তুহিন সানজিদ: বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা এখন আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এই সংকট সমাধানে সারা বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ক্রমবর্ধমান স্থান সঙ্কট ও পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণে এ এলাকার পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকির কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নতুন চারটি প্রস্তাব দেন তিনি। শুক্রবার বিকেলে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে বাংলায় দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এমন একটি সমস্যার বোঝা বহন করে চলেছি যা মিয়নামারের তৈরি। এটি সম্পূর্ণ মিয়ানমার ও তার নিজস্ব নাগরিক রোহিঙ্গাদের মধ্যকার একটি সমস্যা। তাদের নিজেদেরই এর সমাধান করতে হবে।
তিনি বলেন, যদিও রোহিঙ্গা সমস্যা প্রলম্বিত হয়ে তৃতীয় বছরে পদার্পণ করেছে। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও চলাফেরার স্বাধীনতা এবং সামগ্রিকভাবে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরে যায়নি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বিলম্বিত হওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি বাস্তবিকপক্ষেই দুঃখজনক যে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান না হওয়ায় আজ এই মহান সভায় বিষয়টি আমাকে পুনরায় উত্থাপন করতে হচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই এ সংকট সমাধান সম্ভব উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, সুরক্ষিত ও সম্মানের সঙ্গে স্বেচ্ছায় রাখাইনে নিজগৃহে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করতে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের আলাপ-আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এবারের অধিবেশনে নতুন চারটি প্রস্তাব প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আমি এর আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং রাখাইন প্রদেশে বেসামরিক তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় প্রতিষ্ঠাসহ পাঁচ-দফা প্রস্তাব পেশ করেছিলাম।
আজ কিছু প্রস্তাব আবার পেশ করছি:
১. রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন ও আত্মীকরণে মিয়ানমারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পূর্ণ প্রতিফলন দেখাতে হবে।
২. বৈষম্যমূলক আইন ও রীতি বিলোপ করে মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থা তৈরি করতে হবে এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের উত্তর রাখাইন সফরের আয়োজন করতে হবে।
৩. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বেসামরিক পর্যবেক্ষক মোতায়েনের মাধ্যমে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
৪. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবশ্যই রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ বিবেচনায় আনতে হবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অন্যান্য নৃশংসতার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা মনে করি বহুপাক্ষিকতাবাদ বৈশ্বিক সমস্যা সমাধান এবং সার্বজনীন মঙ্গলের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। বিশ্বে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতিসংঘই আমাদের সব আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এই আশাই ব্যক্ত করেছিলেন।
একটি শক্তিশালী বহুপাক্ষিক ফোরাম হিসেবে জাতিসংঘের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন সর্বদা অব্যাহত থাকবে বলেও অঙ্গীকার করেন তিনি।
নিপীড়িত ফিলিস্তিনের পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যতদিন পর্যন্ত আমাদের ফিলিস্তিনি ভাই-বোনদের ন্যায়সঙ্গত ও বৈধ সংগ্রাম সফল না হচ্ছে, ততদিন তাদের পক্ষে আমাদের দৃঢ় অবস্থান অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশ আজ প্রায়শই ‘উন্নয়নের বিস্ময়’ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে মন্তব্য করে বাংলাদেশে টানা তিনবার মিলিয়ে চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আন্তর্জাতিক বিশ্বে নানা অস্থিরতা ও বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত আর্থিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশ গত ১০ বছর ধরে সমৃদ্ধি বজায় রেখেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, উন্নয়ন কৌশল হিসেবে আমরা মনোনিবেশ করেছি দারিদ্র্য দূরীকরণ, টেকসই প্রবৃদ্ধি, পরিবেশ সুরক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো বিষয়। গত ১০ বছর ধরে আমরা প্রগতিশীল ও সময়পোযোগী নীতি এবং কার্যক্রম গ্রহণ করে আসছি যা আমাদের এনে দিয়েছে অসামান্য সাফল্য।
নাগরিকদের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব নাগরিককে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রায় ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক আমরা গড়ে তুলেছি। এসব কেন্দ্র থেকে গ্রামীণ জনগণকে বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ এবং স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। সেবাগ্রহিতাদের ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু। এসব কর্মসূচির ফলে মাতৃমৃত্যুর হার, নবজাতক ও শিশু মৃত্যুহার, পুষ্টিহীনতা, খর্বকায়তা ও ওজনহীনতার মতো সমস্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী, অটিজম ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সম্পৃক্ত করার বিষয়টি আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। বর্তমানে এ ধরনের প্রায় ১৬ লাখ ৪৫ হাজার ব্যক্তি নিয়মিত সরকারি ভাতা পাচ্ছেন।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী মোতায়েনে জাতিসংঘের আহ্বানে নিয়মিতভাবে সাড়া দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
নতুন দায়িত্বে আসা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনের সভাপতি তিজানি মুহাম্মদ বান্দেকে অভিনন্দন জানান এবং গেলো বছর সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী মারিয়া ফার্নান্দা এসপিনোসা গার্সেসের প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসেরও প্রশংসা করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘ মহাসচিব কর্তৃক বিশেষত জাতিসংঘ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে গৃহীত সংস্কার উদ্যোগগুলোকে সাধুবাদ জানাই। আশা করছি নতুন প্রজন্মের জাতিসংঘ কান্ট্রি টিম এবং নতুনরূপে সজ্জিত জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারী ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতিসংঘ স্বাগতিক রাষ্ট্রের জাতীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংশ্লিষ্ট দেশের উন্নয়ন ও শান্তি প্রক্রিয়ায় আরও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারবে।’