॥ ড. ফাল্গুনী তানিয়া ॥
আমার মায়ের ভালো নাম তাহমিনা, ডাক নাম আলেয়া। নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার যাত্রাপালা দেখে এসে আমার মায়ের মামা দেখে তার একটি ফুটফুটে ভাগ্নি হয়েছে। তিনি তার নাম রাখেন আলেয়া। যাত্রাপালার আলেয়ার মত আমার মায়ের জীবন বর্ণাঢ্য নয়। আমার মায়ের শৈশবেই তার মা মারা যায়। বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। সুতরাং মায়া-মমতার প্রাচূর্য তার জীবনে কখনো আসেনি। পড়াশুনার তেমন কোনো সুযোগও তিনি পাননি। বোঝার বয়স হবার পূর্বেই তাঁর বিয়ে হয়ে যায় আমার এতিম বাবার সঙ্গে। আমার বাবা এতিম হবার কারণে তার গোষ্ঠীর সবাই তাকে পালন করেছে এমন দাবি জানায় আমার মায়ের কাছে। সুতরাং তাদের সবার মনতুষ্টি জোগাবার জন্য আমার ছোট্ট মাকে প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হত সারাদিন। রাসসুন্দরীর আমার জীবন পড়ে আমার মাকেই আমি বারবার চোখের সামনে দেখকে পেয়েছি। যৌথ পরিবারে শ্বাশুড়ির সন্তান লালন-পালনসহ রান্না-বান্না ও গৃহস্থালীর অন্যান্য কাজে কখনো তিনি ঠিক সময়ে খেতে পারেননি। কখনো কখনো সবার খাবার পরে ভাল কোনো খাবার তার পাতে জোটেনি। অবসরে কখনো কখনো তিনি আমার কাছে স্মৃতিচারণ করেছেন, যখন তিনি কাপড় ধৌত করতে পুকুরে যেতেন কেউ তার শাড়িটি এনে বলতেন বৌমা, এটা ধুয়ে দিও। কেউ তার শার্টটি নিয়ে এসে বলত, ভাবি এটা ভাল করে পরিষ্কার করে দাগগুলো উঠিয়ে দিও তো। কেউ বা তার লুঙ্গিটি দিয়ে যেত। দুপুরের রান্না শেষ করে এসে সবার পরিধেয় ও ব্যবহৃত কাপড় পরিচ্ছন্ন করার পর স্নান শেষে তার আহার পর্ব গড়াত বিকালে অথবা সন্ধ্যায়। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে তার রূপ তাকে কোনো সাহায্য করেনি, করেছিল তার গুন। আর শ্বশুর বাড়িতে টিকে থাকার জন্য লড়াইটি ছিল অপরিহার্য কারণ তিনি ছিলেন মাতৃহারা। এই আমার মা, খুব সাধারণ একজন নারী। কিন্তু আমার চোখে আমার মা অসাধারণ। আমার মায়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তিনি একজন মানবিক মানুষ আমার কাছে। আমি তার কাছ থেকে শিখেছি প্রতি মুহূর্তে কীভাবে একজন নারীকে তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই করতে হয়।
আমার বাবা কর্মসূত্রে বাড়ি থেকে দূরবর্তী স্থানে অবস্থান করতেন। আমার অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মাই আমাকে ও আমার বড় ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তিনি নিজে শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত ছিলেন বলে সারাজীবন লেখাপড়া বিষয়ে আমাদের উৎসাহী করেছেন। সন্তানের লেখাপড়ার বিষয়ে তিনি আপসহীন ছিলেন বলেই সারাবছর তিনি আমাদের জন্য গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করেছিলেন। স্থানীয় পরিভাষায় যাকে বলা হত ‘লজিং মাস্টার।’ এইসব লজিং মাস্টারদের নানাবিধ আবদারও তাকে রক্ষা করতে হয়েছে। তাদের পছন্দ-অপছন্দ মেনে মাকে খাদ্য নির্বাচন করতে হয়েছে। নিজে ভাল খাবারটি না খেয়ে সন্তানের মঙ্গলের জন্য তিনি লজিং মাস্টারদের জন্য ঘরের মুরগির ডিমটি, পুকুরের বড়মাছের মাথাটি তুলে রেখেছেন। মনে পড়ে আমার ভাইয়ের আবদার ছিল যতক্ষণ মা জেগে থাকবে ততক্ষণ সে পড়বে। আমার পরিশ্রান্ত মা রাত জেগে ভাইয়ের পাশে বসে থাকত, মায়ের চোখ বন্ধ হয়ে আসত, মায়ের মাথাটা নিচে নেমে আসত, মা আবার সোজা হয়ে বসত। রাত বারোটার সময় আমার ভাই যদি আবদার করত এক মগ চায়ের আমার মা পাঠকাঠি দিয়ে মাটির চুলোয় চা বানাতে বসত। সন্তানের সব আবদার তিনি হাসিমুখে সহ্য করেছেন। আমার ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষাতে সফল হবার পিছনে আমার মায়ের আত্মত্যাগ ও উদ্যমই একমাত্র কারণ। আজ আমার ভাই একজন প্রকৌশলী যা মায়ের নিরলস প্রচেষ্টার ফল। আমার শিক্ষাগত অবস্থানের পিছনেও আছেন আমার মা। পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষিতে নিঃসন্দেহে অসামান্য সাফল্যের বিষয়। বিবাহ পরবর্তী জীবনে সন্তান প্রসবের পর আমার পড়াশোনা অব্যাহত রাখা ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। যার সবটুকু সম্ভব হয়েছে আমার মায়ের একরোখা মনোভাবের কারণে। দীর্ঘসময় যশোরে আমি আমার মায়ের কাছে থেকে গবেষণার কাজ করেছি। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নিজের সংসার না করে মায়ের সংসারে থাকাতে নানা লোকের নানাবিধ মন্তব্য ও বিদ্রুপ আমার মাকে সহ্য করতে হয়েছে। আমার মা সেগুলো আমাকে জানতেও দেয়নি। তিনি নিজের সংসার থেকে ছুটি নিয়ে দীর্ঘসময় আমার সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে আমার শিশুপুত্রকে দেখা-শুনা করে আমার গবেষণার কাজে সহায়তা করেছেন। একজন মানুষ যদি তার স্বপ্নের সমান বড় হয়, আমি বলব আমি আমার মায়ের স্বপ্নের সমান বড়। তিনি তার নিজের জীবনে যা পাননি তার সন্তানের জীবনে সেইসব অপূর্ণতা তিনি রাখতে চাননি। আমি তার স্বপ্নের পথে এখনো গুটি গুটি পায়ে হাঁটছি।
জীবনের প্রতিটি বাঁকে আমার মায়ের দর্শন দ্বারা আমি প্রভাবিত হয়েছি। ধর্ম, বর্ণ, জাতি কিংবা গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে কীভাবে একজন মানবিক মানুষ হতে হয় তিনি আমাকে শিখিয়েছেন। বাংলাদেশে একজন নারীর সামাজিকীকরণ যেভাবে হয় আমি সেভাবে বড় হয়ে উঠিনি আমার মায়ের কারণে। স্কুল জীবন থেকেই আমার ছেলে-বন্ধুরাও আমার মেয়ে-বন্ধুর মত আমাদের বাসায় সমানভাবে আদৃত হয়েছে। বাবার চাকরিসূত্রে ঢাকায় আসার পর ছেলে-মেয়ের পারস্পরিক সমঝোতাপূর্ণ বন্ধুভাবাপন্ন পরিবেশে বড় হতে আমার মা সাহায্য করেছেন। বন্ধুত্বের দূরত্বের সীমারেখাটুকুও তার কাছ থেকেই শিখেছি। বড় হবার পর বড় বড় তাত্ত্বিকদের লেখা পড়ে আমি নতুন কিছু পাইনি। তাত্ত্বিকরা এমন অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি যার সহজ সমাধান পেয়েছি আমি আমার মায়ের কাছে। যখন প্রশ্ন করেছি, বিয়ের পর যদি কোনো স্বামী অন্য কোনো নারীতে আসক্ত হয় তার সঙ্গে সংসার করা যায়? তিনি বলেছেন, মা, মানুষের মনের উপর কারো কোনো হাত নেই। মন বড় বিচিত্র বিষয়। যে জিনিস ¯্রষ্টা নিয়ন্ত্রণ করে তার জন্য মানুষকে অপরাধী বলা যায় না। সংসার আর প্রেমকে তিনি আলাদা করেছেন সন্তানের মাধ্যমে। সন্তানের জন্য সর্বস্ব উজাড় করা জননী আমার কখনো সংসার ভাঙতে উৎসাহ দেননি। ব্যক্তিগত চাহিদার জন্য সন্তান ভূক্তভোগী হবে এ তাঁর কাছে চরম অন্যায় কাজ। আজ যাকে ভাল লাগছে না বিচিত্র মনে হয়ত সেই একদিন অপরিহার্য হয়ে উঠবে এই তাঁর মত। যে কোনো সম্পর্ককে বীজ থেকে লালন করতে শিখেছি আমি তাঁর কাছে।
