বিশেষ প্রতিনিধি: ৪ বছর আগে প্রাকৃতিক ভাবেই একটা এবোরশন হয় ২৬ বছর বয়সী সম্পার। তার পর থেকে ছেড়ে ছেড়ে পেটে ব্যাথা। আর মাসের মধ্যে ২ থেকে ৩ বার করে রক্তপাত হচ্ছিল। সিলেট সদরের বাসিন্দা ব্যাংককর্মী সম্পা এই ব্যাথা নিয়ে ঢাকা-সিলেটসহ দেশের আরও কয়েকটি জায়গার প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরন্নাপন্ন হন। সময় সময় ব্যাথা ছড়িয়ে পড়তে থাকে শরীরের অন্যান্য জায়গায়। বিখ্যাত ওইসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে করে কিডনি ইনফেকশন বা কিডনি ড্যামেজ বলে জানিয়ে দেয়। কিন্তু ভারতের ভেলোরের ক্রিস্টিয়ান মেডিক্যাল কলেজ (সিএমসি)’তে গিয়ে দেখা গেলো পেটের ভেতর দুটি সন্তানের মৃত ভ্রুণ। ইনকমপ্লিট এবোরশনের কারণেই ব্যাথা আর রক্তপাত।
ভেলোরের সিএমসি হসপিটালে চিকিৎসাধীন সম্পা টেলিফোনে নিউ ইয়র্ক মেইলকে বলেন, সিলেট শহরের সর্বোচ্চ খ্যাতিমান ডাক্তাদের দেখানো শেষ করে রাজধানী ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি আরও কয়েকটি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দেখিয়েছি। কিন্তু কেউই কোনো রোগ ধরতে পারে না। ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাম, ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট, এমআরই, সিটি স্ক্যান এমনকি এন্ডোসকপি করেও কেউ কোনো রোগের নাম বলতে পারে নি। মূল সমস্যা ধরতে পারেনি।
তিনি বলেন,, সিলেট শহীদ শামছুদ্দিন আহমেদ/সদর হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুস সাকিব বললেন আমার কিডনির একটা সাইডে ব্লক আছে। কিন্তু এটা কেনো হয়েছে তা তিনি বুঝতে পারছেন না। প্রাথমিক ভাবে তিনি টিবি, কিডনিতে পাথর বা জন্মগত কারণের জন্য এটা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রায় ৪০ হাজার টাকার বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দেন। বিখ্যাত এই ডাক্তারকে দেখানোর জন্য ৬ মাসের আগে কোনো সিরিয়াল পাওয়া যায় না। খুব সিরিয়াস রোগীর ক্ষেত্রে তার সহকারীরা ৫০০ টাকার বিনিময়ে সিরিয়াল ম্যানেজ করে দেয়। কিন্তু ভারতের ভেলুরের ক্রিস্টিয়ান মেডিক্যাল কলেজ (সিএমসি)’তে এসে জানতে পারলাম আমার পেটে দুইটা জমজ বাচ্চার ভ্রুণ রয়েছে। এখানকার ইউরোলজি স্পোশালিস্ট ডা. কানাকা মেডালা শ্রীকান্ত ও গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. এম্যালি দেবীয়া ইবেনজারের অধীনে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায় নিশ্চিত হয়ে গত ১৩ নভেম্বর তারিখে এখানকার গাইনী বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মনিষা মাধাই বেক এবং ডা. রিতা ভিজয়া সেলভীর অধীনে অস্ত্রোপাচার করে ভ্রুণ দুটি বের করা হয়। তারপর থেকে রক্তপাত বন্ধ হয়েছে। আজকে (সোমবার) আর কোনোও ব্যাথাও নেই। কিন্তু বাংলাদেশের ডাক্তারদের ডায়াগনোসিসের কথা ভেবে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঘাম ঝরে। আমাকে কি ভয়টাই না ওনারা পাইয়ে দিয়েছিলেন।
সম্পা বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে খ্যাতিনামা হাসপাতাল স্কয়ার হাসপাতাল। ওখানকার বিশেষজ্ঞ ডা. মেজবাহ উদ্দিন আমাকে বলেছিলেন আমার কোমরের হাড় ক্ষয় হয়ে গিয়েছে। তাই এই ব্যাথা। এর কোনো চিকিৎসা নেই। কিন্তু এখানকার ডাক্তাররা বলছেন আমার শরীরে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কিছুটা কম। ওষুধ খেলেই কমে যাবে।
