মাদকের মতো কিছু ব্যবসা লুকিয়ে করা যায়, সেটার খোঁজ পেতে হলে খোঁজখবর করতে হয়। যদিও গোপন বিষয়ে খোঁজখবর রেখে সেটার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়াও সরকারেরই দায়িত্ব। কিন্তু যে অনিয়ম প্রকাশ্য, যে অবৈধ বিষয়ে চোখের সামনে ঘটে সেটার ব্যাপারে সরকারের ন্যূনতম কোনো অজুহাত খাটে না।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, ঢাকার বিভিন্ন অলিতে-গলিতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলছিল। খুব সহজে চোখে পড়ার মতো আকারের এ রিকশা রাস্তায় প্রকাশ্যে চলছিল; কিন্তু হঠাৎ একদিন এ রিকশাগুলো নিষিদ্ধ করে দেয়া হল, কারণ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলো রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ছাড়া চলছিল, তাই ওগুলো অবৈধ! এ সিদ্ধান্তের ফলে এ রিকশা যারা কিনেছিলেন তাদের সবাই ভীষণ আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিলেন যদিও; এ অটোরিকশা বিক্রি করা কিছু কোম্পানি এবং এগুলোকে কিছুদিন রাস্তায় চলার ব্যবস্থা করা কিছু সরকারদলীয় লোকজন দারুণ পয়সা বানিয়েছিল। একই ধরনের পরিস্থিতি আছে নতুন সড়ক পরিবহন আইনটির ক্ষেত্রে।
আইনটি কার্যকর করার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিকরা ধর্মঘটে গিয়েছিলেন। নতুন পরিবহন আইনে কাভার্ড ভ্যানের ক্যারিয়ার বেশি হলে জরিমানার বিধান আছে। ২০ ফুট হচ্ছে কাভার্ড ভ্যানের ক্যারিয়ারের আন্তর্জাতিকভাবে মাপ। আমাদের দেশে এটি ২২ ফুট। স্বয়ংক্রিয়ভাবে না হয়ে মানুষ দিয়ে কাভার্ড ভ্যান লোড করার জন্য এ মাপ প্রয়োজন বলে মালিকরা বলে থাকেন। এ যুক্তিটাও সরিয়ে রাখি।
এ দেশে বছরের পর বছর হাজার হাজার কাভার্ড ভ্যানকে এ মাপে ফিটনেস দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। এখন একটা আইন করে ফেলে রাতারাতি সেটাকে কমিয়ে আনতে বলা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। আর যে সরকারি সংস্থা এরকম অনিয়ম প্রশ্রয় দিয়ে সংকট তৈরি করে সেই সরকারি সংস্থা আবার নতুন করে নতুন আইন প্রয়োগ করবে, এটিও এক ভয়ংকর চিন্তা।
নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না, আমরা কেউ কি এমন প্রত্যাশা করেছিলাম? আমি বিশ্বাস করি, এ আইন কার্যকর করার শুরুতেই যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেটি মোটেও অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। এমনটি হওয়ার কথা ছিল। এ সরকার যেভাবে দেশ পরিচালনা করছে তাতে এটাই ভবিতব্য।
আইনটির টেকনিক্যাল বিষয়ে খুব বেশি যেতে চাই না। এরই মধ্যে অনেকেই এ বিষয়টাকে আলোকপাত করে দেখিয়েছেন এ আইনের ভেতরে নানা রকম অসঙ্গতি, বৈপরীত্য আছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি সংস্থার অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বছরের পর বছর ধরে পুঞ্জীভূত সমস্যা একটা আইনের ফলে রাতারাতি পাল্টে ফেলা যাবে কি?