দেখেছি যত্ম করলে যে কোনো সম্পর্কই একদিন মহীরুহ হয়ে আশ্রয় দেয়, ছায়া দেয়, ফল দেয়, নতুন বীজের উৎপত্তি হয় সেই ফল থেকে। আমার মাকে কোন গ্রামের কোন ফকির তার নাম-ধাম, সুখ-দুঃখের কথাও মন দিয়ে শুনতে দেখেছি। কার ছেলে ভাল না, কার ছেলে-বৌ খেতে দেয় না, কার স্বামী মারা গিয়েছে সব ছিল তার মুখস্ত। ভিক্ষার চালের সঙ্গে গাছের আমটা, কুলটা, কলাটা সব সময় তাদের ঝুলিতে ঠাঁই পেত। কারো দুঃখের কথা শুনলে মায়ের চোখে সহজেই পানি চলে আসত। তাদেরকে নিজের আম, সুপারি, কাঁঠাল বিক্রির জমানো টাকা থেকে সাহায্যও করতে দেখেছি। এমনকি যখন সিনেমাতে কষ্টের কোনো মুহূর্ত আসত মা কাঁদত। কারো কষ্টে দুঃখ পাবার সহজ শিক্ষাটিও তাঁর কাছ থেকে পাওয়া। কোনো ধর্মীয় শিক্ষার আগেই মায়ের ব্যবহারিক শিক্ষা থেকেই আমরা ভাল-মন্দ, পাপ-পূণ্যের মানবিক শিক্ষার হাতেখড়ি পেয়েছি। তাই জীবনে কখনো পথভ্রষ্ট হইনি। আমার মা আমার আলো। কখনো প্রখর রোদের দীপ্তি তার, কখনো চাঁদের মত কোমল। ছায়ার মত তাঁর শিক্ষা আমার পাশে পাশে চলেছে। তাই আমার জীবনের প্রকৃত ধ্রুবতারা তিনি। তাঁর পথনির্দেশে জীবন-সমুদ্রে আমি কখনো পথহারা হইনি। ‘যেথা আমি যাই নাকো/ তুমি প্রকাশিত থাকো, আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা।। তব মুখ সদা মনে জাগিতেছে সংগোপনে/ তিলেক অন্তর হলে না হেরি কূল-কিনারা। কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি/ অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।’
লেখক:
খন্ডকালীন শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
পিএইচ.ডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ফাল্গুনী তানিয়া মূলত একজন গবেষক। ১৯৮২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যশোরের সারসা থানায় তিনি জন্মগ্রহন করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে ২০০৮ সাল থেকে তিনি শিক্ষকতা পেশায় আছেন। মাল্যবান ও রাত ভ'রে বৃষ্টি : প্রধান নারী চরিত্রের নারীবাদী আলোচনা, হিমু এবং আমরা তার প্রকাশিত গ্রন্থ। গ্রন্থ দুটি মূলত তার সুদীর্ঘ গবেষণার ফল। ‘বাংলাদেশের নারী লেখকদের উপন্যাস : নারী চরিত্রের স্বরূপ’ নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়ে পিএইচ.ডি করেছেন লেখক।
[প্রিয় পাঠক, নিউইয়র্ক মেইল যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত সর্বাধিক জনপ্রিয় বাংলা অনলাইন। এই অনলাইনের” আমার চোখে আমার মা” বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। মা'কে নিয়ে আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। আপনি এবং মায়ের ছবিসহ মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। লেখা প্রকাশ ছাড়াও আমাদের রয়েছে বিশেষ পাবলিকেশন-এর পরিকল্পনা।]
এছাড়া প্রবাসে আপনার কমিউনিটির নানান খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।