logo
আপডেট : 17 June, 2019 08:26
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন নিয়ে আত্মসমালোচনা

প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন নিয়ে আত্মসমালোচনা

কাজী আফিফুজ্জামান(কাজী সোহাগ): শুরুতে বলে রাখি আত্মসমালোচনা করাটা কিন্তু কঠিন। কারন আয়নার সামনে নিজের চেহারাটা দেখা যায় স্পষ্ট। তারপরও কঠিন কাজটি করার ইচ্ছা হলো। বয়স ও অভিজ্ঞতা দুই দিক দিয়েই আমি বেশ পিছিয়ে আছি। তাই হয়তো অনেক রেফারেন্স দিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারবো না। তবে একান্ত নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা হয়তো বলতে পারবো।

গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন কাভার করার সুযোগ হচ্ছে। অফিসের এসাইনমেন্ট থাকায় কাজটি করতে হচ্ছে। টেলিভিশনে লাইভ দেখানোর কারনে বলা যায় সবাই বেশ ভালোভাবেই প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন নিয়ে ওয়াকিবহাল। কিন্তু লাইভের বাইরেও থাকে নানা ঘটনা। নানা মূহুর্ত। প্রেস কনফারেন্স কক্ষে থাকে অন্যরকম এক আবহ। প্রশ্নোত্তর পর্বে সাংবাদিকেদের দুটি গ্রুপ থাকেন। একটি গ্রুপ সিনিয়র ও সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার নীতি নির্ধারক হিসেবে বিবেচিত হন। আরেকটি গ্রুপ মাঠ পর্যায়ে কাজ করা। বলে রাখা ভালো প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন কাভার করা বেশিরবাগ সাংবাদিক কিন্তু নিজে নিউজ লেখেন না। মাঠ পর্যায়ে যেসব সাংবাদিক কাভার করতে যান তারাই কিন্তু নিউজ লেখেন। দূর্ভাগ্য তাদের প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে অনেক কম। কারন তাদের অফিসের বস’রা আগে থেকেই সামনের সারির চেয়ারগুলো অলংকৃত করে রাখেন। তাই অনেক সহকর্মীকে দেখেছি বস আছে বলে প্রশ্ন করতে উঠতে চান না। মজার বিষয়,মাঠ পর্যায়ে কাজ করা ওইসব সাংবাদিকের অনেককে দেখেছি সংবাদ সম্মেলনের অন্তত দুই আড়াই ঘন্টা আগে সম্মেলনস্থলে উপস্থিত হতে। তাদের কাছে জানতে পেরেছি অফিসের বস সম্মেলনে আসবেন তাই আগে থেকেই তাকে আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সামনের সারির আসনে যেনো তিনি বসতে পারেন সেই ব্যবস্থা করতেই বেচারা কলিগের আগে ভাগে আসা। মূলত প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের চেহারা দর্শন করানো থাকে তাদের মূল লক্ষ্য। সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের যারা কাজ করেন তারা নিরলসভাবে চেষ্টা করেন অনুষ্ঠানটি সফলভাবে শেষ করার। তাদেরকেও বিষয়টি নিয়ে মাঝে-মধ্যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তাদের কয়েক জন জানিয়েছেন,প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের তারিখ ও সময় নির্ধারণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সিনিয়র টেলিফোনে তাদের কাছে ধর্না দেন প্রশ্ন করার জন্য। এটাকে তারা রসিকতা করে ‘হ্যান্ডমাইক বুকিং’বলে অভিহিতি করেন। অর্থাৎ প্রশ্নত্তর পর্বের সময় তাকে যেনো মাইক দেয়া হয় সে বিষয়টি তারা আগেভাগেই নিশ্চিত করে রাখতে চান। এর বাইরেও রয়েছে আরও নানা ঘটনা। তবে এসব ঘটনার কোনটিই কিন্তু জানেন না আমাদের প্রধানমন্ত্রী। কে প্রশ্ন করবে আর কে করতে পারবে না এ নিয়ে তার পক্ষ থেকে কিন্তু কোন ধরণের নির্দেশনা থাকে না। তিনি সবাইকে সব ধরণের প্রশ্নকে উৎসাহিত করেন। এখন আসা যাক আসলে কেন প্রশ্ন করতে উদগ্রীব থাকেন সিনিয়র বা বস’রা। এ নিয়ে সিনিয়র সাংবাদিক আমীন আল রশীদ একটি বিশ্লেষণধর্মী লেখা লিখেছিলেন। তার লেখা থেকে কিছুটা ধার করে আমার এ লেখায় সন্নিবেশিত করার প্রয়োজন বোধ করছি। কারণ তার ওই লেখার সঙ্গে আমি সম্পুর্ন একমত। তিনি লিখেছেন-প্রধানমন্ত্রীর এই সংবাদ সম্মেলনে দুয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশই যেসব প্রশ্ন করেন, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে সমালোচনা হয়। সিনিয়র সাংবাদিকদের ‘তেলবাজির’ তীর্যক মন্তব্য করেন জুনিয়ররাও। ফলে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে তার সফর কিংবা সাম্প্রতিক বিষয় ছাপিয়ে অনেক সময় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এই প্রশ্ন এবং প্রশ্নের ধরন। ২০১৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের দিন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়–য়া ফেসবুকে গণমাধ্যমের ইংরেজি গধংং গবফরধ শব্দকে উপহাস করে লিখেছেন : মাছ মিডিয়া। তিনি যে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে কিছু সাংবাদিকের তোষামেদির প্রেক্ষিতেই এটি লিখেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন ফেসবুকে লিখেছেন: সব সময় সবকিছুর একই নাম থাকতে হবে কেন, যখন অর্থ বদলে যায়? যেমন, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সে ‘প্রশ্নোত্তর পর্ব’।

