ঢাকা অফিস: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধ হচ্ছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। জুয়াড়িদের কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাবের বিষয়টি গোপন রাখার কারণে তার বিরুদ্ধে ১৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চলেছে বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সাকিব ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে এক নম্বর অলরাউন্ডার।
ভারতের সাথে ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচের কয়েকদিন আগেই এই দু:সংবাদ বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য অনেক বড় একটা ধাক্কা।
দুই বছর আগে একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে এক ক্রিকেট জুয়াড়ির কাছ থেকে অনৈতিক প্রস্তাব পেয়েছিলেন সাকিব। সেটি তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান করলেও আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগকে না জানিয়ে গোপন করেন তিনি। বিষয়টি পরে আইসিসি জানতে পারে। আন্তর্জাতিক জুয়াড়িদের কল রেকর্ড ট্র্যাকিং করে এ ব্যাপারে তারা তথ্য উদ্ধার করে। ওই জুয়াড়ি আইসিসির কালো তালিকায় থাকাদের একজন। বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর সম্প্রতি সাকিবের সঙ্গেও কথা বলেন আইসিসির অ্যান্টিকরাপশন অ্যান্ড সিকিউরিটি ইউনিট (আকসু) প্রতিনিধি। সাকিবও নিজের ভুল স্বীকার করেছেন আকসু তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে। আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, জুয়াড়ির প্রস্তাবকে গুরুত্ব দেননি বলেই জানাননি। বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়াটাই তার জন্য কাল হয়েছে। সব ধরনের ক্রিকেটে নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছেন তিনি। দু’একদিনের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সাকিবের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানাবে আইসিসি।
আইসিসি ইতোমধ্যে সাকিবের ব্যাপারে বিসিবিকে বিস্তারিত জানিয়েছে। তাকে জাতীয় দলের সঙ্গে অনুশীলন না করার নির্দেশনাও দিয়েছে আইসিসি। এ কারণে অসুস্থ বলে জাতীয় দলের অনুশীলনে যোগ দিচ্ছেন না সাকিব।
সোমবার বিসিবির একাধিক পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাকিব পরবর্তী সময়ে আকসুকে সহায়তা করায় একটু নমনীয় তারা। শাস্তি ১৮ মাস নির্ধারণ করা হলেও সাকিব আপিল করলে সেটা কমিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। বিসিবির সহযোগিতা চাওয়ার পাশাপাশি সাকিব আইসিসির কাছেও ক্ষমা চেয়ে শাস্তি মওকুফের আবদেন করবেন। আইসিসি দুর্নীতি দমন বিভাগের নিয়ম ও শৃঙ্খলা মেনে চললে এই শাস্তি ছয় মাসে নেমে আসতে পারে। এটাই এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন শাস্তি।
আইসিসির দুর্নীতি দমন নীতিমালায় আছে, কোনো ক্রিকেটার, কোচিং স্টাফ, আম্পায়ার, স্কোরার, গ্রাউন্ডসের সদস্য, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংশ্নিষ্ট যে কেউ জুয়াড়ির কাছ থেকে যে কোনো ধরনের প্রস্তাব পেলে তাৎক্ষণিকভাবে তা আইসিসি বা সংশ্নিষ্ট দেশের ক্রিকেট বোর্ডের দুর্নীতি দমন কর্মকর্তাদের জানাতে হবে। যতটা দ্রুত সম্ভব সেটা করার নির্দেশনা আছে। এজন্য প্রতিটি সিরিজ বা টুর্নামেন্ট শুরুর আগে আইসিসি থেকে ক্রিকেটার এবং অফিসিয়ালদের সচেতন করতে জুয়াড়িদের সম্পর্কে অবগত করা হয়।
আইসিসির তালিকাভুক্ত জুয়াড়িদের ছবি ও ফোন নম্বর টানিয়ে দেওয়া হয় ড্রেসিংরুমের পাশে। প্রতিটি আন্তর্জাতিক সিরিজে আকসুর সদস্য উপস্থিত থাকেন। বাংলাদেশে ঘরোয়া ক্রিকেট মৌসুম শুরুর আগেও আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের নির্দেশনা মেনে খেলোয়াড়, টিম অফিসিয়াল, ম্যাচ অফিসিয়াল এবং গ্রাউন্ডস কর্মীদের সচেতন করা হয়। এ কাজটি করেন বিসিবির দুর্নীতি দমন কর্মকর্তা মেজর (অব.) মোর্শেদুল ইসলাম। ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা এবং জুয়াড়িদের ছায়া থেকে দূরে রাখতে আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ দলের সঙ্গে রাখা হয়েছিল তাকে।
ফিক্সিং প্রতিরোধে আইসিসির সচেতনতামূলক কার্যক্রমগুলোতে সাকিব বরাবরই উপস্থিত ছিলেন। ২০০০ সাল থেকে চালু হওয়া 'আইসিসি অ্যান্টিকরাপশন রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস' ভালোই জানা বাংলাদেশ অধিনায়কের। এই নিয়ম অনুসরণ করে আগে একবার জুয়াড়ির ফোন পাওয়ার বিষয়ে আকসু ও বিসিবিকে জানিয়েছিলেন তিনি। অথচ সেই সাকিবই কি-না দুই বছর আগে এত বড় একটা ভুল করে ফেলেছেন।
বিসিবির এক কর্মকর্তা বলেন, স্পট ফিক্সিং বা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি বা অভিযোগও তোলা হয়নি। আইসিসি পরিস্কার জানিয়েছে, সাকিব জুয়াড়ির কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার বিষয়টি জানাননি। এতেই আইন ভাঙা হয়েছে। তবে সাকিব কোনো ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। আকসু ভালো করেই জানে, সাকিব ক্রিকেটে যে কোনো অনৈতিক বিষয়কে ঘৃণা করেন। তিনি এও বলেন, 'সাকিবের কেসটা মোহাম্মদ আশরাফুলের মতো নয়। তবে এটা অবশ্যই এ দেশের ক্রিকেটের জন্য বড় দুঃসংবাদ।'
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, আকসুর তদন্ত এবং শাস্তির ইস্যুতে সাকিব আল হাসান গত দু'দিন বৈঠক করেছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের সঙ্গে। বৃহস্পতিবার আর রোববার পাপনের ধানমন্ডির কার্যালয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সাকিব নিজের ভুল স্বীকার করে বিসিবির সহযোগিতা চেয়েছেন বলেও জানান এক কর্মকর্তা। সাকিবের কাছ থেকে ঘটনা জানার পর পাপনও হতবাক। সাকিবের মতো একজন বিশ্বসেরা ক্রিকেটার এমন ভুল করতে পারেন, ভাবতেও পারছেন না তিনি।