॥ রিয়াজুল হক ॥
এক. আমি খাওয়া দাওয়ার প্রতি সবসময় একটু খেয়ালি। মনের মত খাবার না হলে খেতে পারি না। ছোট থাকতে চিংড়ি মাছটা খেতে খুব পছন্দ করতাম। হলুদ, পিঁয়াজ দিয়ে জ্বালানো চিংড়ি মাছ। সেই সময় বাসায় ফ্রীজ ছিল না। প্রতিদিন বাসায় বাজার করা হত। আব্বা বেশি ব্যস্ত থাকায় কাকু বাজার করত। সকাল বেলা বাসায় প্রতিদিনের মেন্যু ছিল ভাত, আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি। আমার ডিম ভাজি খেতে ভালো লাগত না। এই জন্য সকালে ভাত খেতে একটু দেরি করতাম। কখন কাকু বাজার থেকে আসবে? কারণ প্রতিদিন চিংড়ি মাছ কেনা হত। বাজার আসার সাথে সাথে মা বাজারের ব্যাগ থেকে কিছু চিংড়ি মাছ বেছে নিয়ে তেল, পিঁয়াজ,হলুদ দিয়ে আমার জন্য জ্বালিয়ে দিত। আমি যদি কিছু ভাত বেশি খেতে পারি, তাতেই যেন তাঁর শান্তি। সেই অবস্থা এখনো চলছে। বাঁচো আর মরো, আমাকে খেতে হবে। আমি এখনো অবুঝ আমার মায়ের কাছে।
প্রতিটা সন্তান মায়ের কাছে আরাধ্য। প্রথম সন্তান হয়তো আরো বেশি প্রিয় হয়ে থাকে। কোন মা হয়ত মুখে স্বীকার করবে না। আমরা তিন ভাইয়ের ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার বড়। মেজো ভাই (আমার চেয়ে বছর তিনেক ছোট) একবার মা’কে জিঙ্গাস করেছিল, ‘মা তুমি ভাইয়াকে বেশি ভালবাসো,তাই না’? মা আমাকে পরে এই কথাটা বলেছিল। মা কথাটি শুনে হেঁসে উড়িয়ে দিয়েছিল। আমি জানি, আমার মেজো ভাই এই লেখাটা পড়বে আর একটু আধটু লজ্জাও পাবে। কারণ সবার সামনে বলে ফেললাম। তবে মা আমাদের তিন ভাইয়ের প্রতিই অত্যন্ত যত্নবান। সহায় সম্পদ বলতে যেন আমরা তিন ভাই সব কিছু। এখনো আমার ছোট ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরতে দেরি হলে, তিনিও না খেয়ে বসে থাকেন। এক অদৃশ্য ভালোবাসা বহন করে চলেছেন। মনে হয় যেন কিছুই না। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য না মা কাছে না থাকলে, অন্য সবকিছুই যেন ম্লান মনে হয়।
দুই. আমার মায়ের ধ্যান জ্ঞান হচ্ছে তাঁর তিন সন্তান। কিভাবে আমাদের মানুষ করতে হবে সেটা ঠিকই বুঝত। এখনো মনে পড়ে, আমার মা বইয়ের প্রশ্ন জিঙ্গাসা করে, বইয়ের সাথে মিলিয়ে নিত। আমি যদি সেই বইয়ের উত্তরের সাথে মিলিয়ে পড়া বলতে না পারতাম, তবে বিকালে মাঠে যাওয়ার অনুমতি মিলত না।
যখন মাঠে খেলতে যেতাম, বেলা একটা/দেড়টা কিংবা সন্ধ্যা হয়ে গেলে মাঠের কোনায় মা চলে যেত। বন্ধুরা বলতো, কাকি আসছে, চলে যা। তখন মায়ের উপর একটু আধটু রাগ হত। আরেকটু পর আসলে কি হত? আরেকটু বেশি খেলতে পারতাম। আমরা দুই ভাই অনেক সময় বলতাম, তুমি যাও আমরা আসতেছি। মা দাঁড়িয়ে থাকত। বকাবকি করত না। আর আমরা মাকে বয়ও পেতাম না। কোন সন্তানই মনে হয় তাদের মাকে বয় পায় না। এখানে ভয় মনে হয় শোভনীয় না। যাই হোক, আমাদের মা ও চাইতো আমরা আরেকটু খেলি। কিন্তু আব্বা এসে আমাদের না দেখলে হয়ত রাগারাগি করবে। এইজন্যই সাথে নিয়ে যেতে চাইত। আমরা দুই ভাই তখন মায়ের পিছু পিছু বাসায় চলে যেতাম।
স্কুলে পড়াকালীন সময়ে, সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ২টা, সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ৯টা মোটামুটি বিদ্যৎ থাকত না। আইপিএস এর কথা সেই সময় চিন্তা করার সুযোগ ছিল না। চার্জারের ফ্যানও তখন বাজারে আসে নি। যাই হোক, সন্ধ্যার পর কারেন্ট চলে গেলে ঘরের বাইরে গেলে মা তেমন একটা কিছু বলতো না। তবে যদি পড়তে থাকতাম, তবে পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতো। যত সময় পড়তাম, মায়ের হাতপাখা থামতো না। কখনো মাথায় আসে নি,মায়ের কি হাত ব্যথা হয়না?
