একুশে পদকপ্রাপ্ত লোকসংগীত শিল্পী সুষমা দাস বলেছেন-হাজারো গান আমার মনের সংগ্রহশালায় আছে। এখনকার শিল্পীদের মতো রেকর্ডিং করে সিডিতে সংরক্ষন করতে পারিনি। তাই মনের সংগ্রহশালায় যতœ করে রেখে দিয়েছি। জীবনের নব্বই বসন্ত পার করা নন্দিত এই শিল্পী সংগীত সাধনা করছেন প্রায় ৮৪ বছর। বাংলাদেশের লোকসংগীতের জীবন্ত কিংবদন্তি এই শিল্পী কথা বলেছেন নিউ ইয়র্ক মেইলের সাথে।
সুষমা দাস বাংলা ১৩৩৬ সালে সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা থানার পুটকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রসিক লাল দাস, মাতা দিব্যময়ী দাস। ১৩৫২ সালে একই থানার চাকুয়া গ্রামে প্রাণনাথ দাসের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ধামাইল, কবিগান ও বাউলগানের পাশাপাশি হরি জাগরণের গান, গোপিনী কীর্তন, বিয়ের গানসহ ভাটি অঞ্চলে প্রচলিত লোকজ ধারার সকল ধরনের গান গেয়েছেন তিনি। তার গাওয়া গুষট, বাল্যলিলা, রাখালবনের খেলা, বকবধ, কালিদয়, মুক্তালতাবলী, সুবলমিলন গানের কারণে নিজের এলাকা থেকে শুরু করে একসময় সারা দেশে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
নিউ ইয়র্ক মেইল: কেমন আছেন?
সুষমা দাস: শরীরটা বেশ ভালো নেই। আগের মতো তেমন একটা হাঁটা-চলা করতে পারছিনা। একটু হাঁটলেই দেহটা হাঁস ফাঁস করে ওঠে। তবে নিজের মনোবলের জোর দিয়ে চলার চেষ্টা করি। বয়স তো হয়েছে ৯০ এর বেশি। চলতে না পারলেও গানের কথা বললেই কোথা থেকে যেন মনে জোর আসে । আর এ কারণে মনের সুখে গান গাইতে পারি এখনও।
নিউ ইয়র্ক মেইল: কিভাবে আসলেন গানের জগতে?
সুষমা দাস: আমাদের বাড়ির মহল ছিলো গানের পরিবেশে আবদ্ধ। আমার দাদা-দাদি সবাই গান গাইতো। আর বাবাও গান গাইতো কবি গান, লোক গান, বাউল গান ছাড়াও আরও কিছু গ্রাম্য গান। এই সব গান বাড়ির মধ্যে শুনতে শুনতে কবি গানের প্রতি ঝুঁকতে থাকি। কেন জানিনা, কবি গান আমার খুবই ভালো লাগতো। ৫/৬ বছর বয়স থেকেই গানের জগতে আসা। বাবার সাথে আমি ছোট বেলা থেকে গ্রামের বিভিন্ন আসরে গান গাইতে যেতাম। সেখানে অনেক বড় বড় গানের ভাবকদের আগমন হতো। তাদের গানগুলো শুনে শুনে আমি আয়ত্ত করতাম মনের মধ্যে।
নিউ ইয়র্ক মেইল: আপনার বাবা-মা কি করতেন ?
সুষমা দাস: আমার মা দিব্যময়ী দাস একজন গৃহিণী ছিলেন। তবে তিনি গানও গাইতেন। আর বাবা রসিক লাল দাস একজন সংগীত সাধক ছিলেন ।
নিউ ইয়র্ক মেইল: এই বয়সে এসে মাকে কি মনে পড়ে ?
সুষমা দাস: (গলা কেঁপে উঠে প্রবীন এই শিল্পীর) কেন মনে পড়বেনা মাকে? অবশ্যই মনে পড়ে মাকে। মা যে আমার জন্য কি ছিলো তা বলে বুঝাতে পারবো না। একথা বলেই কাঁদতে থাকেন তিনি। হাত দিয়ে চোখের টলমল করা জল মুছতে মুছতে বলেন, যখন কেউ মাকে উৎসর্গ করে গান করে কিংবা মাকে উদ্দেশ্য করে কোন গান গায়, তখন আমি মন দিয়ে শুনতে থাকি। একটা গান আছেনা ‘মায়ের মতো আপন কেউ নাইরে’ ওই গানটি শুনতে খুবই ভালো লাগে।
নিউ ইয়র্ক মেইল: মঞ্চে জীবনের প্রথম গানের কথা কি মনে আছে ?
