বিশ্বের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা এবং তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও চর্চা অব্যাহত রাখতে জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপনের পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও তাদের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য জাতিসংঘ ও আদিবাসী গোষ্ঠী এক নতুন অংশীদারিত্ব শিরোনামে ১৯৯৩ সালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ঘোষণা করে।
আদিবাসীদের অধিকার, মানবাধিকার ও স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে ১৯৮২ সালের ৯ আগস্ট জাতিসংঘের আদিবাসী জনগোষ্ঠীবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এই দিনটিকে স্মরণ করার জন্য ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ৯ আগস্টকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যার মূল উদ্দেশ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অবহেলিত, সুযোগবঞ্চিত আদিবাসী গোষ্ঠীর সমস্যাগুলোর ওপর মনোযোগ আকর্ষণ করা এবং তাদের অধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করা। বর্তমানে পৃথিবীতে ৭০টিরও বেশি দেশে প্রায় ৩৫ কোটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ।
জাতিসংঘ ২০১৯ সালের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘Indigenous Languages’। এই মূল সুরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে- ‘আদিবাসী ভাষা চর্চা ও সংরক্ষণে এগিয়ে আসুন’।
বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে এই প্রতিপাদ্য নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও যথার্থ। কারণ বাংলাদেশের অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নানাবিধ কারণে নিজেদের মাতৃভাষার ব্যবহার ক্রমেই কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে শিশু সন্তানরাও পরিবারে মাতৃভাষা শেখা ও বলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এমনকি দারিদ্র্যের কারণে নিজ সংস্কৃতি ও উৎসবগুলোর চর্চাও করতে পারছে না। এছাড়াও আদিবাসী ভাষাগুলোর ব্যবহার ও প্রয়োগ অত্যন্ত সীমিত।
শিক্ষা, জীবন ও জীবিকার কারণে শহরে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং তাদের ছেলেমেয়েদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
এছাড়াও তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে। এসব নানা কারণে আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে সমাজে ও দেশে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও হ্রাস পাচ্ছে। সরকারিভাবে মাতৃভাষা শিক্ষার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আদিবাসী শিশুদের জন্য আদিবাসী ভাষা শিক্ষার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ৬টি জাতিগোষ্ঠীর পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গৃহীত হলেও তার বাস্তবায়ন নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন।
বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে, যদিও এই জনগোষ্ঠী উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে নয়, বরং আদিবাসী হিসেবেই নিজেদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেতে চায়। জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করলেও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনে সেই উন্নয়নের ছোঁয়া তেমন লাগেনি।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগের গবেষণা প্রতিবেদন ২০১৩-এর তথ্যমতে সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে স্যানিটেশন কভারেজ ২৪.২ শতাংশ, যেখানে বাংলাদেশের স্যানিটেশন কভারেজ বিবিএস ২০১১-এর তথ্যমতে ৬২.৩ শতাংশ। এছাড়াও আদিবাসীরা অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম অঙ্গীকার হচ্ছে, ‘Leaving no one behind’. অর্থাৎ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি লক্ষ্য থেকে কোনো জাতিগোষ্ঠীই বাদ পড়বে না। সেজন্য সব সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনের একসঙ্গে কাজ করা জরুরি।
আন্না মিন্জ: ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন, জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি ও সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচির পরিচালক