আমরা মনে করতে পারব, পরিবহন আইনটি সংসদে পাস করা হয়েছিল ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। যদিও এ আইনটি তৈরি করা হয়েছিল তারও বেশ আগেই। বরাবরের মতোই পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের যৌথ প্রতিবাদের মুখে এ আইনটি পাস করা হয়নি। তারপর একটা দুর্ঘটনায় দুজন ছাত্রছাত্রীর মৃত্যুতে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন শুরু হল। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমে এলো, রাস্তার দখল নিল তারা।
যে সময়টা এ ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নামে সেই সময়টা থেকে নির্বাচন আর খুব বেশি দূরে ছিল না। আন্দোলনটা নিয়ে সরকার নিশ্চিতভাবেই খুব নার্ভাসবোধ করতে শুরু করে। একপর্যায়ে হেলমেট পরে আওয়ামী লীগের কর্মীরা রাস্তায় এই ছাত্রছাত্রী এবং সাংবাদিকদের পিটিয়ে তুলে দেয়।
যেহেতু একটা জাতীয় নির্বাচন সামনে, তাই সরকার চায়নি এ সময়টায় খুব বড় কোনো সংকট দেশে তৈরি হোক। তেমন কিছু হলে তাদের পরিকল্পিত নির্বাচনের আগে ‘ভিন্ন কিছু’ ঘটে যেতে পারে এমন ভীতির কারণে সরকার তখন সংসদে সেই আইন পাস করার সিদ্ধান্ত নেয়।
দেশের সব মানুষের জন্য কল্যাণকর এ ন্যায্য আইনটি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সরকারের পাস করা উচিত ছিল অনেক আগে। কিন্তু এটি এ মুহূর্তের বাংলাদেশ, এর জন্যও প্রচণ্ড চাপ তৈরি করতে হয়েছিল।
আইনটি এবার কার্যকর করার সময় সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে আইনটি করার সময় এর খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন, মালিক এবং শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে।
শুধু তাই-ই নয়, মালিক-শ্রমিকদের দুই সংগঠনের প্রধান দুই নেতা শাজাহান খান এবং মসিউর রহমান রাঙ্গা সংসদ সদস্য। তাদের ন্যায্য স্বার্থের পরিপন্থী কিছু থাকলে সেটা নিয়ে তারা খুব সহজেই সংসদে কথা বলতে পারতেন এবং সেটা সংশোধনের দাবি জানাতে পারতেন।
আইনে আসলেই কিছু অসঙ্গতি আছে, শুধু ওই দুজন এমপি কেন, ওই সংসদের এ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি এবং অন্যান্য এমপির উচিত ছিল এ আইনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এর অসামঞ্জস্যগুলো খুঁজে বের করা। আমাদের প্রায় সব সংসদ সদস্যকে দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই, সংসদ সদস্যদের প্রধান কাজের একটি হচ্ছে আইন প্রণয়ন-সংশোধন।
প্রায় সবারই সব ব্যস্ততা হচ্ছে উপজেলা পরিষদ আইনের ২৫ ধারা বলে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হয়ে স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন কাজ এবং টিআর-কাবিখা নিয়ে। শুধু তাই নয়, আইনটি পাস হওয়ার এক বছরেরও বেশি সময় পার হওয়ার পর এটি কার্যকর করতে গিয়েছিল সরকার।
এমনকি কার্যকর শুরু করার পর আরও তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করা হয়েছে। এ পুরো সময়টা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কোনো রকম কোনো আপত্তি করেনি। বরং গত বছর সংসদে এ আইন পাস হওয়ার পর মালিক-শ্রমিক পক্ষগুলো এ আইনের সমর্থনে মিডিয়ায় কথা বলেছিলেন।
তাহলে আইন কার্যকর করার পর কেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা ‘কর্মবিরতিতে’ গেলেন? তারা আসলে ধর্মঘটই ডেকেছিলেন। বর্তমান শ্রমিক আইনে ধর্মঘট করার ক্ষেত্রে কিছু বাধ্যবাধকতা পূরণ না করলে আহ্বানকারীরা আইনি জটিলতায় পড়তে পারেন, তাই তারা কর্মবিরতির মোড়কে ধর্মঘট করেছিলেন।
প্রশ্ন আসবেই, এতগুলো দিন এ আইনটা পাস হয়ে পড়েছিল, তখন কেউ কোনো কথা বলেনি কেন? যে আইনটা পাস হওয়ার পর মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষ সাধুবাদ জানিয়েছিলেন, সেটাকে নতুন করে সমস্যাপূর্ণ বলে মনে হল কেন?