প্রায় ৭০ হাজার টাকার পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও বেসরকারি অন্য একটি হাসপাতালের দুই চিকিৎসক ডা. মেসবাহ উদ্দিন ও ডা. খালেদ আহমেদুর রহমান আমার কোনো রোগ ধরতে পারেন নি। সিলেটের এম.এ.জি. ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. শফিকুল ইসলাম (লীন) তো বললেন, আমার বাম দিকের কিডনিটা ফোলা। এবং এর কোনো চিকিৎসাই নেই। তাই তিনি কোনো ওষুধও দেন নি। তবে সবচেয়ে বেশি ভয় দেখিয়েছে সিলেট নর্থ ইস্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মধুসূদন সাহা। তিনি তার প্রেসক্রিপশনে স্পষ্ট করে লিখেছেন যে আমার কিডনিতে ইনফেকশন রয়েছে। তার এমনও ভাষ্য ছিলো এখনই চিকিৎসার আওতায় না আসলে কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে ডায়ালাইসিসের আওতায় আসতে হবে। কিন্তু সিএমসি’র ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বললো আমার কিডনি সম্পূর্ণ ভালো আছে। কোনো ইনফেকশন বা ব্লক তো নেইই এমনকি আর অন্য দশ জনের চাইতে আমার কিডনি ভালো। যেখানে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের পরামর্শে রোগ ডায়াগনোসিসের জন্য ১ থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ করেছি সেখানে সিএমসিতে মাত্র ৭০ হাজার টাকার মধ্যে অস্ত্রোপাচারসহ সব ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পেরেছি।
৬ বছর বয়সী এক ছেলের মা সম্পা বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থা রেখেই একটু সুস্থভাবে জীবন যাপন করার জন্য চিকিৎসকদের দ্বারে দ্বারে দিনের পর দিন ঘুরেছি। কিন্তু কেউ আমাকে একটু সান্তনার বানী তো শোনানই নি বরং দেখিয়েছেন ভয়। যার কারণে আমি মৃতপ্রায় একটি জীবন যাপন করছিলাম। তীব্র পেটের ব্যাথায় সারা রাত নির্ঘুম থেকে সকাল বেলা আবার অফিস করেছি জীবিকার তাগিদে। সেই উপার্জনকেও নির্ধিদ্বায় খরচ করেছি এসব ডাক্তারদের পেছনে। কিন্তু বিনিময় কি পেলাম? আমার মতো রোগীদের নিয়ে এইসব ডাক্তার নামী কসাইদের শাস্তি দাবি করেন তিনি।
তবে ভুল রোগ নির্ণয় বা ভুল চিকিৎসার ব্যাপারে চিকিৎসকরা পুরোপুরি দায়ী নয় বলে মন্তব্য করেছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এর সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সনাল। তিনি বলেন, একটা রোগীর যখন রোগ নির্ণয় করার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় তখনই যদি কোনো ভুল হয় তাহলে ভুল চিকিৎসা তো হবেই। এক্ষেত্রে আমাদের প্যাথলজিস্টদের দক্ষতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া রয়েছে চিকিৎসক সংকট। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন ডাক্তারের যে কয়জন রোগী দেখার কথা তার চাইতে প্রায় ৩ গুণ ৪ গুণ রোগী তাকে দেখতে হয়। ফলে রোগের ইতিহাস, রোগের ধরণ সবকিছু ঠিকভাবে নেওয়ার সময়টা ওই চিকিৎসকরা পান না। তবে এই জায়গাটাকে পরিবর্তন করতে হবে। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে একটা নির্দিষ্ট নিয়ম নীতির আওতায় নিয়ে আসাটা জরুরি। শুধু নতুন নতুন চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েই আমাদের দায়মুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। জনগণ যাতে সঠিক চিকিৎসাটা পায় তার নিশ্চয়তার জায়গাটা তৈরি করতে হবে। না হলে এভাবে আমাদের চিকিৎসাখাতের একটা বড় আয়ের ভাগ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চলে যাবে বলে আমি মনে করি।
একই কথা বলেন রাজধানীর ইউনিভার্সেল হাসপাতালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, আমাদের এখানকার ডাক্তাররা একজন রোগীর বিপরীতে যে সময়টা দেন তা রোগীর রোগ যাচাইয়ে পর্যাপ্ত নয়। রোগীর সংখ্যা ডাক্তারের তুলনায় বহুগুণে বেশি। তবে সময়ের সাথে সাথে এই ব্যবধান কমে আসবে বলেই আমরা আশা করছি।