সুষমা দাস: বাবার সাথে প্রথমে মঞ্চে গেয়েছি কবি গান দিয়ে। গানটি ছিলো নন্দ বিদায়। ‘শ্রীকৃষ্ণকে মারার জন্য কংস মামা ফাঁদ পেতে রেখেছিলো নানা ভাবে। সেই ফাঁদেও কাজ হয়নি কংস মামা। অবশেষে কংস মামাকে শ্রীকৃষ্ণের হাতে বধ হতে হলো’ ওই গানটি গেয়েছিলাম।
নিউ ইয়র্ক মেইল: সংসার সামলাতে গিয়ে গান ধরে রাখতে কোন অসুবিধা হয়েছিলো ?
সুষমা দাস: হ্যাঁ। হয়েছিলো। বিয়ের পর গান করতে গিয়ে আমার বাবাকে পাড়া প্রতিবেশির লোকেরা বলতো ‘রসিক দেখো তোমার মেয়ে এখনো গাই গাইছে’। তখন বাবার ওদের কথায় কোন পাত্তাই দিতো না। বাবা আমাকে উল্টো গানের প্রতি আরও উৎসাহ জোগাতো।
নিউ ইয়র্ক মেইল: গানের জগতে আপনার গুরু কে ছিলেন ?
সুষমা দাস: গানের জগতে আমার হাতে খড়ি শিক্ষা- দিক্ষা-গুরু সবই আমার বাবাই।
নিউ ইয়র্ক মেইল: একুশে পদক পাওয়ার খবর কিভাবে পেয়েছিলেন?
সুষমা দাস: নিত্যদিনের মতো বসে টিভি দেখছিলাম। হঠাৎ দেখি টেলিভিশনের পর্দায় একুশে পদক প্রাপ্তিদের মধ্যে আমার নাম দেওয়া আছে। তখনই আমি নিশ্চিত হই। পরে ঢাকায় গিয়ে লোক সঙ্গীতের উপর বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৭সনে একুশে পদক গ্রহণ করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে।
নিউ ইয়র্ক মেইল: একুশে পদক পেয়ে অনুভুতি কেমন ছিল?
সুষমা দাস: একুশে পদক পেয়েছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দেশের মানুষের ভালোবাসার জন্য। এই পদক আমার জীবনকে ধন্য করেছে, স্বার্থক করেছে আমার গানের ভুবনকে।
নিউ ইয়র্ক মেইল: একুশে পদক ছাড়া আর কি কি পুরুষ্কার পেয়েছেন।
সুষমা দাস: হ্যাঁ পেয়েছি। ঢাকা শিল্পকলায়, সিলেট বেতার, জালালাবাদ হাইস্কুলে, শিল্পকলা গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে, সিলেট নাট্য শিল্প গোষ্ঠীর সংবর্ধনায়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, সিলেট সিটি কর্পোরেশন থেকে, কলকাতার বাউল ফকির উৎসবে, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এছাড়াও আরো অনেক বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে আমায় পদক দেওয়া হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক মেইল: গান ছাড়া আপনার আর কি করতে ভালো লাগে ?
সুষমা দাস: গান ছাড়া মানুষের সাথে গল্প করতে আর পান-সুপারি খেতে ভালো লাগে। তাই কোন জায়গাতে ঘুরতে গেলেই আমার একটা ছোট ডিব্বিতে করে পান-সুপারি নিয়ে যাই। তারপর সেখানে পান-সুপারি খেতে খেতে সবার সাথে গল্প করি। সাথে যদি কোন মানুষ থাকে তাহলে আমার দিনটি ভালোই কেটে যায়।
নিউ ইয়র্ক মেইল: শুনেছি কলকাতার বিখ্যাত সংগীত শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক আপনার দারুন ভক্ত ?
