মালয়েশিয়া সরকার নির্বাচনে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের পথেই হাঁটছে। দেশটির ১৪ তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসা 'পাকাতান হারাপান'। কর্মী চাহিদা পূরনের জন্য ৬০ উর্ধ বয়ষ্কদেরকে কর্মে ফিরে আসার আহব্বান করা হয়েছে।
একই সাথে সিনিয়র নাগরিকদের কর্ম ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়ার কথাও বলেছেন দেশটির মানব সম্পদ মন্ত্রী কুলাসেগারান।
শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) দেশটির 'দিষ্টার' অনলাইনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।
ক্ষমতায় আসার প্রথম বার্ষিকী উদযাপনের সময় মানব সম্পদ মন্ত্রী এম. কোলাসেগারান স্বীকার করেন যে, বিদেশি কর্মী পরাস্ত করা একটি কঠিন সমস্যা। নতুন উদ্ভট কিছু শিল্পের অদ্ভুত দাবির মুখে তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি জানিয়ে মানব সম্পদ মন্ত্রী এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সরকার বিদেশী কর্মী ইস্যুতে নিজেদের অপরাগতার দায় শিকার করেছে। বিদেশী কর্মী ইস্যুতে নির্বাচনের আগে দেশটির আদিবাসিদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকারের ব্যর্থতার আভাসই যেনো পাওয়া যায় মানব সম্পদ মন্ত্রী এম. কোলাসেগারানের মন্তব্যে।
সংশ্লিষ্ট নির্ভযোগ্য একটি সূত্রে জনা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ লাখ ১৪,২০০ স্থানীয়রা চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারেনি যা মালয়েশিয়ার মোট শ্রমশক্তির ৩.৩ শতাংশ। যেখানে ২০১৭ সালে ৫ লাখ ২,৬০০ জন বেকার ছিল। এ পরিসংখ্যান মতে প্রতি বছর ২.৩ শতাংশ বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ দিকে অবৈধ অভিবাসী আটকে মালয়েশিয়ার সর্বত্রয় চলছে অভিযান। পরিস্থিতি অবোলোপনে বুঝা যাচ্ছে যে, বর্তমান সরকার তাদের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পূরণের পথেই হাঁটছে।
পাকাতান হারাপান প্রশাসন প্রথম মেয়াদে বিদেশী কর্মীদের সংখ্যা হ্রাস করার অঙ্গীকার করেছিল এবং 'কখনোই শেষ না হওয়া এই ইস্যু' কীভাবে মোকাবেলা করবেন এ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনাও ছিলো।
"এটি তাদের (শিল্প মালিক) জন্য একটি বড় সমস্যা, কারণ তারা দাবি করে যে তাদের বেশি কর্মী প্রয়োজন। কাজ করার জন্য স্থানীয় কর্মী নেই।''
বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী প্রচারণায়, সরকারের প্রথম মেয়াদে বিদেশী কর্মীদের সংখ্যা ৬০ লাখ থেকে কমিয়ে ৪০ লাখে নিয়ে আসার অঙ্গীকার করেছিল।
বিদেশী কর্মীদের সর্বশেষ পরিসংখ্যান উল্লেখ করে কোলাসেগারান জানান, গত বছরের মে মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন তার একটি বিদেশী কর্মীদের 'কখনও সমস্যা শেষ না হওয়া ইস্যু'। তিনি বলেন- "অনেক মালয়েশিয়ানরা হয়তো জানেন না যে বিদেশী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে মানর সম্পদ মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে। শুধুমাত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।''
তবে তিনি যোগ করেছেন, প্রতিশ্রুতির কথা মনে রাখবে পাকাতান। বিদেশী কর্মী হ্রাস করা অসম্ভব কিছু না। শিল্প মালিকদের নির্দেশনা দেয়া আছে, যা বিদেশী কর্মীদের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনবে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার এক বছরে স্থানীয় ও বিদেশী উভয় কর্মীদের উত্তম জীবন ব্যাবস্থা দিতে সমর্থ হয়েছে। যা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব আমরা তাই করব। অসম্পন্ন সমস্যা সামাধানের আরো সময় দরকার বলে জানিয়েছেন মানব সম্পদ মন্ত্রী এম. কোলাসেগারন।