আবার রাতে ঘুমের মধ্যেও বিদ্যুত চলে যেত। তবে সে সময় টের পেতাম না। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ হাতপাখা গায়ের সাথে লেগে যেত। তখন বুঝতে পারতাম, মা বাতাস দিচ্ছে। কিন্তু তিনি না ঘুমিয়ে যে বাতাস দিচ্ছে, তাঁর তো কষ্ট হচ্ছে, তখনো মাথায় আসতো না।
এখনো সপ্তাহের পাঁচ দিন অফিসে ব্যস্ততার মাঝে সময় কাটানোর পর শুক্রবার এবং শনিবার ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে বসতে বসতে বেলা ১১ কিংবা সাড়ে ১১টা বেজে যায়। মা’কে প্রথমেই জিজ্ঞেস করি, নাস্তা করছো?
-তুই তাড়াতাড়ি কর। বেলা অনেক হয়েছে। এত বেলা পর্যন্ত না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে।
আমার প্রশ্নের উত্তর আর পাই না। যদি বলি একটু সকাল সকাল ডেকে দিলে তো পারো?
- সারা সপ্তাহ যে পরিমাণ কষ্ট করিস এই দুটো দিন একটু না ঘুমালে চলবে কেন? মা’কে যদি বলি আমার সাথে খেতে বসো।
-খেতে খেতে এত কথা বলিস কেন? তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে ওঠ। খাবার সব ঠান্ডা হয়ে গেছে।
যাই হোক আমি নাস্তার টেবিল থেকে উঠে গেলে আমার মা খেতে বসে।
তিন. আমার এসএসসি, এইচএসসি, এমনকি বিবিএ, এমবিএ’র পরীক্ষার সময়ও মা রোজা রাখতেন। আল্লাহর কাছে চাওয়াগুলো হয়ত আল্লাহ পূরণ করে চলেছে। আমরা দুই ভাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছি। ছোট ভাইটা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ করছে। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা তিনটা ভাই বাবা-মায়ের সাথে ভালো আছি। এখন একটা প্রশ্ন অনেকের কাছ থেকে শুনতে হয়, আমার সাথে বাবা-মা থাকে কিনা? কি বোকার মত প্রশ্ন। আমার সাথে বাবা-মা কেন থাকবে? আমিই তো আমার বাবা-মায়ের সাথে থাকি। এখনো বাড়ির সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বাবা-মা।
চার. কয়েকদিন আগের ঘটনা। মায়ের শরীরে রক্ত স্বল্পতার কারণে হেমোফার আয়রন ইনজেকশন দিতে গেলাম। বেলা ১২ টা বাজে। আমার এক কাজিনের চেম্বারে যেয়ে দিতে হবে। আমি মায়ের সাথে ছিলাম। মায়ের হাতের শিরায় ইনজেকশন দেওয়া হলো। প্রতি মিনিটে ১২ ফোটা। বুঝলাম তিন ঘন্টার বেশি সময় লাগবে। ৩০ মিনিট পার হবার মা বুঝতে পারলো, কৃত্রিমভাবে রক্ত বৃদ্ধির এই আয়রন ইনজেকশন শেষ হতে বেশ সময় লাগবে।
মা বললো, তুই অফিসে চলে যা।
-আমি অফিসে জানিয়ে এসেছি। থাকলে সমস্যা নেই।
আমার শেষ হলে আমি চলে যেতে পারবো। তুই যা। একা একা বসে থেকে কি করবি? (আসলে রুমের মধ্যে ফ্যান চালালে মা’র খুব ঠান্ডা লাগছিল। আমি বসে থাকলে গরমে আমার খুব কষ্ট হবে। আমাকে চলে যেতে বলার এটাও একটা কারণ ছিল)।
-আমি তো তোমার সাথে আছি। একা কোথায়?