২ সেপ্টেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে একজন টেলিভিশন সাংবাদিকের প্রশ্নের ধরন ও বাক্য নিয়ে পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা শুরু হলে এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক নঈম নিজামও ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে ২০১০ সালের পর থেকে এক নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে। এই সংস্কৃতি আগে ছিল না। ২০১৪ সালের পর এই সংস্কৃতির আরও ডালপালা বেড়েছে। অনুজদের কোনো দোষ নেই। এই সংস্কৃতি প্রবীণরা শিখিয়েছে নবীনদের।’ এ বিষয়ে তিনি একটি অনুরোধও করেন, ‘অনুজদের প্রতি অনুরোধ, আমাদের কিছু মানুষ অকারণে সংবাদ সম্মেলনে বেশি কথা বলেছেন, বলছেন। কিন্তু তা অনুকরণের দরকার নেই। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন কর সবাই। জানতে চাও। প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করতে হলে, লেখো, টকশোতে কথা বল। তা না পারলে মানুষের সামনে হেঁটে হেঁটে বল। ফেসবুকে লেখো। অনলাইনে লেখো। লাইভ সংবাদ সম্মেলনে অতি চাটুকারী করে প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত ও একটি পেশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার দরকার নেই। আর সিনিয়রদের বলছি, অনেক তো হলো প্লিজ নির্লজ্জের মতো নবীনদের এমন কিছু শেখাবেন না। যা বিব্রত করে সবাইকে। আমীন আল রশীদ লিখেছেন-প্রশ্ন হলো কেন প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে সাংবাদিকদের কেউ কেউ নিজেদের পেশাদারিত্ব বিসর্জন দিয়ে এরকম তোষামোদি করেন? শুধু তাই নয়, কখনো কখনো সাংবাদিকের প্রশ্ন এবং প্রধানমন্ত্রীর উত্তর শুনে সেখানে হাততালি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা হাততালি দেন এরকম অদ্ভুত ঘটনা অন্য কোনো দেশে ঘটে কি না সন্দেহ। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও যে এই তোষামোদি খুব পছন্দ করেন,তা নয়। বরং তিনি একবার এক সিনিয়র সাংবাদিকের প্রশ্ন করার নামে লম্বা বক্তৃতা শুনে উল্টো ওই সাংবাদিককে প্রশ্ন করেছিলেন,আপনি প্রশ্ন করছেন নাকি বক্তৃতা দিচ্ছেন? তখন ওই সাংবাদিক বলেছিলেন, ‘আমার কোনো প্রশ্ন নেই’।

