ ব্যয় করা হয় জেলে থাকা জঙ্গিদের জামিনের জন্য।
জানা গেছে, জামিনের পর পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ফুয়াদ আল মাহাদি, সামিউন রহমান ইবনে হামদান, কাওছার হোসেন, কামাল উদ্দিন, মো. আজমীর, গোলাম সারওয়ার, মুফতি আবদুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম, নূর ইসলাম, আমিনুল মুরসালিন, মহিবুল মোত্তাকিন, রফিকুল ইসলাম মিরাজ ও মশিউর রহমান, তানভীর, তৌহিদুল, সাইদুর, সাইফুল, রেজাউল, নাঈম, জুম্মন, আমিনুল, আবদুল আকরাম, জুনায়েদ রহমান, মানিক, মাজিদ, সাজেদুর, ফারুক, শফিক, মিলন, কফিল উদ্দিন ওরফে রব মুন্সি, আজিবুল ইসলাম ওরফে আজিজুল, শাহান শাহ, হামিদুর রহমান, বজলুর রহমান, বাবর, শরিফ, খাইরুল ইসলাম, ওয়ালিউল্লাহ ওরফে হামিদ, জাকারিয়া, সবুজ, নাদিম, ময়েজ উদ্দিন, মহব্বত ওরফে তিতুমীর ওরফে নাহিদ। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন দুর্ধর্ষ জঙ্গি রয়েছে। জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গিদের মধ্যে ৫৫২ জনের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছর। ২৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে আছে ৩৮২ জঙ্গি। ১৫১ জঙ্গির বয়স ৪১ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে। মামলার এজাহারে ২৬২ জঙ্গির বয়স উল্লেখ নেই। সূত্র জানায়, পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় যেসব জঙ্গি আছে তাদের মধ্যে মোহাম্মদ, ডন, সালাউদ্দিন সালেহীন, রোকনুজ্জামান রোকন, হাফিজ ভূঁইয়া ও আল আমিন উল্লেখযোগ্য। এ নামগুলোর বেশরভাগই সাংগঠনিক নাম। এদের মধ্যে মোহাম্মদ হল নব্য জেএমবির বর্তমান আমীর। সালাউদ্দিন সালেহীন পুরাতন জেএমবির আমীর। সে ভারতে পলাতক। রোকন সম্প্রতি নরসিংদীর জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করা খাদিজা আখতার মেঘনার স্বামী। হাফিজ নরসিংদীর শেখের চরে জঙ্গি দম্পতি আকলিমা আকতার মনি ও আবু আবদুল্লাহ আল বাঙ্গালীকে বাড়ি ভাড়া নিতে সহযোগিতা করে। আর আল আমিন দুই নারী জঙ্গি খাদিজা আখতার মেঘনা ও ইশরাত জাহান মৌকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল। পুলিশের ওয়ান্টেড তালিকায় বেশ কয়েকজন নারী জঙ্গিও আছে। এরা হল- সুলতানা বেগম ওরফে সুলতানা আক্তার কচি, সাফিয়া ওরফে সানজিদা ওরফে ঝিনুক, মাইমুনা ওরফে মাহমুদা ওরফে লায়লা, তাসনুবা ওরফে তাহিরা, সায়লা ওরফে শাহিদা, সালেহা ওরফে পুতুল, দিনাত জাহান ওরফে নওমী ওরফে বানী, তানজিলা ওরফে মুন্নী, আলিয়া ওরফে তিন্নি ওরফে তিতলী, মনিরা জাহান ওরফে মিলি, ছাবিহা ওরফে মিতু, ডা. ইসতিসনা আক্তার ওরফে ঐশী। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার জঙ্গিদের অনেকে ইতিমধ্যে জামিন পেয়েছে বলে তথ্য রয়েছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা কাজ করছি। পলাতক জঙ্গিদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করছে পুলিশ। পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (ল-ফুল ইন্টারসেপশন সেল) আঞ্জুমান কালাম যুগান্তরকে বলেন, পুরনো ও নব্য জেএমবি, হরকাতুল জেহাদ (হুজি), আনসার আল ইসলাম ও হিজবুত তাহরীরসহ নিষিদ্ধ অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর তৃতীয়-চতুর্থ সারির সদস্যরা এখন সংগঠনকে সক্রিয় করতে চাইছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে চেষ্টা চলছে। র্যাবের উপ-পরিচালক রইসুল আজম মনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানে জঙ্গিরা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তবে আমরা চুপচাপ থাকলে তারা আবারও সংগঠিত হতে পারে। তাই তাদের মূলোৎপাটন করতে অভিযান অব্যাহত থাকবে।