logo
আপডেট : 23 August, 2019 01:32
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব
আহমাদুল কবির

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। এজন্য বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মানুষের প্রকৃতি বিধ্বংসী কর্মকান্ডে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে দায়ী করছেন গবেষকরা।

গবেষকরা বলছেন, ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিস প্রিভেনশন এন্ড কন্ট্রোল (ইসিডিসি)-প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মালয়েশিযা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর এবং ভিয়েতনামে বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর হারও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা- ডব্লিউএইচও জরিপে, বিশ্বের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি, অর্থাৎ ২৫০ কোটি মানুষ এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রকৃতি ও প্রাণীকূল বিনষ্ট অন্যতম কারণ বলছেন গবেষকরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এডিস মশার প্রজননের জন্য মাঝারি বৃষ্টিপাত এবং ২৭-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাই যথেষ্ট। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশেগুলোতে। সেই উষ্ণতায় পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ডেঙ্গুরবাহক এডিস মশাও। মশা শিকারি ব্যাকটেরিয়া, কীট এবং প্রাণীও কমছে উল্লেখযোগ্য হারে। এর কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ন, প্রকৃতি ও প্রাণিকূল বিনষ্ট এবং দূষণ।

চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মালয়েশিয়ায় ৮০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ১১৩ জনের। মালয়েশিয়ার ডেপুটি হেলথ মিনিস্টার লি বুন চ্যান আশঙ্কা করছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্তেরর সংখ্যা বছর শেষে ১ লাখ ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। 

দেশটির স্বাস্থ্য-মন্ত্রণালয় বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আনতে। এসবের মধ্যে রয়েছে মশার ওষুধ ছিটানো। ও আবাসস্থল ধ্বংস করা। এছাড়া, ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ডেঙ্গু দমনের অতি আধুনিক উপায় পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

তবে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় ভ্যাকসিনের ব্যবহার নিয়ে এখনই ভাবছে না মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ। ফিলিপাইনে এটি ব্যবহার করে স্বাস্থ্যগত কারণে প্রত্যাহার করা হয়েছিল বলে জানান লি বুন।

২০১৪ সালে  দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি দেশে ডেঙ্গুর টীকা পরীক্ষা করা হয়েছিল, যার ফলাফল ছিল বেশ উৎসাহব্যঞ্জক। 

ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইনের ১০,২৭৫ টি (২ থেকে ১৪ বছর বয়সী) শিশুর উপর এই টীকার পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় টীকাটির সামগ্রিক কার্যক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছিল ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ। তিন ডোজ দেওয়ার পরে টীকাটি একটি শিশুর উন্নয়নশীল ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের সম্ভাবনা ৮৮ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে ফেলে। এছাড়াও ডেঙ্গুর কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকির পরিমাণ সে সময় হ্রাস পায় ৬৭ শতাংশ। 

ডেঙ্গু জ্বর ও জ্বরের বিরুদ্ধে কার্যক্ষমতা প্রদর্শন করতে প্রথম ডেঙ্গুর টীকা। 
গবেষকরা বলছেন, ডেঙ্গু টীকা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। ডেঙ্গু হচ্ছে এডিস মশা বাহিত একটি ক্রান্তীয় ভাইরাস। এখনও পর্যন্ত এর সুপরিচিত কোন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশের ডেঙ্গুর ঝুঁকি রয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষের ডেঙ্গু সংক্রমণের রিপোর্ট পাওয়া যায়; এর প্রায় ৭৫ শতাংশই দেখা যায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়। এই অঞ্চলের দ্রুত নগরায়নকে এর কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন।

মালয়েশিয়ার ভাইরাসবিদ দাতুক ডঃ লাম সাই কিট ডেঙ্গুকে একটি শহুরে রোগ বলা বর্ণনা করেছেন। লামসাই কিট বলছেন, যদি একটি শহুরে এলাকায় থাকার জন্য অনেক মানুষ আসে, তাহলে তাঁদের মধ্যে সংক্রমণে সমর্থ অনেক বেশি মানুষ আপনি খুঁজে পাবেন। এটির সংস্পর্শে এলেই তাদের অনেকেই ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। 

২০১৪ সালে ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ড সরকার একটি সফল টিকা পরীক্ষার কথা ঘোষণা দেয়, যা চার প্রজাতির ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে সক্ষম। এটি এই রোগের একটি উপসর্গ। মজার বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি দেশই ডেঙ্গুর টীকা গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছে।  

পাঁচটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ওষুধ কোম্পানি সানোফি পাসচার গত দুই দশক ধরে এশিয়ান ডেঙ্গু টিকা পরীক্ষার গবেষণা কাজ চালিয়ে আসছে। তাদের সর্বশেষ সমীক্ষার সংবাদে ডেঙ্গু টীকা পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্যায়ের ঘোষণা রয়েছে। কিন্তু একই গবেষণায় টীকাটির সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ রয়েছে। লেখক ডেমিয়েন গার্ডে এটি উল্লেখ করেছেন, টীকাটির ব্যাপক কার্যক্ষমতা সত্ত্বেও, তথ্যের দিকে নিবিষ্ট দৃষ্টি আরো সূক্ষ্ণ ছবি দেখিয়ে দিবে। ডেঙ্গু মূলত চারটি প্রজাতি থেকে আসে এবং সানোফির চিকিৎ্সা ধরন ১,৩ ও ৪ নং এর বিরুদ্ধে ভাল। কিন্তু ২ নং সেরোটাইপের ক্ষেত্রে এর কার্যক্ষমতা মাত্র ৩৪.৭%। এই পরিসংখ্যানে এশিয়ার সবচেয়ে সাধারণ রোগের চিকিৎসা তাৎপর্য অনুপস্থিত। 

