logo
আপডেট : 27 December, 2018 01:37
আমির খানের দুই বার্তায় আমরা দ্বিধাগ্রস্ত
রিয়াজুল হক

আমির খানের দুই বার্তায় আমরা দ্বিধাগ্রস্ত

২০০১ সালে লগান সিনেমার মাধ্যমে নতুন করে আবির্ভাব হন আমির খান। এরপর তার যতগুলো ছবি মুক্তি পেয়েছে, প্রায় প্রতিটি ছবিই কোন না কোন বার্তা দিয়ে আসছে। পরিবর্তন হয়েছে অনেকের জীবন ধারায়। আমার জানা মতে, বেশ কিছু অভিভাবক, যারা তাদের ছোট সন্তানদের দুষ্টুমির কারণে হোস্টেলে দিয়েছিলেন, ‘তারে জামিন পার’ সিনেমা দেখার পর বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। আর ইতোমধ্যে আমির খান হয়ে উঠেছেন সিনেমার নায়কের পাশাপাশি অনেকের বাস্তব জীবনের আইডল। থ্রি ইডিয়ডস এবং দঙ্গল আমির খান অভিনীত দুইটি সিনেমা।

২০০৯ সালে থ্রি ইডিয়ডস সিনেমা মুক্তি পায়। আট বছর আগে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি দেখে অনেকের মধ্যে পরিবর্তনের একটা লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। উইকিপিডিয়ার সাহায্যে মূল কাহিনীটি আবার মনে করে দিতে চাইছি। ইম্পেরিয়াল কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর ডিন ভীরু সাহাস্ত্রাবুদ্দকে। তিনি কঠোর নিয়মের বেড়াজালে পুঁথিগত পড়াশোনার কবলে তার বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্রদের জন্যে করে রেখেছেন এক নিরানন্দের জায়গা। হোস্টেল জীবনেই তিন রুমমেট ফারহান, রাজু এবং রাঞ্চোর দাস, এই থ্রী ইডিয়টসের পরিচয় ঘটে। ফারহানের ইচ্ছে ছিল সে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার হবে, কিন্তু সেই স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে সে ইঞ্জিরিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য রাজুও ইঞ্জিরিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়। মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্ন বহন করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসা ফারহান এবং রাজু অচিরেই আবিষ্কার করে তাদের রুমমেট রাঞ্চোর চিন্তা আর কাজে অন্য সকলের চেয়ে আলাদা। রাঞ্চো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তো ভালবেসে, যন্ত্রপাতির প্রতি তার ছিল অদম্য কৌতূহল। রাঞ্চো বিশ্বাস করত, যে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সফল হতে হলে এর সম্পর্কিত বিষয় গুলোর বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে হবে, পাঠ্যবই এবং প্রফেসর কর্তৃক প্রদত্ত বিষয়গুলো ভালভাবে না বুঝে শুধু মুখস্ত করলেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সফল হওয়া যায় না। সফলতার নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে উৎকর্ষের পেছনে ছোটা উচিত, তাহলে সফলতা এমনিতেই চলে আসবে। যাই হোক ছবিটির মূল কথা ছিল, প্রত্যেকের তাই করা উচিত, যা সে করতে ভালোবাসে।

এদিকে ২০১৭ সালে মুক্তি পেয়েছে দঙ্গল সিনেমা। ভারতীয় কুস্তিগীর মহাবীর সিং ফোগাটের চড়াই উতরাই জীবনের কিছু অংশ নিয়ে সিনেমাটি তৈরী করা হয়েছে। হরিয়ানা রাজ্যের অখ্যাত এক গ্রাম বালালি। সেই গ্রামের ছেলে মহাবীর সিং ফোগট। জাতীয় পর্যায়ে কুস্তি চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে না পারায় স্বর্ণ না জেতার কষ্ট মহাবীর সিংয়ের ছিল। সেই কারনে তার ইচ্ছা ছিল, পুত্র সন্তান হলে তাকে কুস্তিগীর হিসেবে তৈরী করবেন, যে পুত্র সন্তান আন্তর্জাতিক ইভেন্টে সোনা জিতে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। পর পর চারটি কন্যা সন্তানের পিতা হন মহাবীর সিং ফোগাট।  সব আশাও তার শেষ হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন সমবয়সি দুই ছেলেকে মারধর করার জন্য তাদের পিতা মাতা মহাবীরের বড় দুই মেয়ের (গীতা, ববিতা) নামে নালিশ করতে আসে। গীতা, ববিতা বেশ মেরেছে ছেলে দুটিকে। তখনই মহাবীরের মধ্যে অন্য এক চিন্তা এসে ভর করে। সোনা তো সোনাই, সেটা ছেলে জিতুক কিংবা মেয়ে। সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েদের কুস্তিগীর হিসেবে মানুষ করবেন। নানা প্রতিকূলতা ছিল। পরিবার, সমাজ বিভিন্ন দিক থেকে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন বাবা মহাবীর সিং। কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ়চেতা বাবা সকল ধরনের প্রতিবন্ধকতা একের পর এক দূর করতে থাকেন। গীতার সাব-জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশীপের শুরুতে মহাবীর সিং মেয়ের প্রস্তুতির জন্য অফিসে দুই মাসের ছুটির আবেদন করে। ছুটি না পাওয়ায় মেয়ের প্রস্তুতির কথা চিন্তা কর চাকরিই ছেড়ে দেন। বৃথা যায়নি সেই চেষ্টা। গীতা একের পর এক সাব-জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন, জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন, ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপ জিতে নেয়। অন্য মেয়ে ববিতাও বাবার প্রচেষ্টায় ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা জয়লাভ করে। সিনেমাটির শেষ মুহূর্তে দেখা যায়, ২০১০ সালের কমনওয়েলথ গেমসে ৫৫ কেজি বিভাগে মেয়েদের কুস্তিতে বড় মেয়ে গীতা সোনা জেতেন। অর্থাৎ মহাবীর সিং ফোগাটের আন্তর্জাতিক ইভেন্টের সেই আরাধ্য সোনা জয়ের স্বপ্ন পূরণ হয় তার মেয়েকে দিয়েই। এখানে সোনার পদকটাই মুখ্য, ছেলে সন্তান নাকি মেয়ে সন্তান কে জয় করেছে, সেটা বিবেচ্য বিষয় কখনও হতে পারে না।