তাহলে কেন তারা সংবাদ সম্মেলনে যান? এর কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। ১. পেশাদারিত্বের সংকট: হাতেগোনা দুয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে এ মুহূর্তে দেশের কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানেই যে পেশাদারিত্বের চর্চা হয় না, সে বিষয়ে বোধ করি কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। কোনোদিন সাংবাদিকতা করেননি এমন লোকও পত্রিকার সম্পাদক, টেলিভিশনের বার্তা প্রধানের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে যাচ্ছেন। এতে সাংবাদিককার ডিগনিটি ক্ষুন্ন হয়। এবং এই লোকগুলো মূলত প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে যান নিজের চেহারাটা দেখানোর জন্য। তিনি কোনো প্রশ্ন করেন না বা প্রশ্ন করার ক্ষমতাও তার নেই। বরং তিনি যে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে গেলেন বা যেতে পারলেন, সেটিই তার অস্ত্র। ২. বিশেষ সুবিধা আদায়: অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে ( যেকোনো আমলেই) যারা যান, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই সুবিধাবাদ ও ধান্দাবাজ গোষ্ঠী। যারা পেশাদার সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার পথও বন্ধ করে দেন বা কঠিন করে দেন। যখন কোনো সিনিয়র সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর তোষামোদি করতে থাকেন তখন অপেক্ষাকৃত তরুণরা সমসাময়িক ইস্যুতে কোনো কঠিন প্রশ্ন করতে সংকোচবোধ করেন। অবশ্য আজকাল তরুণদেরও অনেকে তোষামোদি করেন। ৩. সরকারের সুনজরে থাকা: আমাদের গণমাধ্যমে পেশাদারিত্বের সংকট, কালোটাকার দৌরাত্ম্য, অসৎ লোকের দাপট ইত্যাদি কারণে সরকারগুলো সব সময়ই সাংবাদিকদের একধরনের চাপের মধ্যে রাখে বা রাখতে পারে। কারণ অধিকাংশ গণমাধ্যম মালিকেরই প্রচুর অবৈধ আয়ের উৎস আছে এবং সেগুলো সরকারের জানা। সুতরাং কালো টাকার মালিকদের গণমাধ্যমের পক্ষে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ থেকে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করাও কঠিন। ফলে মালিকরা সব সময়ই সরকারের সুনজরে থাকতে চান। অর্থাৎ এই সুনজের থাকতে চাওয়ার মূল কারণ ভয়। ৪. দলীয় আনুগত্য: বাংলাদেশের সাংবাদিকতা বহু বছর ধরেই আওয়ামী ও বিএনপিপন্থি এ দুই ভাগে বিভক্ত। জাতীয় প্রেসক্লাব, বিএফইউজে, ডিইউজের মতো সংগঠনের নির্বাচন হয় দলীয় ব্যানারে। কে কোন দলের অননুগত বা সমর্থিত প্রার্থী, তা নিয়ে কোনো লুকোছাপা থাকে না। শুধু নির্বাচন নয়, এসব সংগঠনের সদস্য নিয়োগও হয় দলীয় বিবেচনায়। ফলে সাংবাদিকতার নিরপেক্ষ এবং বস্তুনিষ্ঠ চরিত্র হারিয়ে গেছে। প্রতিবেশী ভারতে কংগ্রেসপন্থি বা বিজেপিপন্থি, যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেটপন্থি বা রিপাবলিকপন্থি সাংবাদিক সংগঠন নেই এবং এটা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে শুধু বিএনপি-আওয়ামীপন্থি সংগঠনই নয়, সিনিয়র সাংবাদিকদের একটা বড় অংশকেই সাধারণ মানুষ দলীয় কর্মী মনে করে। সুতরাং দলীয় কর্মীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে কোনো সাহসী এবং প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা সম্ভব নয়।