সুষমা দাস: শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক একজন সংগীত গবেষক। ও পুরাতন গান খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করে রাখে। সেই সুবাদে ওর সাথে পরিচয়। ও একদিন পুরাতন সংগীতের সন্ধানে সুনামগঞ্জে গিয়েছিলো শ্রদ্ধেয় বাউল সাধক শাহ আবদুল করিমের বাড়িতে। তখন করিম ভাই বলেছিলেন, তুমি তো পুরাতন গান সংগ্রহ করো। বাংলাদেশে একজন প্রবীণ এক সংগীত শিল্পী আছে সুষমা দাস নামে। উনার কাছে পাবে অনেক পুরাতন গান। তিনি বেঁচে আছেন কিনা জানিনা। তবে তিনি সিলেটেই থাকেন।
তারপর মৌসুমী ভৌমিক আমার সন্ধানে সিলেটে আসেন প্রবীণ শিল্পী চন্দ্রবর্তী রায় বর্মনের বাড়িতে। চন্দ্রবর্তী দিদির ছেলে ভবতোষ আমাকে ফোন করে বলে মাসিমা ভারত থেকে এক নারী সংগীত গবেষক এসেছেন আপনার সন্ধানে। উনি আমাদের বাড়িতে উঠেছেন শুধু আপনার সাথে দেখা করার জন্য। তারপর আমি মৌসুমী ভৌমিকের সাথে দেখা করি সেখানে গিয়ে। দেখা মাত্রই আমাকে মৌসুমী বলে, আপনার সন্ধান পেয়েছি বাউল সাধক চাচা আবদুল করিমের কাছ থেকে। এরপর ওর সাথে অনেক বিষয় নিয়ে আলাপচারিতা হয়। তারপর মৌসুমী আমাকে কলকাতায় আমন্ত্রন জানান। সেখানে আমি শ্রদ্ধেয় দাদা শাহ আবদুল করিমের ‘‘এখন আমি কি করিবো ও প্রাণ নাথ তুমি বিনে, আমার সোনার অঙ্গ পুড়ে অঙ্গার হইলোরে দিনে দিনে’’ গানটি গেয়েছিলাম। এই গানসহ দূর বিন শাহ ও রাধা রমনের গান গেয়েছিলাম। ওই অনুষ্ঠানটি আমাকে দিয়ে উদ্ধোধন করানো হয়। গত বছর ডিসেম্বর মাসেও মৌসুমী আমাদের বাসায় এসেছিলো আমার সাথে দেখা করার জন্য।
নিউ ইয়র্ক মেইল: বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম সম্পর্কে কিছু বলুন।
সুষমা দাস: শ্রদ্ধেয় বাউল সাধক শাহ আবদুল করিম ভাই এর সাথে আমার স¤ন্ঠর্শ ছিল ভাই- বোনের মতো। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। একদিন তিনি একটি গান তৈরি করেছিলেন আর সেই গানটি আমাকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। যখন আমি গেলাম তখন করিম ভাই আমাকে বলে বোন তুমি এসেছো। গানটি আমার। তোমার যেভাবে সুর মনে হয় আমি সেভাবে গাইবো। এই বলতে না বলতেই আমি শ্রদ্ধেয় শাহ আবদুল করিম ভাইয়ের লিখা গানের সুর তুললাম। ”আমার বন্ধুরে পাবোরে সখী তোরা বলনা, বন্ধু বিনে পাগল মনে বুঝাইলে বুঝে না গো...আমারে সখী তোরা বলনা”। গানটি গাওয়ার পর করিম ভাই আমাকে বলে দিদি আমার এই গান লেখা স্বার্থক হয়েছে। আপনি খুবই সুন্দর করে গানটি গেয়েছেন। তিনি নিজেও খুবই ভালো মানুষ ছিলেন।
নিউ ইয়র্ক মেইল: আপনার ভাই পণ্ডিত রাম কানাই দাসও তো একুশে পদক পেয়েছেন। তার সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
সুষমা দাস: ছোট ভাই রাম কানাই দাসকে আমি বলেছিলাম ভাই ”তোর গলায় লোক সংগীত খুবই মানাবে। তুই লোক সংগীত চর্চা করলে অনেক দূর এগুতে পারবি। তারপর থেকে ভাই লোকসংগীতের প্রতি মনোনিবেশ দিল। আর বের করল একের পর এক অ্যালবাম। সেই অ্যালবামগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পায় ওই সময়।
নিউ ইয়র্ক মেইল: এই বয়সে এখনও কিভাবে গান সংগ্রহ করে রাখেন ?