তুই যা অফিসে। আমি একটু ঘুমাই।
-তুমি ঘুমাও। আমি পাশে বসে মোবাইলে গেমস খেলতেছি।
তিন ঘন্টা ধরে মায়ের হাতে হেমোফার আয়রন ইনজেকশন ছিল। আমি থাকলাম। মা’কে বাসায় রেখে আমি অফিসে চলে আসলাম। ফেরার সময় মনে মনে ভাবছিলাম, আমি অসুস্থ হলে মা’কে যতই বলি, সে কি হাসপাতালে আমাকে রেখে বাসায় আসতে পারতো? কখনোই না। মা বলে কথা। আর আমি যদি তাকে যেতে বলতাম, নিশ্চিত গালাগাল শুনতে হত।
পাঁচ. বছরে তিন চারবার আমার জ্বর হয়ে থাকে। এখনো জ্বর হলে, মায়ের মুখের দিক তাকালে মনে হয় সে যেন আরো অসুস্থ। মায়েরা যে কেন এমন হয়, বুঝতে পারাটাই মুশকিল। আমার যদি উঠতে কষ্ট হয়, তাহলে বালিশের নীচে রেক্সিন দিয়ে মাথায় পানি ঢালবে। ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দেবে। কি খেতে পারবো, সেই চিন্তাই যেন সবসময় তাঁর মাথায় ভর করে থাকে।
যাদের ঘরে মা আছে, তারা মায়ের হাত দুটো একদিন ধরে দেখবেন। কতটা অযত্নে বছরের পর বছর কেটে গেছে, মা হয়তো নিজেও জানে না। বিয়ের আগে যে মানুষ প্রতিদিন চুলে শ্যাম্পু করত, সে এখন বিশেষ কোন দিন ছাড়া শ্যাম্পু করে সময় নষ্ট করার কথা ভাবতেই পারে না। সবই তো আমাদের জন্য। ভালো করে একদিন তাঁর মুখের দিকে তাকান। দেখবেন ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অনেক আকুতি লুকিয়ে আছে। শুধু বলতে পারে না। যাদের বাবা-মা বেঁচে নেই, দোয়া করুন তাদের জন্য। পিতা-মাতার জন্য সন্তানের দোয়া আল্লাহর কাছে কবুল হয়।
ছয়. কয়েকদিন আগে, রাত ১১ টার দিকে রিক্সায় করে বাসায় আসতেছি। হঠাৎ অল্পবয়সী রিক্সাওয়ালা ছেলেটার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ওই পাশ থেকে কে ফোন করেছিলো, কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম। তবে ছেলেটার কথা ছিল ঠিক এই রকম, “ আমার আব্বা আমার দাদা-দাদিরে খাওয়াইছে,পরাইছে। আমিও আমার আব্বারে-মায়েরে খাওয়াবো। আমার মা আমার দাদা-দাদিরে নিয়া থাকছে। আপনার মাইয়ারও শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়া থাকতে হকে। আপনার মাইয়া মানতে পারলে সংসার করুক, না পারলে না করুক”। কথাটা বলে ফোনটা পকেটে রেখে দিলো। যেন কিছুই হয়নি। রিক্সা চলছে।মনে মনে ভাবলাম, একটা বাঘের বাচ্চা। বিরাট বিরাট শিক্ষিত হয়ে কয়জন ছেলে এইভাবে বলতে পারে? ধন্য ওই রিক্সাওয়ালার বাবা-মা। সন্তান মানুষ হওয়া বলতে হয়তো এটাই বুঝায়। প্রতিটা সন্তানের এমন ভাবেই মানুষ হওয়া উচিত। শুধুই মা করবে,সন্তান কিছু করবে না, সেটা হওয়া উচিত না। এর পরিণতি আরো বেশি ভয়ানক।
আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি যখন আমার আব্বা বলেন, " আমার রিয়াজ আছে। চিন্তা করার কিছু নাই"। আমার ছোট ভাই যখন বন্ধুদের বলে, " ভাইয়া'কে বলব। সমাধান হয়ে যাবে"। তবে মা আমাকে নিয়ে তেমন কিছু বলে না। অফিসে কিংবা ঘরের বাইরে থাকলে তার দুইটা প্রশ্ন “ খেয়েছি কিনা? কিংবা ঘরে আসবি কখন?” মায়ের কাছে সন্তান কখনো বড় হয় না, স্বাবলম্বী হয় না। এভাবেই থাকাই তো ভালো। মায়ের কাছে বড় হবার দরকার কি?
লেখক: উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
[প্রিয় পাঠক, নিউইয়র্ক মেইল যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত সর্বাধিক জনপ্রিয় বাংলা অনলাইন। এই অনলাইনের” আমার চোখে আমার মা” বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। মা'কে নিয়ে আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। আপনি এবং মায়ের ছবিসহ মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। লেখা প্রকাশ ছাড়াও আমাদের রয়েছে বিশেষ পাবলিকেশন-এর পরিকল্পনা।]
এছাড়া প্রবাসে আপনার কমিউনিটির নানান খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।