॥ শাহনাজ পলি ॥
মা মারা গেছেন ২০০৬ সালে। তবু অন্তর জুড়ে রয়েছেন পরম মমতায়। মায়ের ভালোবাসা তখন যতটা না বুঝেছি, এখন তার চেয়ে বেশি বুঝি। কিন্তু আফসোস আর তো মাকে ফিরে পাই না।
শুধু মনে হয় একবার যদি সেই সময়টা ফিরে পেতাম, যখন দেখেছিলাম গনগনে রোদে উঠানে ধান নেড়ে দিচ্ছেন। গরমে ঘেমে মায়ের সে কী অবস্থা। এখন এমনটা হলে মাকে ছায়ায় বসিয়ে আমিই পা চালিয়ে ধান নেড়ে চেড়ে উল্টে দিতাম। যখন দেখেছি সংসারের কাজ সামলাতে মায়ের কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছে! মায়ের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ গুছিয়ে দিতাম। যখন মা আমাদের জন্য রান্না করতে গিয়ে ভেজা কাঠে ফুঁ দিতে দিতে চোখমুখ লাল করে ফেলেছেন, আঁচল দিয়ে জ্বালা করা লাল চোখ মুছতেন, মায়ের চুলাটা আমিই ফুঁ দিয়ে জ্বালিয়ে দিতাম। যখন দেখেছি মাকে অনেকক্ষণ বসে নামাজ পড়ছেন বা ইবাদত বন্দেগী করছেন, তখন ঘামে মায়ের ব্লাউজ ভিজে চুপচুপ করত, মায়ের পাশে বসে পাখা খানা নেড়ে মাকে বাতাস দিতাম। মাঝে মাঝে মাকে দেখেছি কাজের সময় একটা দরকারী জিনিস খুঁজে খুঁজে হয়রান, তখন মাকে একটু বসিয়ে রেখে সে জিনিসটা আমিই না হয় খোঁজ করে দিতাম।
মা যখন পুকুরের ঘাটে বসে কাপড় কাচতেন, সাথে না হয় আমিই কয়েকটা কাপড়ে সাবান লাগিয়ে দিতাম। শুধু মনে হয় যদি একবার মাকে ফিরে পেতাম তাহলে কোন কষ্ট দিতাম না। সব সময় মনে হয় মায়ের জন্য তেমন কিছুই করিনি। সেই ব্যর্থতার হতাশা আমাকে কুরে কুরে খায়।
মা ছিলেন আমার ভিত্তি, আমার শক্তি, আমার সাহস। মা যখন ছিলেন বুঝতেই পারিনি মা কত মূল্যবান। যখন বুঝলাম তখন মা আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অন্য জগতে। মায়ের মত আপন আর কেউ কি পৃথিবীতে আছে ? মায়ের মত আসলে কেউ হয় না, হতে পারে না! মায়ের তুলনা শুধু মা-ই। মা নেই তাই বারো মাসে ছয় ঋতুতে কেউ ফোন করে বলে না গ্রীষ্মের ফল আর শীতের পিঠা খেতে বাড়ী আয়। কত বছর ফোন দিয়ে বলে না ঈদে বাড়ি আসো। এমন আরো কত কী! কতদিন হল মার্কেটে গিয়ে মায়ের জন্য শাড়ী কিনি না।
মা নেই কথাটা ভাবতেই মনে হয় মাথার উপরে শুধুই শূন্যতা। আমার মা খুব বেশি শিক্ষিত না হলেও খুব আধুনিক ছিলেন। এখনও চোখ বন্ধ করলেই মায়ের আঁচল দিয়ে মাথা ঢাকা ঘর্মাক্ত মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠে। খুব দামি কাপড় না পরলেও পরিচ্ছন্ন আর ছিমছাম থাকতে পছন্দ করতেন। অজপাড়া গাঁয়ে বাস করলেও মা খুব নিয়ম মেনে চলতেন। যেমন সময়মত গোসল, রান্না, খাওয়া। কখনও এই নিয়মের হেরফের হতে দেখিনি। মায়ের কড়া শাসনের বেড়াজালে আমরা বেড়ে উঠেছি। রুটিনের বাইরে আমাদের চলার সাহস ছিলো না। মানুষের বাজে সমালোচনা করা একদম পছন্দ ছিল না মায়ের। কখনো
মনের কষ্টে কাউকে নিয়ে দুই একটা কথা বলে ফেললেও সাথে সাথে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন। প্রতিদিন ভোরে মায়ের কোরান তেলাওয়াতের শব্দ শুনে ঘুম ভাঙতো। ফজরের নামাজের জন্য ভোর থেকে ডাকাডাকি শুরু করতেন। ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে একটু বেশি ঘুমাবো, তা সম্ভব ছিলো না। সুরা ইয়াসিন, সুরা আর- রহমান, সুরা মোজাম মিল মুখস্ত ছিলো। চোখে চশমা লাগিয়ে আম্মা অর্থসহ কোরান শরিফ পড়তেন। মাথায় চিকন নীল অথবা কালো পেড়ে শাড়ির আঁচলে কি যে সুন্দর লাগতো মাকে।
বারো মাসই চাঁদ দেখে নফল রোজা আর নামাজ আদায় করতেন। পাড়ার কত মহিলা আম্মার কাছে এসে নামাজ রোজার খবর নিয়ে যেতেন তার ঠিক নেই।