সুষমা দাস: আমার কোন সংগ্রহশালা নেই। আমি যে কোন ধরনের গান আমার মনে যদি একবার ভালো লাগে, তাহলে সেই গানটি আমি কোনভাবেই হোক মনের মধ্যে গেঁথে রাখি। তা কোন লেখার মাধ্যমে না। আমি মন দিয়ে গান শুনি, মন দিয়ে মনের মধ্যে গান তৈরি করি। ওই গান আবার আমি নিজে নিজেই গেয়ে থাকি। হাজারো গান আমার মনের সংগ্রহশালায় আছে। এখনকার শিল্পীদের মতো রেকর্ডিং করে সিডিতে সংরক্ষন করতে পারিনি। তাই মনের সংগ্রহশালায় যতœ করে রেখে দিয়েছি।
নিউ ইয়র্ক মেইল: ঘাটু গান, হরি গান, লোক গান, কবি গান সম্পর্কে কিছু বলেন।
সুষমা দাস: কবি গান, ঘাটু গান, হরি গান, লোক গান গাইতে হলে খুবই সচেতনভাবে ঢোল বাজাতে হয়। এই ঢোল বাজানো এতো সহজ নই । ঢোল বাজানো ঠিক না হলে গানের সুরও ঠিকভাবে গাওয়া যায়না। সুর মধ্য খানে থমকে যায়। তবে এই গানগুলোর মধ্যে আমার কবি গান বেশি ভালো লাগে। বর্তমানে যে কবিগান গাচ্ছে অনেকেই ছড়া দিয়ে বিশ্লেষণ করে তা কিন্তু আমাদের সময়ের কবি গানের সাথে অনেক পার্থক্য আছে। কবিগানে খুব বেশি সচেতন ভাবে ঢোল বাজাতে হয়।
নিউ ইয়র্ক মেইল: জীবনের এই পর্যায়ে এসে আপনার আর কোন কিছু চাওয়ার আছে ?
সুষমা দাস: মানুষের তো চাওয়ার কোনো শেষ নেই। তবে আমার আর তেমন কিছু চাওয়ার নেই। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমার চাওয়া একটাই-আমার গানগুলো সংরক্ষনের জন্য একটা সংগ্রহশালা থাকুক। ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন আমার গান শুনতে পারে। এখনো সহ¯্রাধিক গান মনের মধ্যে গেঁথে আছে। একটু একটু করে আমার সন্তানরা প্রায় শতাধিক গান লিখে রেখেছে। মৃত্যুর আগে এসব গান নিয়ে যদি ক্যাসেট বের করতে পারি তাহলে শান্তি পাবো। অনেকেই আশ্বাস দিয়েছেন কিন্তু কেন জানি না এখনো ক্যাসেট বের করতে পারিনি।
নিউ ইয়র্ক মেইল: সংগীত জীবনের কোনো বিশেষ ঘটনা কি মনে পড়ে ?
সুষমা দাস: ১৩৪৫সনে দশ সাড়ে দশ বছর বয়সে আমি ভূবনের কীর্তন গেয়েছিলাম সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা থানার পুটকাতে। ওই সময় গ্রামে ভালো বড় গৃহস্থ সম্মানী মানুষের বাড়িতে একটি অনুষ্ঠান ছিলো। ওই বাড়ির মেয়ের জামাই এড. শুকলাল বাবু এসেছিলো আমাদের বাড়িতে। তিনি এসে বলেন, আমাদের সুষমা নাকি খুবই ভালো গান করে। ওকে আমাদের বাড়ির অনুষ্টানে গান গাইতে হবে। তারপর আমি ওই অনুষ্টানে রাধা কৃষ্ণ মিলনের গান গেয়েছি ৫/৬টি খ-ের।
গানটি ছিলো- ‘‘কুঞ্জ বনে কানুর সনে বসে বিনোদিনী। কই গেলা যত দুঃখের কাহিনী। পহসনে প্রেম করিয়া, আমি অভাগীনি। বকুল জুরিয়া সবে কই কলঙ্কিনী। ’’ গানটি শুনে মুগ্ধ হয়ে ওই সময় আমাকে মোটা অঙ্কের পাঁচশত টাকা দেওয়া হয়েছিলো পুরস্কার হিসেবে। তা পেয়ে আমি আনন্দে খুশীতে আত্মহারা হয়েছিলাম। এখন মনে হয় ওই পুরস্কারটিও ছিলো একুশের পদকের মতো।
নিউ ইয়র্ক মেইল: নিউ ইয়র্ক মেইলকে সময় দেবার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সুষমা দাস: গল্পে গল্পে আমায় আবার পুরাতন দিনগুলোর কথা মনে করে দেওয়ার জন্য তোমাকেও ধন্যবাদ ও আর্শিবাদ।