বিবিসি বাংলা এই প্রশ্ন শাজাহান খানকে করেছিল। তিনি তখন স্বীকার করেছেন আইনটির ব্যাপারে তাদের মতামত নেয়া হয়েছিল; কিন্তু আইনের বিস্তারিত তারা তখন কিংবা এর পরেও খেয়াল করেননি। এখন খেয়াল করেছেন এবং সেই ব্যাপারে তারা কাজ করে সরকারের কাছে সুপারিশমালা দিচ্ছেন।
যে সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে এত কথা, যে ধারাগুলোর আর্থিক শাস্তি, কারাদণ্ডের পরিমাণ বা জামিন অযোগ্যতা নিয়ে এখন তাদের আপত্তি, এসব ধারা নিয়ে তখনও তো কথা হয়েছিল; কিন্তু তখন তো তারা কোনো প্রতিবাদ করেননি। আসলে তারা সব জেনেও চুপ ছিলেন এবং অপেক্ষা করছিলেন সরকারকে তাদের অন্যায্য দাবি মানানোর সঠিক সময় পাওয়ার।
পরিবহনের মালিক-শ্রমিকদের সম্মিলিত চাপের মুখে সরকার নতি স্বীকার করেছে এবং একটা উদ্ভট সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সরকার ৩০ জুন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নতুন আইনে নেবে না বলে জানিয়েছে। একটা আইন কার্যকর থাকা অবস্থায় সরকারের এরকম প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেয়াটা আইনের পরিপন্থী।
আমিও মনে করি, সত্যিই এ আইন কার্যকর করার আগে কিছু সময় দেয়া জরুরি ছিল। সেটা এই আইন কার্যকর করার আগে স্পষ্টভাবে বলা দরকার ছিল। এই যে পাস করার পর থেকে আইন কার্যকর করার আগ পর্যন্ত এক বছর সময় গিয়েছিল, এই এক বছরে সরকার বারবার বলতে পারত ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং গাড়ির ফিটনেসের কাগজগুলো এই এক বছরের মধ্যে ঠিক করে নিতে হবে এবং আইন কার্যকর করার পর কারও কোনো দাবি আর গ্রহণযোগ্য হবে না।
সরকার যে শুধু কিছু ধারাকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে সময় নিচ্ছে তা-ই নয়, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপে সরকার আইনের শাস্তি সংশ্লিষ্ট কিছু ধারা সংশোধনের জন্য বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে এবং সেগুলো আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি স্পষ্টভাবেই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে রাস্তায় জমায়েত হওয়া শিশু-কিশোরদের প্রতি প্রতারণা।
এটি সড়কে নানা অনিয়মের ফলে দুর্ঘটনায় প্রতিবছর মারা যাওয়া প্রায় ২৪ হাজার মানুষ, তার কয়েকগুণ আহত-বিকলাঙ্গ মানুষ এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতিও প্রতারণা।
এ পর্যন্ত আলোচনা একটা প্রেক্ষাপট বর্ণনা করার জন্য, যে প্রেক্ষাপট আসলে আমাদের বোঝাতে পারবে আইনটি নিয়ে এমন হল কেন। এই সরকার আসলে চালিত হচ্ছে মূলত চাপ প্রয়োগ করার ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় শিশু-কিশোরদের চাপটা সরকারের কাছে খুব বড় মনে হয়েছিল, তাই সরকার সেটার কাছে নতি স্বীকার করে আইনটা পাস করেছিল, পরিবহন মালিক এবং শ্রমিকরা তখন খুব বেশি উচ্চবাচ্য করেননি; কারণ তারা দেখেছিলেন রাস্তার চাপটা অনেক বেশি ছিল তখন। তারা অপেক্ষা করছিলেন।
এখন আবার সরকার বেশ সমস্যার মধ্যে আছে বেশকিছু দিন থেকে। সড়ক পরিবহন আইন যখন সরকার কার্যকর করতে গিয়েছিল তখন পেঁয়াজ নিয়ে এক মারাত্মক সংকট সারা দেশে চলছে। পেঁয়াজের দাম নিয়ে সরকার যখন জেরবার, তখন সরকারের পক্ষে আরেকটা পরিবহন ধর্মঘটের চাপ নেয়া খুবই কঠিন ছিল।
জনগণ এবং পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে সেটা চরম বিপর্যস্ত অবস্থা তৈরি করতে পারত। তাই সরকার এ চাপটা এখন অনেক প্রবলভাবে বোধ করেছিল, তাই তারা মালিক-শ্রমিকদের দাবি মেনে নিয়েছিল। মানে এমন একটা সরকার এ মুহূর্তে দেশ শাসন করছে, তারা স্রেফ নানাজনের নানা চাপের কাছে নতি স্বীকার করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
আমাদের মতো দেশে যেখানে নানা সেক্টরে অসংখ্য অনিয়ম আছে সেখানে একটা নতুন আইন কার্যকর করা সেই অনিয়মের সুবিধাভোগীদের অসন্তুষ্ট করবেই। তারপরও বৃহত্তর জনগণ, এমনকি সেই অনিয়মের সুবিধাভোগীদেরও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষার জন্য আইন করতে হয়।
সব ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের একটা নির্দিষ্ট নীতি থাকা জরুরি; কিন্তু সরকার সেটা করছে না। কোনো এক পক্ষের চাপে ক্ষমতা নিয়ে ভীতির কারণে সিদ্ধান্ত নেয়া, আবার অপর পক্ষের চাপের ফলে আবার তার উল্টো সিদ্ধান্ত নেয়া, এভাবেই চলছে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মরিয়া সরকার। বহুকাল ধরে এ রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো সুদূরপ্রসারী নীতি আমরা দেখতে পাচ্ছি না। রাষ্ট্র চলছে ‘অ্যাডহক’ ভিত্তিতে।
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্ট