মধ্যপ্রাচ্যের পর সবচেয়ে বড় এই শ্রমবাজার। মালয়েশিয়া সরকার এই বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠক করলেও এই বাজার নিয়ে এখনও কোনও বিষয় স্পষ্ট নয়। সর্বশেষ মালয়েশিয়া সরকার জানিয়েছে
বিদেশি শ্রমিকদের জন্য একটি অনলাইন জব পোর্টাল খোলা হবে, যার মাধ্যমে সেদেশে নতুন শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু কবে নাগা
দ চালু হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই সংশ্লিষ্ট কারও। তবে আশার কথা জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী এম কুলাসেগেরান।
তিনি বলেছেন, মালয়েশিয়া সরকারের অনলাইন মাধ্যমে নতুন লোক নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে, বিশেষ করে নেপাল এবং বাংলাদেশের জন্য কয়েক মাসের মধ্যে চূড়ান্ত হবে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে মালয়েশিয়ায় গেছেন ১৮ হাজার ৮৯৩ জন। এরপর ডিসেম্বর মাসে গেছেন ১ হাজার ৪৭৬ জন। এই বছর জানুয়ারি মাসে ২১ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ১৪ জন এবং মার্চ মাসে ২০ জন মালয়েশিয়ায় গেছেন। সর্বশেষ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে এমন স্থবিরতা দেখা গিয়েছিল ২০০৯ সালের পর। বাংলাদেশি জনশক্তি রফতানির অন্যতম এই বাজার ২০০৯ সালে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর আবার ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর জনশক্তি রফতানিকারকদের বাদ দিয়ে সরকারিভাবে দেশটিতে কর্মী পাঠাতে জিটুজি চুক্তি করা হয়। এরপর আবারও জনশক্তি রফতানিকারকদের যুক্ত করে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের মধ্যে জি টু জি প্লাস (সরকারি-বেসরকারি) সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। তবে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই মালয়েশিয়া বলে, এই মুহূর্তে তারা আর কর্মী নেবে না। এতে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া ঝুলে যায়। এরপর ২০১৬ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে। ওই বৈঠকের পর আবার কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
সর্বশেষ ২০১৮ সালে আবারও মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হলে মালয়েশিয়া সরকার এবং পরে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয় ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির পরিবর্তে নিবন্ধিত সব রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠাতে পারবে বাংলাদেশ। আর পুরানো এসপিপিএ অনলাইন প্রক্রিয়া বাতিল করে নতুন প্রক্রিয়ায় এই নিয়োগ করা হবে। এসপিপিএ সিস্টেম সচল রাখা হয় ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সেপ্টেম্বরের পর ওই সময়ের মধ্যে ৫০ হাজার ১০৮ জন কর্মী মালয়েশিয়া গিয়েছে বলে জানিয়েছে বিএমইটি।
মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ এবং নেপাল থেকে নতুন করে শ্রমিক নেওয়ার জন্য একটি অনলাইন জব পোর্টাল খোলা হচ্ছে। এই অনলাইন পোর্টাল থেকে চাকরি প্রত্যাশীরা নিজেরাই চাকরি খুঁজতে পারবেন এবং নিয়োগকর্তারাও চাকরির জন্য লোক নিয়োগ করতে পারবেন। নতুন এই প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করা ইন্ডিপিডেন্ট ফরেন ওয়ার্কার্স কমিটি ইতোমধ্যে রিপোর্ট তৈরি করেছে। এই রিপোর্ট কেবিনেট থেকে অনুমোদনের পর প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হবে বলে জানা গেছে।