বাণিজ্যিক দিক থেকে থ্রি ইডিয়ডস বিশাল সফলতা পেয়েছিল। দঙ্গল সেটিও ছাড়িয়ে গেছে। আর দুইটি ছবিই আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে বাণিজ্যিক সফলতা কিংবা দর্শকপ্রিয়তা, যেদিক থেকে বিবেচনা করি আমির খান অবশ্যই একটা মুখ্য বিষয়।

অনেকের মধ্যে দ্বিধার সৃষ্টি হচ্ছে থ্রি ইডিয়ডসি এবং দঙ্গলের কাহিনী নিয়ে। কারণ দুইটি ছবির কাহিনী সম্পূর্ন বিপরীত ধরনের বার্তা বহন করছে। থ্রি ইডিয়ডস এর মতে, সন্তানের ক্যারিয়ার নির্বাচনের উপর অভিভাবকের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়া ‍উচিত নয়। তার ভালো লাগাকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। কিন্তু দঙ্গল এর মতে, অভিভাবকের ইচ্ছা জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সন্তানের উপর। নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করা হয়েছে। সন্তানের ইচ্ছা, অনিচ্ছাকে বিবেচনা করা হয়নি।

কয়েকদিন আগে একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, থ্রি ইডয়টস সিনেমায় আমির খান, মানে দরিদ্র পরিবারের অতি মেধাবী ছাত্র রাঞ্চোর দাস চাঞ্চোরের প্রক্সি হয়ে যে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, তার জীবনদর্শন আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করেছিল। কারণ, সে বারবার সবাইকে বলে এসেছে, ‘নিজের অন্তরাত্মার কথা শোনো। তোমাকে যা আকর্ষণ করে, যাতে তোমার আগ্রহ, যে পথে তুমি এগোতে চাও, সেই দিকেই এগিয়ে চলো। মা-বাবা যা চাইছেন, তা নয়। তুমি যা হতে চাও, সেদিকেই এগোও। নিজের মনের কথা শোনো।’ অথচ দঙ্গল-এর মহাবীর রূপী পিতা আমির খান রাঞ্চোরের দর্শনকে নস্যাৎ করে দিলেন। অন্য পাঁচজন গ্রামীণ মেয়ের মতোই হেসে খেলে বড় হতে চেয়েছিল তার দুই মেয়ে। তারা স্কুলে যেত, ইচ্ছেমতো ফুচকা খেত, টিভি দেখত। কিন্তু বাবার ইচ্ছায় তাদের কাক ভোরে ওঠার অভ্যাস করতে হলো। ফুচকা, চুরমুর, টক, চাটনিসহ সব খাবার খাওয়া বন্ধ হলো। স্ত্রীর আপত্তি অগ্রাহ্য করে প্রথমবার বাড়িতে ঢোকানো হলো মুরগির মাংস। শুরু হলো জবরদস্তি প্রোটিন ইনটেক। মাটির আখড়ায় চুলের বারোটা বাজছে দেখে মেয়েরা আপত্তি জানাতে, দুই মেয়ের মাথা মুড়িয়ে কদমছাঁট করে দিলেন ‘হৃদয়হীন’ বাবা। এই দুই মেয়ের কেউ পালোয়ান হতে চায়নি। কেউ ধুলোয় মাখামাখি হয়ে কুস্তি লড়তে চায়নি। কেউ কাকভোরে উঠে দৌড়াতে চায়নি। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের মন কী চায়, তাদের বাবা তা একটা দিনের জন্যও জানতে বা বুঝতে চাননি। চেষ্টাও করেননি।

সন্তান তার পিতা মাতার ইচ্ছা পূরণ করবে, এটা দোষের কিছু নয়। আবার সন্তানের ইচ্ছা অনিচ্ছার খোঁজ পিতা মাতাই নেবে, এটাই স্বাভাবিক। থ্রি ইডিয়ডস একটি ছবি বার্তা নির্ভর ছবি এবং দঙ্গল মহাবীর সিং ফোগাটের জীবনের কিছু অংশ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমির খানকে যারা আইডল মানেন, তারা কোন দিকে হাঁটবেন। আমির খানের কোন বার্তা তারা নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করবেন? ভালোলাগা, ভালোবাসা, ইচ্ছা, অনিচ্ছা বাদ দিলে ক্যারিয়ারে সফলতা কিন্তু দুটির মাধ্যমেই এসেছে।
 

 

লেখক: উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
[email protected]