logo
আপডেট : 18 August, 2019 23:04
মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যের ক্রান্তিকালে আমাদের করণীয়
অন্তর সরকার

মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যের ক্রান্তিকালে আমাদের করণীয়

প্রতীকী ছবি

দেশে মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যের নিরাপদ উৎস নিশ্চিতকরণে সম্প্রতি নানান তর্ক বিতর্ক উঠে এসেছে। যেখানে বিদেশ থেকে মিট ও বোনমিল আমদানির বিষয়টি অধিক সমালোচনায় এসেছে। তাছাড়া মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যে ট্যানারি বর্জ্যসহ নানান ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহারের নজির মৎস্য ও প্রাণিজ আমিষ গ্রহণে সাস্থ্যঝুঁকি ও গুণগত মান নিয়ে শঙ্কায় ফেলেছে দেশবাসীকে। এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় হতে পারে দেশীয় সহজলভ্য, স্বল্পমূল্য কিন্তু নিরাপদ মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যের উৎসসমূহ নিশ্চিতকরণ ও ব্যবহার করা। আমাদের দেশে অনেক সহজলভ্য ও নিরাপদ মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যের উৎস আছে যা আমরা প্রতিনিয়ত বর্জ্য হিসেবে নষ্ট করে শুধু পরিবেশ দূষণ করছি। এই উৎসগুলোর যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ব্যবহার বিদেশ থেকে মিট ও বোন মিল ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান আমদানির উপর আমাদের নির্ভরতা কমিয়ে দিতে পারে বহুলাংশে।

সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার ও নৌকাগুলোতে কাঙ্খিত প্রজাতি ছাড়াও আরো বেশকিছু ছোট মাছ ধরা পড়ে যেগুলোকে ট্রাশফিশ কিংবা বাইক্যাচ নামে অভিহিত করা হয়। এই মাছগুলো হয় ফেলে দেওয়া হয় অথবা স্থানীয় বাজারে স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করা হয়। কিন্তু এই মাছগুলোগুলোতে প্রোটিন ও অন্যান্য খনিজ উপাদানের পরিমাণ অত্যন্ত সন্তোষজনক এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যের উপাদান হিসেবে ব্যবহারযোগ্য। যদিও এর কিছু কিছু ব্যবহার দেখা যায় তবে তা যথাযথ গবেষণা ও মান নিশ্চিতকরণের আওতার বাইরে এখনো।

দেশের প্রায় প্রতিটি বাজারে মাছ ও মাংস কাটা হয় যেখানে প্রতিদিন বিশাল পরিমাণে কাটাকুটির বর্জ্য তৈরি হয়। তাছাড়া ফিশ ও মিট প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি, সুপারশপগুলোতে অনেক বাইপ্রোডাক্ট ফেলে দেওয়া হয় যেগুলো প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের ভালো উৎস। এসব বর্জ্যগুলোতে প্রোটিন, লিপিড ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের  পরিমান নির্ণয়পূর্বক প্রক্রিজাতকরণের আওতায় আনা গেলে এগুলোকে  মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যের নিরাপদ ও স্বল্পমূল্য উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। 

দেশের শুটকিপল্লী ও আড়তগুলো থেকেও বাদকৃত মাছ, উচ্ছিস্টাংশ শুকিয়ে পাওডার করে মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয় কিন্তু এর পরিমাণ আশানুরুপ নয় এবং শুধুমাত্র উপকূলীয় ও সমুদ্রসংলগ্ন এলাকাতেই এর সরবরাহ ভালো। তাই সঠিক ব্যবস্থাপনা, যথাযথ প্রযুক্তির ব্যবহার ও মান নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দেশব্যাপি এদের সরবরাহ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

