অমিতা সিনহা, সিলেট থেকে: সেদিন আর বেশি দুরে নয়! নতুন প্রজন্মই একদিন সিলেটের চেহারা বদলে নতুন একটি আধুনিক সিলেট গড়ে তুলবে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিয়ে আমি অত্যন্ত আশাবাদি। প্রবাসের সাথে পাল্লা দিয়ে সিলেটে একটা মেধাবী জেনারেশন গড়ে উঠছে। এই জেনারেশনের হাত ধরে পরিবর্তন আসবে।
নিউইয়র্ক মেইল-এর সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের দুইবারের নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
মেয়র বলেন, আমাদের ইয়াং জেনারেশন প্রবাসে যারা আছেন তারা চাকরি, পড়াশোনাসজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাম্বার ওয়ান। সিলেটসহ বাংলাদেশের মুখ উজ্বল করছে। কোনো কোনো দেশে সিলেটের ছেলে-মেয়েরা বিশ্ব সেরা। অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের এখানকার ছেলেমেয়েরাও এগিয়ে যাচ্ছে। প্রবাস থেকেও অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরা সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে সিলেটে আসার আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাতে করে নাড়ীর টানে এখানে আসতে পারে, যেন দূরে না যায় তাদের অভিভাবকদের সাথে সেসব বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। তারা যেন ছুটির সময় অন্য কোনো দেশে না গিয়ে সিলেটে আসে আমরা সে ব্যবস্থা গ্রহন করছি।
নগরির জলাবদ্ধতা নিরসন বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খুব শিগগির সিলেট শহর জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সম্ভব সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বেশির ভাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাকী প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ হবে।
বর্তমানে জলবদ্ধতা নিরসনের জন্য সমস্ত শহরে আমরা অত্যাধুনিক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি উল্লেখ করে তিনি বলেন,ফুটপাতকে আমরা নতুন রূপ দিতে যাচ্ছি। তাই আমাদের ছড়াগুলো নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করেছি। পরবর্তীতে আমরা পুরো নেটওয়ার্কটা সম্পন্ন করতে পারলে আমি আশাবাদি সিলেট শহরকে জলবদ্ধতার হাত থেকে মুক্ত করতে পারবো। এজন্য জনগণ সব ধরনের সহযোগীতা করছেন। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ যোগীতার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
নগরীর উন্নয়নে ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, এই নগরীকে একটি স্মার্ট সিটি, একটি ক্লিন সিটি এবং এটা একটা পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলাটাই আমার প্রধান টার্গেট। যেমন-জলবদ্ধতা হাত থেকে শহরকে রক্ষা করা, একটি আধুনিক একটি বাসটার্মিনাল ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করা। আমাদের সব মার্কেটগুলোকে একত্রিত করে যাতে সিলেট শহরের ভিতরের ট্রাকগুলোকে বাইরে নিয়ে যাওয়া যায়। চাউলের আড়ত, পেঁয়াজের আড়ত, ফল মার্কেট, কাঁচাবাজার সবগুলো আড়তদারি মার্কেট আমি শহরের বাইরে ট্রাক টার্মিনালের পাশে নিয়ে যাচ্ছি। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে শহরটা যানজট মুক্ত করতে পারবো।
সিটি বাস সার্ভিসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৬ ডিসেম্বর থেকে সিটি বাস সার্ভিস চলা শুরু হয়েছে। এই বাসে সাধারণ মানুষ স্বল্প মূল্যে খুব কম সময়ের মধ্যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারছে।
নগরিতে নতুন একটি ইমার্জেন্সি লেন করার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে লেইনে শুধু সিটি বাস, ইমার্জেন্সি পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ছাড়া অন্য কেউ ঢুকতে পারবে না। সেই লেইন দিয়ে আমরা গণ পরিবহন চালাতে পারবো। এটা যখন বৃদ্ধি পাবে তখন সাধারণ মানুষ তার সুফল পাবে। রাস্তাঘাট তখন একটা সুন্দর, একটা সিস্টেমেটিকভাবে চলে আসবে। তাছাড়া আমাদের বিদ্যুৎ আন্ডার গ্রাউন্ড করা হচ্ছে। লাইটের খুঁটি, টিএনটি’র খুঁটি এগুলো সব সম্প্রসারণ হয়ে যাবে, শহর একটা পর্যটন নগরীতে পরিণত হবে।
