কলকাতা প্রতিনিধি: বাঙালির বাধভাঙা আবেগের কাছে হার মানে যেন সবকিছু! সেখানে অর্থ নগন্যই বটে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অনেক স্মৃতির সাক্ষী কলকাতা প্রেসক্লাব সেই আবেগেরই নজির দেখলো যেন আরেকবার। কোনো তহবিল নয় বা কোনো সরকারি অনুদান নয়, এই প্রেসক্লাবের উন্নয়নের স্বার্থে একেবারে নিজের কষ্টার্জিত উপার্জন, তথা ব্যক্তিগত খাত থেকে পুরো এক লাখ রুপি তুলে দিলেন কলকাতায় বাংলাদেশ উপদূতাবাসের প্রথম সচিব (প্রেস শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত) ড. মোফাকখারুল ইকবাল। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত প্রেসক্লাবের প্রতি ভালোবাসার স্মারক হিসেবে তার এ অনুদান পেয়ে বিস্মিত যেন কলকাতা প্রেসক্লাবের সভাপতিসহ সদস্যরা।
পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী শহরের প্রেসক্লাবের উন্নয়ন কাজের জন্য স্বেচ্ছায় অনুদান দিয়ে ক্লাবের ইতিহাসে নাম লিখে ফেললেন ড. মোফাকখারুল ইকবাল। সম্ভবত কোনো বাংলাদেশি হিসেবেও তিনি প্রথম এমন ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনুদান দিলেন। এই অনুদানের কারণ হিসেবে প্রেসক্লাবের প্রতি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক কৃতজ্ঞতাবোধের কথাই বললেন ড. ইকবাল।
তিনি বলেন, ‘প্রেসক্লাব মুক্তিযুদ্ধের একাধিক স্মৃতি বহন করে চলেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নেতাদের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়, সবাইকে নিরাপদ জায়গায় যেতে হবে। বাংলাদেশের নেতাদের এবং বিপদগ্রস্ত জনগণের পূর্ণ নিরাপদে থাকার জায়গা হিসেবে সর্বাগ্রেই যে নামটি আসে, সেটি হলো কলকাতা। ব্রিটিশ শাসনের কেন্দ্রবিন্দু কলকাতা এমন শহর, যেখানে থেকে অনায়াসে বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করা সহজ।’
‘পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা মিটিং-পরিকল্পনা এই প্রেসক্লাব থেকেই হয়েছে। এমনকি তৎকালে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক যারা সংবাদ সংগ্রহের জন্য বারবার বাংলাদেশে ঢুকছিলেন, তারা কিন্তু এই প্রেসক্লাবেই থাকতেন। প্রথম মুজিবনগর সরকারের শপথের জন্য এই প্রেসক্লাব থেকেই ২৫টি গাড়ি ছেড়েছিল। এমন নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ক্লাবে।’
ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন কলকাতার এ প্রেসক্লাব। ১৯৪৫ সালের ২২ জুলাই উত্তর কলকাতার কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের দোতলার একটি ছোট্ট ঘরে কয়েকজন সাংবাদিকের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ক্লাবটি। এরপর ১৯৫৭ সালের ১৬ জানুয়ারি স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কলকাতার রিপোর্টাদের এক বার্ষিক সভায় আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আসেন। সব রিপোর্টারের সুবিধার জন্য শহরের কেন্দ্রস্থলে প্রেসক্লাবের জন্য জমি দেওয়ার ব্যাপারে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন তখন।
সেই প্রতিশ্রুতি মতো কলকাতার সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ময়দান অর্থাৎ গড়ের মাঠের একাংশে গড়ে ওঠে এই প্রেসক্লাব। ভারতের স্বাধীনতার পথপরিক্রমা দেখার পর কালের আবর্তে এই প্রেসক্লাব দেখেছে বেদনাদায়ক বাংলাভাগ থেকে ভাষাকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: কলকাতার সাংবাদিকরা ও প্রেস ক্লাব কলকাতাসাংবাদিক ছাড়া এই ক্লাবের সদস্য ছিলেন সমাজের নানাক্ষেত্রের একাধিক দিকপাল কিংবদন্তি। এই ক্লাব প্রাঙ্গণে পা পড়েছিল অভিবক্ত বঙ্গের তিন প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। এমনকি ইন্দরা গান্ধী, মোরারজি দেশাই, রাজীব গান্ধী, অটলবিহারী বাজপেয়ী থেকে শুরু করে সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম, প্রণব মুখার্জির মতো ব্যক্তিত্বরাও এ ক্লাবে পা ফেলে গেছেন।
সম্প্রতি ৭৫ বছরে পদার্পণ করে কালের সাক্ষী এ প্রেসক্লাব। সেই উদ্দেশ্যে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একটি বই প্রকাশ হয়। বইটির নাম ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: কলকাতার সাংবাদিকরা ও প্রেস ক্লাব কলকাতা’। বইটির সংকলন ও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন ক্লাবের বর্তমান সভাপতি ও দূরদর্শনের সাংবাদিক স্নেহাশিস সুর।
তিনি বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের ৭৫ বছরে পদার্পণ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কলকাতা প্রেসক্লাব এবং তার সাংবাদিকরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ক’টি ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন তার মধ্যে অবশ্যই থাকবে দু’টি আলাদা আলাদা দেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের ঘটনা। একটির নাম ভারত আর অন্যটি বাংলাদেশ। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মতো ঘটনা ঘটেছে, তার অনেকটাই জুড়ে আছে শহর কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ।
সভাপতি বলেন, কলকাতা প্রেসক্লাবের প্লাটিনাম জয়ন্তীর সূচনায় মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কলকাতার যেসব সাংবাদিক সক্রিয়ভাবে খবর সংগ্রহের কাজে যুক্ত হয়েছিলেন, তাদের সেই লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা দুই মলাটের মধ্যে লিপিবদ্ধ হবে। তারই মধ্যে ড. ইকবালের অনুদান আমাদের আপ্লুত করলো। দুই দেশের মৈত্রী চিরকাল অটুট থাক আমাদের একমাত্র কাম্য।