বিভিন্ন তরকারি ও কাঁচাবাজার যেমন ঢাকার কারওয়ান বাজারেই প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ শাক সবজির বর্জ্য তৈরি হয় যেগুলো বর্জ্য হিসেবে স্তূপীকরণ করা হয় কোনরুপ ব্যবহার ছাড়াই। অথচ এরকম বর্জ্য থেকেই পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে সহজ প্রযুক্তিতে ম্যাগোট, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই, টিউবিফেক্স ইত্যাদি চাষ করা হয়। লার্ভা অবস্থায় ব্ল্যাক সোলজার মাছির দেহে উন্নতমানের প্রোটিন (প্রায় ৪২%), ফ্যাট (২৯%), দরকারী অ্যামাইনো এসিড ও প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ থাকে। 

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ম্যাগোট, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই, টিউবিফেক্স ইত্যাদির গুণগত মান মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যে প্রোটিন, অ্যামাইনো এসিড ও লিপিড  এর উন্নত উৎস হতে পারে এবং পোল্ট্রি খাদ্যে এদের লার্ভা সয়াবিন মিল এবং ভুট্টাজাত খাদ্যের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে । তাছাড়া এসব বর্জ্য তাজা অবস্থায় সংগ্রহ করে গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে সরাসরি ব্যবহার করা যায়। 

আমাদের দেশে প্রতিবছর কুরবানীর সময় গরু ছাগলের বর্জ্য ও চামড়ার বিশাল একটা সরবরাহ পাওয়া যায়। গত কয়েকবছর ধরে চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় অনেক চামড়া নষ্ট হয়েছে দেশব্যাপি। যার ফলে পরিবেশে এর বিরুপ প্রভাব পড়ছে এবং দেশের অতি গুরুত্বপূর্ন একটি সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে এই চামড়াগুলোতে পশম ছাড়াও রয়েছে বিপুল পরিমাণে প্রোটিন। চামড়াশিল্পের বাইরেও এই চামড়াগুলোকে শুকিয়ে পশম ছাড়িয়ে প্রক্রিয়াজাত করে মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যের ভালো প্রোটিনের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া কুরবানীর পশুবর্জ্য, রক্ত এসবেও ভালো পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে যেগুলো মৎস্য ও প্রাণিখাদ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে যথাযথ মান নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে।

ক্ষুদিপানা বা ডাকউইড এর সাথে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। এতে প্রোটিনের পরিমাণ ৪০-৪৫ শতাংশ এবং অ্যামাইনো এসিডের পরিমাণও যথেষ্ট। ক্ষুদিপানা বা ডাকউইড এর গুণগতমান প্রায় প্রাণিজ আমিষের সম্পূরক।

অ্যাজোলা এক ধরনের ভাসমান ফার্ণ। এতে ২৪-৩০% প্রোটিন, ৪-৫% ফ্যাট ও ১১-২১% আঁশ থাকার দরুন এদেরকে শুকিয়ে গুড়া করে মাছের খাবারের সাথে ব্যবহার করা যায়। মাছ চাষের পাশাপাশি খুব সহজেই ও স্বল্প ব্যয়ে এদের চাষ করা সম্ভব। আমরা যদি সম্পুরক খাদ্যের গুণাবলী সম্পন্ন প্রাকৃতিক খাদ্য ক্ষুদিপানা এবং অ্যাজোলা এর ব্যবহার বাণিজ্যিক মাছ চাষে প্রচলিত করতে পারি তাহলে মাছ চাষের প্রধান খরচ যা খাদ্যে ব্যয় হয় তা অনেকগুণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। 

উপরোক্ত সহজলভ্য উৎসগুলো ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত নথিভুক্তিকরণ, প্রয়োগমূলক গবেষণা, পুষ্টিউপাদান যাচাইকরণ  ও মান নিশ্চিতকরণ। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের যথাযথ উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসব উৎসকে মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা গেলে একদিকে এই খাতটি সমৃদ্ধ হবে, আমদানি নির্ভরশীলতা কমবে আর অন্যদিকে কমবে পরিবেশ দূষণ। তাই দেশের এগিয়ে চলা মৎস্য ও প্রাণিখাতে নিরাপদ ও স্বল্পমূল্য খাদ্যের যোগানের মাধ্যমে উক্ত খাতকে সমৃদ্ধ করে দেশের কল্যাণে ভূমিকা রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্‌বান জানাচ্ছি।

 


লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়