মেয়র বলেন, আশাকরি, দুই বছরের মধ্যে আমরা একটা সাসটেইনেবল এনভারমেন্টে চলে আসবো। তখন এই শহরের যে ময়লা, আবর্জনা, সলিডওয়েস্ট এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। মেডিকেল ওয়েস্ট ও সলিড ওয়েস্ট এক সঙ্গে ডাম্পিং ছিল। আমরা সেখানে মেডিকেল ওয়েস্টটাকে আলাদা করতে পেরেছি। তাই এখন আমরা এক ধরণের ভাইরাল ব্যাক্টেরিয়া এবং মহামারির ভয় থেকে মোটামুটি বের হতে সক্ষম হয়েছি। এখন সলিড ওয়েস্টের কাজ চলছে। আশাকরি এটা যদি দ্রুত সম্পন্ন করতে পারি তা হলে দেখা যাবে এই শহরের চেহারাই পাল্টে গেছে।
মেয়র বলেন, আমরা সুস্থ্য শহর গড়ার পরিকল্পনা হিসেবে আমাদের রেস্টুরেন্টগুলোকে হাইজেনিক করার কাজ চলছে। অসুস্থ্য পরিবেশ যেন সৃষ্টি না হয় এজন্য মেডিক্যালটিম তৈরি করা হচ্ছে। তারা মুভমেন্ট করবে প্রত্যেকটি রেস্টুরেন্টে। এর আগে আমরা অ্যাওয়ারনেস এর ব্যবস্থা করছি। কারণ হঠাৎ করে আমি নির্দেশ দিলে হবে না। মানুষকে বোঝাতে হবে।
শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে মেয়র আরিফুল হক বলেন, আমাদের নবজাতক শিশুদেরকে হেলথ কার্ডের আওতায় নিয়ে আসতে হচ্ছে। যাতে করে বাচ্চারা তার হাইট ওয়েটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের ভ্যাকসিন ছাড়াও প্রোপারলি সেবা নিতে পারে। ওয়ার্ড ভিত্তিক ডাটা ইনফরমেশনের ব্যবস্থা করে মানুষকে সেবা দেয়ার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
শিক্ষা ক্ষেত্রে একটা আমুল পরিবর্তন করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করে সিলেটের এই মেয়র বলেন, আমাদের সিলেট সিটি কর্পোরেশনের বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র। সাধারণ পরিবারের সন্তানরা কিভাবে অল্প খরচে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করতে পারে সে ব্যাপারে আমরা বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছি। যারা শ্রমজীবি মানুষ তারা দিনে কাজ করবে আর রাতে পড়াশোনা করবে। মেয়েদের জন্য আলাদা সেশন এবং ছেলেদের জন্য আলাদা সেশন করার পরিকল্পনা নিচ্ছি। আমরা প্রতিবন্ধি বাচ্চাদের জন্যও বিশেষ পরিকল্পনা নিচ্ছি। ওরা যাতে মানুষের উপর বোঝা না হয়, এরা যেন এই সমাজে আমাদের সঙ্গে পড়াশুনা ও কাজ করতে পারে সে বিষয়েও আমরা বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছি।
নগরিতে অত্যাধুনকি ও আন্তর্জাতিক মানের কালচারাল সেন্টার প্রতিষ্ঠারও অঙ্গীকার করেন তিনি।
নগরির নিরাপত্তার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন,আমরা পুরো শহরটাকেই সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষের যাতে নিরাপত্তা বিঘিœত না সেজন্য প্রত্যেক মোগে এবয় বিশেষ পয়েন্টে অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করবো। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ছিনতাই, রাহাজানি বন্ধ হবে।
সিলেটকে মাদকমুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে আরিফুল হক বলেন, মাদক ব্যবসায়িদের নির্মূল করার পাশাপাশি মাদক সেবীদের কিভাবে ছোট ছোট কর্ম সংস্থানের মাধ্যমে তাদেরকে প্রভাইট করা যায় সে ব্যাপারে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। যাতে তারা কর্মহীন হয়ে ডিপ্রেশন বা ফ্রাস্ট্রেশনের কারণে মাদক গ্রহনের পথে না যায়। এসব পরিকল্পতা বাস্তবায়িত হলে নতুন এক সিলেট নগরি দেখা যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
আরিফুল হক চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৯ সালের ২৩ নভেম্বর সিলেট শহরের কুমারপাড়ায়। বাবা মরহুম শফিকুল হক চৌধুরী ও মা আমিনা খাতুন। বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও ছিলেন শিক্ষক। স্ত্রী শ্যামা হক চৌধুরী। বিয়ের পর তিনি স্বামীর সাথে রাজনীতি ও উন্নয়ন মূলক কাজে যোগ দেন।
আরিফুল হক চৌধুরী ২০১৩ সালের ১৫ জুন প্রথমবার সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। এবং দ্বিতীয় দফায় ২০১৮ সালে আবারো মেয়র নির্বাচিত হন। এর আগে আরিফুল হক চৌধুরী ২০০৩ সালে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কমিশনার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরে আরিফুল হক চৌধুরী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। তিনি এই দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সিলেট মহানগর বিএনপি’র সভাপতি ও জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।