অমিতা সিনহা, সিলেট থেকে:
মাকে নিয়ে প্রশ্নটা করতেই চমকে উঠলেন। তারপর যেন কিছুটা থমকে গেলেন। একটু আগের হাসিমুখ আর উচ্ছলতা নিমিষেই উড়ে গিয়ে মলিন হয়ে গেল মুখটা। ছলছল ছোখে তাকিয়ে জানতে চাইলেন-মাকে নিয়ে প্রশ্ন কেন? সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলে সব রাজনীতিবিদরা প্রস্তুত থাকেন রাজনীতি, দল, এলকার উন্নয়ন আর বিরোধী দল সম্পর্কে প্রশ্নের জবাব দিতে। সাধারণত সেটাই হয়ে থাকে সবসময়। কিন্তু ব্যাতিক্রম প্রশ্ন শুনে বিষ্মিত এবং আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন বদর উদ্দীন আহমদ কামরান। তিনি বাংলাদেশের সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র ও প্রবীন রাজনীতিবিদ।
নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললেন-মা নেই এ কথা এখনও বিশ্বাস করতে পারি না। সব সময় মনে হয় মা আমার চারপাশে ছায়ার মতোই আছেন। আগে কোথাও যাবার সময় মাকে সালাম করে যেতাম। এখন খুব কষ্ট হয় কোথাও যেতে গেলে মায়ের মুখ দেখে যেতে পারি না।
বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের জন্ম ১৯৫৩ সালে সিলেটের মাছিমপুরে। মা মরহুম বেগম নুরুন্নেছা লালন ও বাবা মরহুম বশির উদ্দিন আহমদ। চার ভাই পাঁচ বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। শিক্ষা জীবন শুরু সিলেটের দূর্গাকুমার পাঠশালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর সিলেট সরকারি পাইলট হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক, সিলেট সরকারী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং সিলেট মদন মোহন কলেজ থেকে ¯œাতক পাশ করেন তিনি।
মা-বাবার ভালোবাসায় যেমন মধ্যমনি ছিলো ঠিক তেমনি শান্ত স্বভাবের মানুষ কামরান। শৈশব থেকে খেলাধুলার প্রতি মনোনিবেশ ছিলো তার। দূর্বলতা ফুটবল ও ক্রিকেটের প্রতি। ছোটবেলা থেকেই মানুষের জন্য কিছু করার আগ্রহ ছিল। তাই স্কুল জীবন থেকেই সেবা মূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
সিলেটের রাজনীতির মহীরূহ হিসেবে পরিচিত কামরান রাজনীতিতে নাম লেখান ১৯৬৮ সালে। যুক্ত হন আওয়ামী লীগের সাথে। ১৯৭৩ সালে ওয়ার্ড কমিশনার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নির্বাচনি মাঠে পা রাখেন পরবর্তীতে সিলেটের এই উন্নয়নের কারিগর।
২০০৩ সালে বাংলাদেশের সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রথম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায় সরকারের অধীনে ২য় বার নির্বাচিত হয়েছিলেন কারাবন্দী অবস্থায়। বর্তমানে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি।
মায়ের সাথে কামরান-(ছবি পারিবারিক এ্যালবাম থেকে সংগৃহিত)
কামরানের মা মরহুম বেগম নুরুন্নেছা লালনের বাপের বাড়ি ছিলো সিলেটের কাজিটুলায়। প্রাইমারী স্কুলে পড়া অবস্থায় খুব অল্পবয়সে বিয়ে হয় তার। কামরানের বাবা বশির উদ্দিন আহমেদ ছিলেন একজন সরকারী কর্মকতা। একান্নবর্তী সংসারকে সামাল দেয়ার দায়িত্ব পড়ে কামরানের মায়ের উপরই। নয় সন্তানের জননী ছিলেন মরহুম নুরু নেছা লালন। সংসার সামলে স্বামী সন্তানদের যতœ নিতেন তিনি।
মায়ের সম্পর্কে কামরান জানান, কখনো কোন দিন বেশি রাগ করতেন না। যদিও তিনি অভিমান করতেন মাঝে মধ্যে। কিন্তু সেই অভিমানটুকুও করার সুযোগ দিতো না তাারই বড় ছেলে। মায়ের মান ভাঙাতে বেশ পারদর্শি ছিলেন কামরানের সাথে মায়ের সম্পর্ক ছিলো খুবই মধুর। প্রথম সন্তান হবার কারণে শৈশব থেকে মায়ের আদর, ¯েœহ, ভালোবাসা একটু বেশিই পেয়েছেন। বড় হবার পর সেটা অব্যাহত ছিল রাজনৈতিক জীবনেও।
দি নিউ ইয়র্ক মেইল এর সাথে আলাপচারিতায় কামরান জানান, ওয়ান ইলেভেনের সময় গ্রেফতার হয়ে আমি জেলে ছিলাম। ২০০৮ সালে জেলে থাকা অবস্থায় দ্বিতীয়বার সিলেটের মেয়র নির্বাচিত হই। নির্বাচনের ৭দিন পর কুমিল্লা কারাগার কর্তৃপক্ষ জানালো-অমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমার মা যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে, ওই হাসপাতালে আমার চিকিৎসা নেওয়া হবে। সেদিন আমি রোজা ছিলাম। শবেবরাতের ঠিক পরের দিন। আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পুলিশের কাছে ফোন আসে আমাকে যেন সিলেটে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা বলল, সিলেটে কেন নিয়ে যাওয়া হবে, ওকে তো ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে আমাদের নির্দেশ দেওয়া আছে। তখন আমাকে বহনকারী গাড়িটি ঢাকা-চট্টগ্রামের রোডে চলন্ত অবস্থায় ছিল ঢাকার উদ্দেশ্যে। তখন পুলিশের সাথে অনেক বাকবিত-া হচ্ছে মুঠোফোনে। কার সাথে কথা হচ্ছে সেটা বুঝে উঠতে পারছিলামনা। এক পর্যায়ে তারা বলল যে আপনাকে