এই রিপোর্টে বিদেশি শ্রমিক নিয়োগে নতুন কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় বিভিন্ন দেশের এ ধরনের লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে সে বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। কেবিনেট অনুমোদন দেওয়ার পর মালয়েশিয়ান কোম্পানি কিংবা ব্যক্তিপর্যায়ে বিদেশি শ্রমিক নিজেরাই নিয়োগ করতে পারবে। যার যেসব ক্যাটেগরির শ্রমিক প্রয়োজন তারা নিজেরাই তা বেছে নিতে পারবে পোর্টালের মাধ্যমে। এই পোর্টালের তদারকি করবে মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়। কেন্দ্রীয়ভাবে এই পোর্টালের নাম প্রাথমিকভাবে দেওয়া হচ্ছে মালয়েশিয়ান রিক্রুটিং এজেন্সি (এমআরএ)। এই পোর্টাল শুধুমাত্র বিদেশি শ্রমিকদের বিষয়ে কাজ করবে।
এছাড়া আরও জানা গেছে, মালয়েশিয়ান নিয়োগকর্তাকে ২ লাখ ৫০ হাজার রিঙ্গিত সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসেবে সরকারের কাছে জমা রাখতে হবে। যদি কোনও নিয়োগকর্তা শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিতে ব্যর্থ হয় কিংবা নির্যাতন করে অথবা অসদাচরণ করে, তাহলে এই সিকিউরিটি ডিপোজিট থেকে শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলাসেগেরান সেদেশের গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারের নতুন প্রক্রিয়া চূড়ান্তকরণের দ্বারপ্রান্তে। কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন এই প্রক্রিয়াটি চালু হবে। মধ্যসত্ত্বভোগীদের কারণে বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে সমস্যা হচ্ছে এ বিষয়ে সরকার অবগত আছে।
নতুন পোর্টালটি চালু হওয়ার পর যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী ক্যাটেগরিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ করতে পারবে। নতুন আবেদন আসার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এমআরএ’কে জবাব দিতে হবে।
মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছে হাইকমিশন। হাইকমিশনের কর্মকর্তারা আশা করছেন, খুব দ্রুতত আবারও সচল হবে মালয়েশিয়ায় নতুন শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া।
হাইকমিশনের একটি সুত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় নতুন প্রক্রিয়ার বিষয়ে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে এসেছে সেদেশের সরকার। আমরা আশাবাদী দ্রুতই সচল হবে। নতুন সরকার যেহেতু এসেছে, তারা একটি সমন্বিত পদ্ধতি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। তারা চাচ্ছে সব দেশের জন্য একই নিয়োগ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে। তারা সেই প্রক্রিয়া নির্ধারণের কাছাকাছি চলে এসেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছি।
অন্যদিকে, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সূত্রে জানা যায়, মালয়েশিয়ার সরকারের সঙ্গে দ্রুত আরেকটি জয়েন্ট টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। মালয়েশিয়ার বাজার আবারও সচল করার জন্য প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদ ইতোমধ্যে মালয়েশিয়া যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তবে তার সফর এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রৌনক জাহান বলেন, আগে যে সিস্টেমে মালয়েশিয়া লোক নিতো তারা তো সেটা বাতিল করেছে। এখন তারা নতুন একটি সিস্টেম নিয়ে কাজ করছে। তাদের সঙ্গে আমাদের কয়েকদফা বৈঠক হয়েছে। তারা তাদের ভেতরেই প্রক্রিয়াটিকে অরগানাইজ করছে বলে আমরা শুনেছি। আর এইদিক নিয়ে আমরাও প্রস্তুতি নিচ্ছি নতুন ব্যবস্থায় লোক পাঠানোর বিষয়ে। তারা দ্রুত কাজগুলো শেষ করবে বলে আমরা জেনেছি। তবে কবে নাগাদ শেষ হবে এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য তারা জানায়নি। তারা বরাবরই বলছে আমরা শিগিগিরই চালু করবো। আমরাও আমাদের তরফ থেকে ডাটাবেজ তৈরি করা থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রস্তুতি নিচ্ছি।