অধিকৃত কাশ্মীর ও আসামে ও মুসলমানদের উপরে গণহত্যা শুরু করতে যাচ্ছে ভারত। গণহত্যা প্রতিরোধ ও বন্ধে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর গ্রেগরি স্ট্যানটন এই মন্তব্য করেছেন।
বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য ও দেশটির সরকারি কর্মকর্তাদের এক অনুষ্ঠানে এই সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা তার উপস্থাপিত বক্তব্যে বলেন, গণহত্যা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ করে ফেলেছে তারা। এসময় তিনি নাৎসী শাসনামলে জার্মানির সাথে নরেন্দ্র মোদির সরকারের অধীনে ভারদের সাথে তুলনা করেন।
১৯৯৬ সালে গণহত্যার ওপর গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তিনি। পরিকল্পনা থেকে শুরু করে কীভাবে একটি জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয় তার প্রতিটি ধাপ সেই গবেষণায় তুলে ধরেন তিনি। তার এই প্রতিবেদন ‘গণহত্যার দশ ধাপ’ নামে ব্যপক সমাদৃত হয় ও তাকে বিশ্বজুড়ো খ্যাতি এনে দেয়।
ভারতে কীভাবে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে ধাপে ধাপে গণহত্যার মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে অনুষ্ঠানে সেই চিত্র তুলে ধরেন তুলে ধরেন স্ট্যান্টন। তিনি জানান, গণহত্যা করার প্রথম ধাপ হচ্ছে সমাজে বিভাজন তৈরি করা। এজন্য মোদি সরকার হিন্দুদের মধ্যে ‘আমরা বনাম তারা’ ধারণা সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয় ধাপ বাকিদের থেকে তাদেরকে আলাদা করে অনাকাঙ্খিত হিসেবে তুলে ধরা, এজন্য মোদি সরকার মুসলমানদেরকে ‘বিদেশি’ হিসেবে পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করছে। তৃতীয় ধাপ হচ্ছে বৈষম্য সৃষ্টি করে তাদের সব অধিকার কেড়ে নেয়া। ভারতে মুসলমানদেরকে নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাদেরকে সকল নাগরিক বা মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ফলে তাদের প্রতি বৈষ্যম্য করা হলেও কোন আইনগত ভাবে বৈধ হবে। চতুর্থ ধাপ অমানবিকীকরণ করা; এই ক্ষেত্রে যেকোনো ভাবে ভুক্তভোগীদের ‘নিকৃষ্ট’ হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়। যেমন ভারতে মুসলমানদের ‘সন্ত্রাসী’, ‘উইপোকা’ অথবা ‘ক্যান্সারের মতো রোগ’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। যাতে তাদেরকে সমাজের অন্য সবাই তাদেরকে ‘ক্ষতিকর রোগ’ হিসেবে ‘নির্ম‚ল’ করা জরুরি মনে করে। পঞ্চম ধাপ হচ্ছে গণহত্যা সংঘটনের জন্য একটি সংস্থা তৈরি করা যমন ভারতের ‘আরএসএস’। কাশ্মীরে এই ভ‚মিকা পালন করেছে ইন্ডিয়ান আর্মি। অন্যদিক আসামে পুলিশ ও এনআরসি বাস্তবায়নকারীরা। ষষ্ঠ ধাপ হচ্ছে মেরুকরণ; যা করতে ব্যপক প্রচারণা শুরু করা হয়। সপ্তম ধাপে শুরু হয় প্রস্তুতি। অষ্টম ধাপ ধাপ থেকে নিপীড়ন চালানো শুরু হয়। বিভিন্ন আইন ও পদ্ধতিতে ভুক্তভোগীদের অবরুদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। নেতাদের জেল দিয়ে বা আটক রেখে ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে তাদের প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নেয়া হয়। বর্তমানে আসাম এবং কাশ্মীর এই ধাপে রয়েছে।
এর পরেই শুরু হবে নবম ধাপ নির্ম‚লকরণ, গণহত্যা ও বিতাড়নের মাধ্যমে এই ধাপ সম্পন্ন করা হবে। যেমনটি হয়েছিল মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে। সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে অপরাধ অস্বীকার করা।