২০২০ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গু নির্মূলের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরণের পদক্ষেপ ফেলা সম্ভব হবে বলে গবেষকরা আশা করছেন।

এদিকে মালয়েশিয়ায় ৯টি রাজ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এগুলো হলো, সেলেনগর, ফেডার অঞ্চলগুলো, জোহর, কেলেন্তান, সাবাহ, পেনানং, সারাওয়াক, নিগরি সেম্বিলিয়ান ও পাহাং। চিহ্নিত করা হয়েছে এসব রাজ্যের ২৫১টি এলাকা।  লি বুন চ্যান বলেন, স্বাস্থ্য-মন্ত্রণালয় বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আনতে। এসবের মধ্যে রয়েছে মশার ওষুধ ছিটানো। ও আবাসস্থল ধ্বংস করা। 

এছাড়া, ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ডেঙ্গু দমনের অতি আধুনিক উপায় পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। এ ছাড়া ডেঙ্গু মোকাবিলায় সাধারণ মানুষের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন এই ডেপুটি হেলথ মিনিস্টার । ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ডেঙ্গু শহরে ঘটে উল্লেখ করে এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধে তৎপর হওয়া আহ্বান জানান তিনি। এর আগে, ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ায় ডেঙ্গুতে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। সে সময় প্রাণহানি ঘটে ৩৩৬ জনের।

বর্তমানে মালয়েশিয়া যা করে ডেঙ্গু চিকিৎসায়: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজ নপর্যটক তার ব্যক্তিগত কাজে মালয়েশিয়ায় এসেছিলেন। কয়েকদিন কুয়ালালপুর শহরে অবস্থান করেন। সেখান থেকে লংকাউই গিয়ে জ্বর অনুভব করেন। তাড়াহুড়ো করে রাজধানি শহর কুয়ালালামপুরে ফিরে আসেন। জানাশোনা সবাই তাকে, ডেঙ্গু হতে পারে। ওই পর্যটক শহরের একটি হাসপাতালে ছুটেযান। রক্ত পরীক্ষা করে চিকিৎসক বললেন, ডেঙ্গু হয়েছে। রোগটি সম্পর্কে তার ধারণা পরিষ্কার না থাকায় হাসপাতাল থেকে হোটেলে ফিরে যান। জ্বরের মাত্রাও বাড়ল। শরীরে প্রচ- ব্যথাও অনুভব করতে লাগলেন। আবার হাসপাতালে। সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসক স্যালাইন পুশ করলেন। একটি শেষ হলেই আরেকটি স্যালাইন দেওয়া হলো।

পর্যটক দেখলেন হাসপাতালে প্রচুর ডেঙ্গু রোগী। তাদের জন্য আলাদা চিকিৎসা ব্যবস্থা করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মালয়েশিয়া সারা বছর বৃষ্টির কারণে দেশটিতে এডিস মশাও প্রচুর। যদিও সরকার সারা বছর ওষুধ ছিটায়। হাসপাতালে যেতেই কর্তৃপক্ষ জানতে চাইল, পর্যটক ব্যক্তি কোথায় থাকেন?। ঠিকানা নিয়ে ওই এলাকা এবং এর আশপাশে আধাকিলোমিটার মশার ওষুধ ছিটানো হলো। এ হলো তাদের মশারোধের অন্যতম ব্যবস্থা। চিকিৎসা শুরু হলো।  প্রথমে তাকে বেশি গতিতে, মিনিটে ১৮-২০ ফোঁটা করে স্যালাইন দেওয়া হলো। ৩ ব্যাগ স্যালাইন শেষ হওয়ার পর গতি কমানো হলো। মিনিটে ৬ থেকে ৮ ফোঁটা দেওয়া হলো। 

প্রতিঘণ্টায় রক্ত পরীক্ষা করে প্লাটিলেট দেখা হলো। একটি পানি পরিমাপ করার মগ দেওয়া হলো। বলা হলো, প্রস্রাব করতে হবে ওই মগে। প্রতি ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রস্রাব করতে হবে, যা একজন স্বাভাবিক মানুষের ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পর হয়ে থাকে। অর্থাৎ রোগিকে এতটাই পানি এবং তরল পদার্থ পান করানো হলো যে, ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রস্রাবের বেগ হতো। ২ দিন হাসপাতালে হল পর্যটকের। এরপর স্যালাইনের পরিমাণ ৪ ফোঁটায় নামানো হলো। প্রতি ঘণ্টায় রক্ত পরীক্ষা হাসপাতাল ছাড়ার আগ পর্যন্ত চলল। মাঝে মাঝে কর্তব্যরত নার্সরা কিছু ওষুধ খাওয়াল। খাবারে করলা থাকল প্রতি বেলায়।  ডেঙ্গু রোগীর জন্য এটি  বিশেষ খাবার।

চিকিৎসকের অনুমতির কিছুদিন পর হাসপাতাল ছাড়া হল। শত শত রোগীকে একই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করানো হচ্ছে এবং সবাই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। হাসপাতাল ছাড়ার পর চিকিৎসক তাকে পেঁপে পাতার জুস (মালয়েশিয়ায় বোতলজাত পাওয়া যায়) খেতে দিলেন। এই জুস খাওয়ার পর ওই ডেঙ্গু রোগি শরীরে বেশ জোর পেলেন।  পেঁপে পাতার রস প্লাটিলেট বাড়াতে খুবই সাহায্য করে।

অনেকে বলছেন, মালয়েশিয়ায় সারা বছরই মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত। ডেঙ্গু নিয়ে তাদের গবেষণাও বেশ ভালো। মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা গেলে আমাদের দেশের অনেক প্রাণ বাঁচবে।