দুপুরে খাবারের পর আম্মা শুয়ে শুয়ে বারো চাঁদের ফজিলত বই থেকে নফল নামাজের দোয়া মুখস্ত করতেন আর নামাজের নিয়ম কানুম শিখতেন। কখনও আমাদের হাতে বইটা ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, এই কয়টা পাতা জোরে জোরে পড়। কখনও আমি শুনাতাম কখনও ছোট ভাই । মা খুব মনযোগ দিয়ে তা শুনতেন। সপ্তাহে দুটো করে রোজা রাখতেন মা।
মা অনেক হাদিস জানতেন । মাঝে মধ্যে শুনেছি বলতেন হাদিসে আছে, কারো সন্তান শিশুকালে মারা গেলে দুটো করে রোজা রাখলে ওই শিশুর সাথে বেহেশতে দেখা হয়। সে বিশ্বাস থেকেই মনে হয় মা সারা বছর প্রতি মাসে দুটো রোজা রাখতেন। শীত গ্রীষ্ম সব সময় এর কোন ব্যত্যয় হতে দেখিনি।মাত্র চার কি সাড়ে চার বছর বয়সে আমার ছোট বোন মেলি মারা যায়। পুকুরে ডুবে। আমরা কেউ টেরই পাইনি কোন ফাঁকে একা একা পুকুরে পড়ে গেলো।
সেদিন সন্ধ্যায় মাগরিব নামাজ শেষ করে সালাম ফিরেই মা বললেন, মেলি কই? আমরা তিন ভাইবোন হ্যারিকেনের আলোয় মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে পড়তে বসেছি। আমরা সবাই ছোট ছোট। বড় ভাই হয়ত ফোর বা ফাইভে পড়ে। আমি সবে স্লেট পেন্সিল নিয়ে স্কুলে যাই। মায়ের কথায় আমাদেরও মনে পড়লো তাইতো আমাদের পাশে মেলি নেই! এ বাড়ি ও বাড়িতে খোঁজ করা হল। খোঁজ করা হল মামার দোকানে। খুব শান্তশিষ্ট মেলিকে সবাই একটু বেশিই আদর করত। একে একে বাড়িতে অনেক লোক এসে জড়ো হলো। বিকেলে বাইরে খেলার সময় মেলি সাথেই ছিলো। তারপর আর কেউ কিছু বলতে পারি না। পৌষের বিকেলে মায়েরা যখন উঠানে বসে কুমড়া বড়ি বানাতে ব্যস্ত তখন বোনটি আমার বদনা হাতে পুকুরে পানি আনতে গিয়েছিলো। শান বাঁধানো পিচ্ছিল সিঁড়ির থেকে পা ফসকে পানিতে পড়ে যায়।
সন্ধ্যায় মা যখন পুকুরে ওজু করতে গিয়ে দেখলেন কয়েক সিঁড়ি নিচে পানির তলে চকচকে কাশার বদনাটা পড়ে আছে। মা দেখে বুঝতেই পারলেন না তার পাশেই মেলিও ডুবে আছেন। ঠান্ডা পানি থেকে বদনা না তুলেই মা ওজু করে বাড়ী ফিরে গেলেন। ভাবলেন কাল গোসলের সময় তোলা যাবে। কেউ একজন মনে করলো সন্ধ্যার আগে বদনা হাতে মেলিকে পুকুরে যেতে দেখেছিলো। আর সময় নষ্ট না করে দৌড়ে গিয়ে মা পুকুরে ঝাপ দিয়ে নেমে গেলেন। সাথে সেজো মামাও। মা বদনা তুললেন। কাছাকাছি আর কিছু নেই। মেলি নেই। প্রতিবেশী নবা ভাই নেমে এক ডুব দিয়েই কিছু একটা আছে বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। আরেক ডুব দিয়ে হিম শীতল নিথর দেহটা দুহাতে উঁচু করে ধরলেন। হ্যারিকেন আর টর্চের আলোয় মেলিকে চিনতে কারো বাকী রইলো না। মুহুর্তে নির্জন রাতের সেই পুকুর পাড়ে আর্তনাদের বাতাসে ভারী হয়ে গেলো। লবন লাগিয়ে আর মাথার উপরে ঘুরিয়ে পেট থেকে পানি বের করা হলো। মেলি আর চোখ মেলেনি। অপার শূন্যতায় মেলি হারিয়ে গেলো। আমৃত্যু মা সেই কষ্ট লালন করে গেছেন। একা, খুব সঙ্গোপনে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
...............................................................................................................................................................
[প্রিয় পাঠক, নিউইয়র্ক মেইল যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত সর্বাধিক জনপ্রিয় বাংলা অনলাইন। এই অনলাইনের” আমার চোখে আমার মা” বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। মা'কে নিয়ে আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। আপনি এবং মায়ের ছবিসহ মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। লেখা প্রকাশ ছাড়াও আমাদের রয়েছে বিশেষ পাবলিকেশন-এর পরিকল্পনা।]
এছাড়া প্রবাসে আপনার কমিউনিটির নানান খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]