logo
আপডেট : 8 February, 2019 20:37
ছোটগল্প
শরীর অথবা অশরীরী ভালোবাসা।। ফাল্গুনী তানিয়া
ফাল্গুনী তানিয়া

শরীর অথবা অশরীরী ভালোবাসা।।  ফাল্গুনী তানিয়া

ছেলেটি প্রণয়-স্পর্শে মেয়েটিকে রাঙাতে থাকে। ফুল ফুটুক অথবা নাই ফুটুক আজ বসন্ত। তোমাকে বসন্তের রঙে রঙিন হতে হবে। মেয়েটিকে পরিয়ে দেয় টিয়ে পাখির ঠোঁটের মত অল্প রাঙা একটি কোমর বন্ধনী। ওপরে সবুজ অরণ্যের মত একটি কাঁচুলি। তারপর নিপুন অভ্যস্ত হাতে মেয়েটির সুতনু কোমর স্পর্শ করে হলুদ শাড়িটির এক একটি ভাঁজ রোপন করতে থাকে। মেয়েটির মসৃণ কোমর আর সুডৌল স্তন বারবার ছুঁয়ে যায় পুরুষটির হাত। ছেলেটি নিজের শরীরে জীবন্ত কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করে। মেয়েটির কোমরের বাঁক যেখানে এসে থেমেছে সেখানে তার আঙুলগুলো খেলা করতে থাকে। তারপর আবার মেয়েটিকে সাজাতে থাকে। কাঁচুলির ফাঁকে মেয়েটির ফর্সা পিঠ; সেটাকে না ঢেকে শাড়িটিকে এমনভাবে ঘুরিয়ে আনে সে যে যে কোনো পুরুষ তাকে দেখে কামাতুর হয়ে উঠবে। মেয়েটির সৌন্দর্য বাড়াতে সবশেষে ছেলেটি তাকে পরিয়ে দেয় একটি লাল টিপ।

১০ ফুট দৈর্ঘ্য আর ৮ ফুট প্রস্থের এই ঘরটিতে মেয়েটির অবস্থান দরজা বরাবর। সবার চোখ যেন তার দিকে পড়ে সেজন্য তাকে সাজাতে বাড়তি মনোযোগ। ঘরটির বিভিন্ন প্রান্তে আধুনিক পোশাকে সজ্জিত আরো কয়েকটি মেয়ে আছে। চলতি ফ্যাশন চলমান করে রেখেছে তাদের। পোশাকগুলো এদের সুন্দর করেছে নাকি এদের সৌন্দর্যে পোশাকের রূপ বৃদ্ধি ঘটেছে সেটি বলা কঠিন। ছেলেটি মেয়েটির রূপসজ্জা শেষ করে ঘরটির দরজা খুলে দেয়। অবিরত গাড়ির হর্ন, রিক্সার টুংটাং যান্ত্রিক শহরের ব্যস্ততাকে বুঝিয়ে দেয়। একজন ক্লিনার তার চেনা হাসিটি ঠোঁটের কোণায় আলতো করে ঝুলিয়ে ছেলেটিকে ‘সুপ্রভাত’ জানায়। ছেলেটিও পরিচিত মানুষের হাসিটি মুখের চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। ইশারায় কুশল বিনিময় করে তারা। একটি বাণিজ্যিক হাসি সারাদিন ছেলেটির মুখে অবিকৃত থাকে। বিস্তৃত শহরের ছোট্ট ঘরে সব অপরিচিতের জন্য তার উন্মুক্ত হাসি। এই ছোট্ট ঘরটিতে সবসময় উৎসবের আমেজ। কখনো বাসন্তী সাজে, কখনো সাদা কালোয়, কখনো লাল সাদায় ছেলেটি প্রকৃতি আর সময়ের রঙ বদল টের পায়। ছোট্ট ঘরে বন্দি ছেলেটির সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোনো প্রিয় মানুষের সঙ্গ পাওয়া হয় না। রাতে বন্ধ ঘরের ভিতর তড়পায় তার সুখ-দুঃখের জীবনযাপন।

দিনের উত্তাপ এই ঠান্ডা ঘরটিতে বোঝা যায় না। পর্দার ফাঁক গলে রোদের দেখা মেলে না। ঘরের ছাদটিতে অসংখ্য সাদা বাল্ব এ ঘরের উজ্জ্বলতা অব্যাহত রাখে। সারাদিন অজস্র পা ঘরটির এ প্রান্ত  থেকে ও প্রান্ত পরিভ্রমণ করে। দুই জোড়া পা ছেলেটির দিকে এগিয়ে এসে। মেয়েটির দেড়শ টাকা দামের স্যান্ডেলটি তার পায়ের নগ্নতাকে উন্মুক্ত করেছে। ছেলেটির পায়ের বিবর্ণ জুতোজোড়া বাটা কোম্পানির অক্ষয়ত্ব ঘোষণা করছে। মেয়েটির পা দুটো এগিয়ে আসে, থমকে দাঁড়ায় মেয়েটির সামনে। মেয়েটির শাড়িটি ধরে দেখে, শাড়িটির এক প্রান্তে লাগানো নির্ধারিত মূল্যের স্লিপটি উঁচু করে ধরে ছেলেটির দিকে তাকায়। তারপর মস্তিষ্কের দ্রুত ক্রিয়ায় সে শাড়িটি ছেড়ে দেয়। ছেলেটির কাচুমাচু চেহারার দিকে তাকিয়ে ভরসার হাসি দেয় সে। ঘরটির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ধীরে ধীরে এগোতে থাকে মেয়ে পা। অবশেষে সাধ্যের ভিতর তার পছন্দের বস্তুটি মেলে। ঘর হতে বের হবার আগেও তবু তার দৃষ্টি মেয়েটির শাড়িটিতেই আটকে থাকে।

