সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারসহ সড়ক পারাপারে সব নিয়ম মেনে চলা যেমন উচিত তেমনি সরকারের সেবা সংস্থাকে পরামর্শ ও অভিযোগ জানানোও নাগরিকের দায়িত্ব। ফিটনেস বিহীন গাড়ির ছবি-ভিডিও, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, স্থান ও সময় উল্লেখ করে বিআরটিএ এর ওয়েবসাইটে অভিযোগ দিলে শাস্তির ব্যবস্থা করা সহজ হয়। এ ব্যপারে সংস্থাটি জনগণের সহযোগিতা চাইলেও তেমন কোন সাড়া মেলেনি।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটি-এর ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেছে, গত আগস্ট মাসে অভিযোগ জমা পড়েছে মাত্র ১৭টি। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ার পরেও অভিযোগ জানানোর সংখ্যা খুবই কম হওয়ায় সড়ক নিরাপদ করার কাজে গতি পাচ্ছে না। এমনটাই মনে করেন সড়ক ও যানবাহন নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা শুধু বিআরটিএ, পুলিশ, সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারের সেবা সংস্থাগুলো ফিরিয়ে আনতে পারবে না। এখানে নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে।
বিটিআরসির তথ্যমতে, চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত ১৬ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার বিভিন্ন অপারেটরের সিম বিক্রি হয়েছে। এরমধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ৯ কোটি ৮১ লাখ ৩৬ হাজার নাগরিক। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটিরও বেশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে থাকা এক ভাগেরও কম নাগরিক যদি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ এর ওয়েবসাইটে পারামর্শ ও বিভিন্ন অসংগতির বিষয়ে অভিযোগ করেন তাহলে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে বড় ভূমিকা রাখবে। অভিযোগ জানার পর যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন, চালকের লাইসেন্স, রুট অনুমোদন, ফিটনেস পরীক্ষা করাসহ বিভিন্ন কাজে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারবে বিআরটিএ। একইভাবে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আরো সক্রিয় হবে পুলিশ।
সড়ক নিয়ে কাজ করা অনেকেই বলছেন, পথচারিরা রাস্তা পারাপারে জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ তেমন ব্যবহার করেন না। তারা ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও ফিটনেস বিহীন গাড়ির ব্যপারে বিআরটিএ বা পুলিশের ওয়েবসাইটে পরামর্শ বা অভিযোগও দেন না।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, গত আগস্ট মাসে বিআরটিএ’র ওয়েবসাইটে ৮টি ও মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ৯টি অভিযোগ জমা পড়ে। ১৭টি অভিযোগের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত ৬টি, ড্রাইভিং লাইসেন্স অন্য সার্কেলে ট্রান্সফার সংক্রান্ত একটি, বাস ভাড়া সংক্রান্ত ৮টি ও অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন ও যাত্রীর সঙ্গে খারাপ আচরণের বিষয়ে একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগগুলা এরই মধ্যে নিস্পত্তি করা হয়েছে। প্রধান কার্যালয় ছাড়া উপ-পরিচালক অফিস গুলোতেও নিয়মিত অভিযোগ নিস্পিত্তি করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, উন্নত রাষ্ট্রগুলোর শিশুদের কিভাবে পথ চলতে হবে তা শেখানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা শেখানো হয় না।
সম্প্রতি মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে ফুটওভার ব্রিজের নিচ দিয়ে ঝুকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন চৈতী নামের ১০ম শ্রেণির এক ছাত্রী। এভাবে রাস্তা পার হলেন কেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, স্কুল ব্যাগটা খুব ভারি। তাই ব্রিজে উঠতে ইচ্ছে হলো না।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আমাদের দেশের নাগরিকরা তো নিজেদেরই দায়িত্ব নিতে শেখেনি। নাগরিকদের মধ্যে আগে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
অপরদিকে, সম্প্রতি এক সভায় সদ্য সাবেক ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, পুলিশ প্রতিদিন হাজার হাজার মামলা করছে, লাখ লাখ টাকা জরিমানা করছে। ফিটনেস বিহীন শতশত গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠাচ্ছে। তবুও সড়কে শৃঙ্খলা আসছেই না।
এসব বিষয়ে ডিএমপি ট্রাফিকের উত্তর জোনের ডিসি প্রবীর কুমার রায় বলেন, পথচারীরা অনেক সচেতন হয়েছে, এ কথা পুরোপুরি বলা যাবে না। রাস্তা পারাপার সম্পর্কে আমরা প্রতিনিয়ত পথচারীদের পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছি।
রাস্তায় লক্কর-ঝক্কর গাড়ির বিষয়ে ডিসি বলেন, প্রতিদিনই এ ধরনের গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করা হচ্ছে।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে বৈধ যানবাহনের সংখ্যা ৩৯ লাখ ২৭ হাজার ৭০২টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ২৫ লাখ ৫৩ হাজার ৫০৯টি। আর চালকের লাইসেন্স আছে ৩০ লাখ ২১ হাজার ১০৩টি। বিআরটিএ’র এই পরিসংখান থেকে দেখা যায় প্রায় ৯ লাখ অবৈধ চালক সড়কে গাড়ি চালাচ্ছেন।
অপরদিকে, এ বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিআরটিএ এর ভ্রাম্যমাণ আদলতে ২ লাখ ২২ হাজার ১৭টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় ২৭ কোটি ১৫ লাখ ৫ হাজার ১৮৯ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এছাড়া ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয় ৬ হাজার ১০৬টি গাড়ি। আর ৩ হাজার ৮৪৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
এছাড়া, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৩৩ হাজার ১১১টি মামলায় ১১ কোটি ৮০ লাখ ৫৩ হাজার ২০৫ টাকা আদায় করা হয়। ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয় ২০৭টি গাড়ি ও ৫৬২জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
সড়কের নিরাপত্তার বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক (প্রশাসন) মো. ইউছুব আলী মোল্লা বলেন, আমাদের ওয়েবসাইট, মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটসহ প্রতিটি শাখা অফিসে কাঠের বাক্স রয়েছে তাতে অভিযোগ জানালে পদক্ষেপ নেয়া সহজ হয়।
তিনি জনগণের উদ্দেশে বলেন, রাস্তায় কোন জরাজীর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি দেখলে তার ছবি-ভিডিও, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, স্থান ও সময় উল্লেখ করে বিআরটিএ এর ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটে দিলে বিষয়টি খতিয়ে দেখি। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট গাড়ির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়।
বিআরটিএ এর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মো. লোকমান হোসেন মোল্লা বলেন, সড়কে দুর্ঘটনা রোধে বা শৃঙ্খলা ফেরাতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এছাড়া আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা প্রয়োজন।