এর আগে মার্কিন প্রখ্যাত এই মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেছিলেন। তার এই প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে রুয়ান্ডা এবং বুরুন্ডিতে গণহত্যার তদন্তে একটি কমিশন গঠন করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা ও রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়েও তার গবেষণা রয়েছে; যা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত।
সিটিজেনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিসের সেক্রেটারি ও মানবাধিকার কর্মী তিস্তা সেটালভাদও মার্কিন কংগ্রেস কর্মকর্তাদের ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, আসামে মানবাধিকার ভ‚লুণ্ঠিত করার জন্য জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকাকে (এনআরসি) ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত কিছু বিধি-বিধান এবং মান নির্ধারণকারী প্রক্রিয়া রয়েছে; কিন্তু সেসবের কিছুই মানা হয়নি। আমরা সংবিধানের নীতিমালার আলোকে এটি বাস্তবায়ন করার আহŸান জানিয়েছি।
ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সমালোচনা করে মানবাধিকার কর্মী তিস্তা সেটালভাদ বলেন, এটা দেশজুড়ে মানুষের মাঝে প্রচুর দুর্ভোগ তৈরি করবে। এটা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ঠকে মৌলিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। যে কারণে সচেতন সব নাগরিক সংবিধানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করার জন্য সরকারের প্রতি আহŸান জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ঘিরে ভারতে চলমান সহিংসতা, জম্মু-কাশ্মীরের অচলাবস্থা, মুসলিম নিপীড়নের ঘটনায় ওয়াশিংটন ডিসিতে কংগ্রেস সদস্য ও মার্কিন কর্মকর্তাদের নিয়ে ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল দেশটিতে বসবাসরত ভারতীয় মুসলিম-হিন্দুদের তিনটি সংগঠন। এই তিন বেসরকারি সংগঠন হলো, ইন্ডিয়ান আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিল (আইএএমসি), এমগেইজ অ্যাকশন ও হিন্দুস ফর হিউম্যান রাইটস (এইচএফএইচআর)।
জেনোসাইড ওয়াচের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত গণহত্যার ১০টি ধাপ হলো-
প্রথম ধাপ: সমাজে বিভাজন তৈরি করা। এই বিভাজন ‘আমরা’ বনাম ‘তারা’।
দ্বিতীয় ধাপ : একটি প্রতীক দাঁড় করানো, ভুক্তভোগীদের ‘বিদেশি’ হিসেবে ডাকা।
তৃতীয় ধাপ: বৈষম্য। একটি শ্রেণিকে নাগরিকত্বের বাইরে রাখা। বৈষ্যমের আইনি বৈধতা তৈরি করা। যেন ওই শ্রেণির মানুষের কোনও নাগরিক বা মানবিক অধিকার না থাকে।
চতুর্থ ধাপ: অমানবিকীকরণ করা। যখন গণহত্যার বিষয়টি অগ্রসর হতে থাকে। যেকোনোভাবে ভিকটিমকে নিকৃষ্ট হিসেবে তুলে ধরা। তাদেরকে সন্ত্রাসী কিংবা অন্য কোনো জন্তুর সঙ্গে তুলনা করা। অথবা ক্যানসারের মতো রোগের সঙ্গে টার্গেট জনগোষ্ঠীকে তুলনা করা। যেন তাদেরকে সমাজের কাছে বালাই হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।
পঞ্চম ধাপ: গণহত্যা সংঘটনের জন্য একটি সংস্থা তৈরি করা।
ষষ্ঠ ধাপ: মেরুকরণ, যা প্রচারণার মাধ্যমে করা হয়।
সপ্তম ধাপ: প্রস্তুতি।
অষ্টম ধাপ: নিপীড়ন। বর্তমানে আসাম ও কাশ্মীর এই ধাপে রয়েছে।
নবম ধাপ: নির্মূলকরণ।
দশম ধাপ: অস্বীকার করা।