সিলেটে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন আমি বললাম, কেন আমায় ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে না। আমি তো সিলেট যাব না। আমার আম্মা যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে সেই হাসপাতালে আমাকে চিকিৎসা নেওয়া হবে। ওই সময় আমার মনের মধ্যে অজানা আতঙ্ক সৃষ্টি হল। তখন আমি বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ি। কি ব্যাপার ? বিষয় কি ? এক দিকে আমার আম্মা অসুস্থ্য হয়ে ঢাকায়, অন্য দিকে আমায় সিলেট নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। তখন আমি ওদের এক কর্মকর্তাকে বলি, আমার আম্মা অসুস্থ্য। একটিবার ফোনে কথা বলতে চাই। দয়া করে একটু ফোন দেন। লোকটি তখন ফোন দিতে চাইলো না। পাশে থাকা কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বলল, দিয়ে দেন ফোনটা। তখন তিনি ফোনটা দিলো। ওই সময় আমার কাছে কোন ফোন নম্বর ছিলো না। শুধু মাত্র স্ত্রীর ফোন নম্বরটি মুখস্ত ছিলো। তারপর মুঠোফোনটি নিয়ে ১ম বার ফোন দিলাম স্ত্রীর কাছে। তখন ফোনটি ধরেনি। পরেরবার ফোন দিলে রিসিভ করে আমার স্ত্রী। তখন আমি তাকে বলি, আম্মা কোথায়? তখন সে কোন উত্তর দেয়নি। আমি তখন বলি, তাড়াতাড়ি বলো। ওরা ফোনটা নিয়ে যাবে। আম্মার কি হয়েছে। আমার স্ত্রী ওই প্রান্তরের মুঠোফোনে আমায় বলল ‘মা’ নেই । তখন আমি বলি, নেই মানে কি ? তখন ও কান্নাকাটি শুরু করল। তখনই আমি নিশ্চিত হই ‘মা’ চিরবিদায় নিয়েছেন।
কারান্তরীণ অবস্থায় মা হারানোর সেই মুহুর্তের কথাগুলো বলার সময় থর থর করে কাঁপছিলেন কামরান। দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। ঠোঁট দুটো কেঁপে কেঁপে উঠছিল বারবার। বলতে চাওয়া কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আবারো বলতে শুরু করলেন-তিনি বলেন, মায়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় পাশের নুরজাহান হোটেলে উঠলাম। সেখান থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসতেই এক পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে ফোন দেয় ভাইয়ের সাথে কথা বলার জন্য। আমি বাথরুমে গিয়ে ভাইয়ের সাথে কথা বলি। তারপর আমাকে সিলেটে নিয়ে আসা হয়। সারা রাত আমি ছটফট করে কাটালাম কারাগারের মধ্যে। তারপর সকাল ১০ টার পর ৫/৬ ঘন্টার জন্য বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। শেষবারের মতো মায়ের মুখটা দেখলাম। জানাজা শেষে মায়ের লাশ দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর আমাকে আবার কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
কান্নাজড়িত কন্ঠে কামরান বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় আমাকে যখন গ্রেফতার করা হয় তখন আমি মাকে বলি মা আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমায় যেতে হবে। মা বললেন, আল্লাহ হুকুমে আমি তোমাকে ছেড়ে দিলাম। আমি জানি, এটা হয় রাজনীতি জীবনে। সিলেট থেকে আমাকে কুমিল্লার কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। মাকে সেখানে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করি। তবুও মা ওই সময় আমাকে দেখতে কুমিল্লায় যান। এরপর থেকে আমার বৃদ্ধা মা অসুস্থ্য হয়ে পড়েন।
মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রবীন এই রাজনীতিবিদ বলেন, আমি অসুস্থ্য হলে-মা সারাটা সময় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে সেবা যতœ করতেন। কখন বাবা আর কখন নাম ধরে ডাকতেন। মায়ের অসুখ হলে শত ব্যস্ততার মধ্যে আমিও মায়ের পাশে থাকতাম। কিন্তু জেলে থাকার কারণে তখন আর অসুস্থ্য মায়ের পাশে থাকতে পারিনি। সে সময় মাকে ঢাকায় নিয়ে শেষ বারের মতো চিকিৎসা করা হয়েছিল।
কামরান বলেন, নির্বাচনের সময় আমার মা সব জায়গায় ঘুরতেন, ভোটারদের কাছে আমার জন্য ভোট চাইতেন, দোয়া চাইতেন। আমাকে বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। ২০০৩ সালে প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হবার পর মাকে সঙ্গে নিয়েই শপথ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হবার পর আর মাকে নিয়ে শপথ গ্রহণ অনুষ্টানে যেতে পারিনি। তার আগেই মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। অথচ ২০০৮ সালের মেয়র নির্বাচনের সময় গণসংযোগ আর প্রচার-প্রচারণায় মাঠে ময়দানে নেমেছিলেন আমার মা। কারাবন্দী ছেলেকে মুক্ত করেছেন নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করে। কিন্তু ছেলের মুখে বিজয়ের হাসি দেখে যেতে পারলেন না। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। অস্পষ্টভাবে শুধু বললেন-”মা নেই একথা এখনও বিশ্বাস করতে পারি না”।