॥ নাসরীন নাহার ॥
মায়ের কথা কি লিখে শেষ করা যায়? কি লিখবো তাই ভাবছি। মা তো সার্বক্ষনিক আমায় ঘিরে রাখে। যখনই কোন ব্যাথা পাই মা করে চিৎকার করে উঠি কিংবা যখন খুব কষ্ট পাই কখন মাকে শেয়ার করি, দুর থেকে সে আমায় শান্তনা দেয়, আশ্বাস দেয়, সাহস দেয়, আমি এখনও মনে প্রানে বিশ্বাস করি আমার মা আমার সাথেই আছেন, হয়তো সশরীরে নেই। আমার নি:শ্বাসে আমার বিশ্বাসে আমার প্রতিটি শিরা ধমনীতে আমি টের পাই আমার মাকে।
আমার মা গ্রামের খুব সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। আমার মা আড়াই বছর বয়সে তার মাকে হারায়। দুই ভাই এক বোন। নানা নানীর কাছে মানুষ হয়েছিলেন তিনি। আবার বাবা প্রথম দেখাতেই মাকে পছন্দ করে ফেললেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে আমার মা’র বিয়ে হয় আর আমি ১৪ বছর বয়সেই তার কোল জুড়ে আসি। আমাকে সামলাতে তার খুব কষ্ট হতো। রান্না তেমন পারতেন না। আমার আব্বা হাজী মো: হানিফ হাওলাদার সরকারী চাকুরি করতেন। মাকে আব্বা খুব ভালোবাসতেন। মায়ের নাম ছিল ফজিলাতুন্নেসা কিন্তু আব্বা ভালোবেসে ফজিলাতুন নাহার বলে ডাকতেন। আমার মা খুব সুন্দরী ছিলেন কিন্তÍ পড়াশুনা করা হয়ে উঠেনি তার। সংসার সামলাতে সামলাতে আর পড়াশুনা করা হয়নি। কিন্তÍ প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন তিনি। আত্মসম্মানবোধ ছিলো প্রখর। আর মানুষকে সহজেই আপন করতে পারতেন তাই সবাই খুব ভালোবাসতো তাকে। ছোট বড়, ধনী গরীব সবাই তার ছিলো বন্ধু। অনায়াসে সবার মনের কথা নির্ধিধায় বলে ফেলতো তার কাছে।
আব্বা খুব সৎ হওয়াতে আমার মাকে দেখেছি খুব কষ্ট করতে। আমাদের চারভাই বোনের পড়াশুনা, আবদার মেটাতে আমার মাকে সেলাই করতে হয়েছে। কখনো বিশ্রাম নিতে দেখেনি। আজ আমার এই অবস্থান তা সম্পুর্ন আমার মায়ের অবদান। আমি চাকরী করবো এটা আমার আব্বা মেনে নিতে পারেনি কিন্তু আমার মা বলেছিলো মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়া দরকার। মেয়েদের স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তারপর থেকেই আমার এভাবেই পথচলা।
আমার সব কথা মায়ের সাথে শেয়ার করতাম। বুদ্ধি পরামর্শ নিতাম। আমি মেয়ে হলেও ছেলের মতোই ছিলাম। আমার খুব মনে পড়ে সারপ্রাইজিং দেয়াটা। আমি যখন দুরে চাকরী করতাম তখন আমি বাসায় আসার কথা বলতামনা। আম্মা ফোনের পর ফোন দিতেন, আমি বুঝতে দিতাম না। হঠাৎ যখন মায়ের গলা জড়িয়ে ধরতাম তখন যে খুশিটা দেখতাম সেটা যেন আজো আমার চোখে ভাসে। সেই খুশি সেই আনন্দ কি করে ভুলবো। চোখ দুটো যেন চিকচিক করে উঠতো।
রান্নায় ছিল আমার মা সেরা। সব সময় গেস্ট থাকতো আমাদের বাসায়। আমার আব্বাও মানুষকে খুব খাওয়াতে পছন্দ করতেন। কিন্তÍ কখনো দেখিনি তাকে বিরক্ত হতে। রাতে যদি বাজার করতো সেই সময় মাছ কেটে রান্না করেছে মা। আমি দেখেছি তার সাহস, ধৈর্য্য আর সহ্য ক্ষমতা।
খুব সুন্দর একটি পরিবার যেখানে সুখের কোন ঘাটতি ছিলোনা। কি যে হয়ে গেলো। ধাক্কাটা প্রথম খেলাম আমার আব্বার মৃত্যুতে। ২০০৭ সালে পবিত্র মদিনা শরীফে হজ্ব করতে গিয়ে আর ফিরে এলোনা আব্বা। জান্নাতুল বাকীতে পবিত্র মাটিতে তার আশ্রয় মিললো। তখনো বুঝতে পারিনি বাবা হরানোর বেদনা। পরম ভালোবাসায় যতেœ আমাদের আগলে রেখেছিলো আমার মা। আমার ছেলে মেয়েকে নিয়ে তার ভালোই কাটছিলো।
আমাদের জীবনে আসলো সেই দিনটি, আমাদের সব তছনছ করে দিয়ে গেলো। ১৪ই জুলাই ২০১২। হঠাৎ করেই চলে মা গেলেন না ফেরার দেশে। তারপর থেকে শুধু শুন্যতা চারিদিকে। অন্ধকারে ছেয়ে গেছে জীবনটা। এখন আর কেউ ফোন করে বলেনা খেয়েছি কিনা, কেউ আর আমার পছন্দের খাবার রান্না করে আমায় খাওয়ায় না, পরম যতেœ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়না। বুকের ভিতর এই কষ্ট কাউকে বলার মতো নয়। এখন বুঝতে পারি এই অমুল্য সম্পদ হারানোর বেদনা যে কি যন্ত্রনাদায়ক। যে কষ্ট দিয়েছি মনের অজান্তে তা যেন কুরে কুরে খায় আমায় সার্বক্ষনিক।
মায়েদের কখনো মৃত্যু হয়না। শুধু এইটুকু জানি মা হলো এক আত্মতৃপ্তির জায়গা। এক শান্তির জায়গা। এক নিরাপত্তার জায়গা। এত বড় পৃথিবীতে কত মানুষ কিন্তÍ মায়ের বুকটা যেন পৃথিবীর থেকেও বড়। এই কঠিন বাস্তবতা মেনে নিতে হয়।
কখনো ভাবিনি মাকে নিয়ে কিছু লিখবো। যা কিছু লেখা দরকার ছিল তার কিছুই লিখতে পারিনি। এই মহিয়সী নারীকে নিয়ে সব কথা লেখার ভাষা আমার জানা নেই। মনের ভাব প্রকাশ করতে পারিনি। মায়ের ছবিটা সামনে ভেসে আসলে সবকিছু কেন জানি এলোমেলো হয়ে যায়, সব ভাষা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। শত ব্যস্ততার মধ্যে এখনও চারিদিকে শুধু মাকেই খুঁজি।
লেখক: নাসরীন নাহার
নগর শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা,
বরিশাল সিটি কর্পোরেশন