দিন পেরোলে কর্মব্যস্ত মানুষের ঘরে ফেরার তাড়া। ফিরবার আগে তারা দ্রুত সেরে নিতে চায় বাড়তি কাজটুকু। যাদের হাতে বাড়তি সময় নেয় তারাও ঘরে ঢুকেই মেয়েটির দিকে তাকায়। কখনো কেউবা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়, ইনটেক একটি প্যাকেট ব্যাগে ঢুকিয়ে আরো কয়েকটি ব্যাগের সঙ্গে সংযুক্ত করে আরো দ্রুত প্রস্থান করে। এভাবে দিন শেষে মেয়েটির গাত্রবস্তুটিও এক সময় কারো অভিমান ভাঙাতে প্যাকেটে ঢুকে পড়ে। হয়তো একটু পরেই কারো গায়ে উঠবে সে, তারপর প্রসাধন শেষে কোনো রেঁস্তোরার আলো-আঁধারিতে দম্পতি যুগল তাদের রাতের আহার শেষ করবে। রাগ যখন অনুরাগে গড়াবে তখন শাড়িটি রাতের শয্যার পাশে পড়ে থাকবে। সেই নারীটির নগ্নতার মত মেয়েটির নগ্নতা কোনো পুরুষকে শান্ত করে না। পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি মেয়েটির নগ্ন শরীরে ঘুরে বেড়ায়, পুরুষদের নারীসঙ্গিগুলো দ্রুত তাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যায়। হতে পারে বিবস্ত্র মেয়েটির নগ্নতা তাদের ভিতর লজ্জা আনে। অথবা বুভুক্ষু পুরুষ-চোখে নিজেকে নগ্ন হতে দেখতে পায়। কিংবা পুরুষের ভিতর গর্জে ওঠা পুরুষত্বকে তারা ভয় পায়।

ছেলেটি নতুন করে মেয়েটিকে সাজায় ভালোবাসার রঙে। লাল একটি জামদানি পরায় তাকে, আঁচল জুড়ে গোলাপের কাজ। মেয়েটির নগ্ন বুকে জড়ায় হাতা ছাড়া সোনালি কাঁচুলি। হাতে পরিয়ে দেয় টকটকে লাল রেশমি চুড়ি। মেয়েটি তার হাতটি সামান্য উঁচু করে কোমরের সাদা অংশের উপরে এক অসীম সৌন্দর্যের হাতছানি আঁকে। ছেলেটি মুগ্ধতা নিয়ে মেয়েটিকে দেখে। পরদিন মেয়েটিকে আরো দেখে সদ্য প্রেম হওয়া যুগল, অনেক দিন একত্র বাস করছে এমন দম্পতি, ভালোবাসা প্রত্যাখ্যাত যুবক যে হয়ত অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মত সদ্য প্রেম হওয়া বন্ধুর প্রেমিকার জন্য ভালবাসা দিবসের উপহার কিনতে এসেছে এবং তার মত অথবা তার মত নয় এমন আরো অনেকে। তাদের বিভ্রম জাগে কে পণ্য তাই ভেবে। মেয়েটি নাকি মেয়েটির পরণের লাল শাড়িটি। সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলঙ্কার। 

রাত নেমে এলে ঘরটির সামনের দরজা বন্ধ হয়। আগামী কাল বিশেষ দিবস বলে অনেক রাত পর্যন্ত ভালবাসাহীন, প্রিয়সঙ্গহীন যুবকটি মুখরিত মানুষের পদধ্বনি শুনেছে। প্রহরারত ছেলেটি অথবা যুবকটি অথবা নিঃসঙ্গ একাকী মানুষটি ঘরের বাতি নিভাতে থাকে এক একটি করে। সব শেষে একটি বাতি জ্বলতে থাকে ঘরের সামনে। ক্লান্তি আর অবসাদ তাকে ঘিরে ধরতে থাকে। মেয়েটির দিকে তাকায় যুবকটি। মেয়েটির হালকা গোলাপি আঁকানো ঠোঁট তাকে প্রলুব্ধ করে। রাত ও একাকিত্ব দুটোই বাড়তে থাকে। ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকায়, আবারো তাকায়... আবারো... জীবন্ত নারীর মত তাকে স্পর্শ করে, উত্তপ্ত ঠোঁট দিয়ে তাকে চেপে ধরে... শাড়ির নিচের অসীম রহস্যের ভেদ করতে চায় সে...স্তন, উরু, জংঘা... শক্ত হয়ে যাওয়া লৌহদন্ডটি ঠেসে ঢুকাতে থাকে একটি নিস্ক্রিয় নারীর শ্রোণিদেশে। যখন সমস্ত ক্রিয়া সম্পন্ন হয় বস্ত্রহীন, বিচ্ছিন্ন, খন্ড খন্ড ম্যানিকুইনটি মেঝেয় পড়ে থাকে। তার পাশে শুয়ে থাকে অবশ, অবসন্ন যুবকটি অথবা মেয়েটির প্রেমিক অথবা ধর্ষণকারী।